আলো কমিয়ে ‘Lunar mode’ এ নামিয়ে বিছানার কাছে এগিয়ে যান শান্তা। তাঁর ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটি গুটিশুটি পাকিয়ে ঘুমনোর ভাণ ধরে শুয়ে আছে। মাত্র তিন বছর বয়সেই যা অভিমানী হয়েছে মেয়েটা! আজ স্কুলে “atomic structure” এর presentation এ “C – grade” পাওয়াতে মেয়েকে ছোট্ট একটা বকুনি দিয়েছিলেন। এত খাটা-খাটুনি করে মেয়ের জন্য presentation-টা তৈরী করে দিলেন, আর মেয়ের স্রেফ ভুল উচ্চারণের দোষে কিনা সব পন্ড হয়ে গেল! তাহলে আর এত কাঁড়ি কাঁড়ি ইয়েন খরচ করে “Kidz IELTS” করানোর মানে কি?
পরে অবশ্য অনুতাপই হয়েছিল। হয়ত পিউ এর ছোট্ট ব্রেনের ওপর চাপটা একটু বেশীই হয়ে গেছে! আর পিউটাও কেমন যেন বেশ একটু খেয়ালী, একটু বেশীই ভাবুক টাইপের। এখনও তার রাতঘুম অপেক্ষা করে মায়ের মুখের গপ্পো শোনার মত মধ্যযুগীয় বিলাসিতার। মাঝে মাঝে ভয় হয়, মেয়েটা অটিস্টিক না তো? গত তিন মাসেই দু’বার Psychiatric চেক আপ হয়ে গেছে।
মেয়ের পাশে বসে, তার চুলে হাত বুলিয়ে, মাথার তালুতে চুমু খেয়ে আদর জড়ানো গলায় শান্তা প্রশ্ন করেন, “ঘুমাওনি মামণি?” মেয়ে নিরুত্তর। দেখতে না পেলেও বেশ বোঝেন, মেয়ের ঠোঁটের কোণা দুটো মুচড়ে নীচের দিকে নেমে গেছে, নাকের আকৃতি বদলাচ্ছে, চোখের পাতা ঘন ঘন নাড়ছে, বাষ্প জমে গলার আওয়াজ আটকে গেছে। এত্তো আবেগপ্রবণ মেয়েটা! এর ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই শান্তার মনে আতঙ্ক আর বিষাদ ভর করে। পিউ এর গালে হাত রাখতেই আর্দ্রতা টের পান শান্তা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়ের কানের কাছে মুখ এনে খুব ছোট্ট করে বলেন, “সরি!” প্রতিক্রিয়ায় হিতে বিপরীত! এবার পিউ হঠাৎ বিচ্ছিরি “ভ্যাঁ” শব্দে কেঁদে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে। বিরক্ত লাগলেও, তক্ষুণি কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নেন শান্তা। মেয়েকে আস্তে আস্তে বুকের মধ্যে আরও নিবিড় করে নেন। এইধরণের স্নেহান্ধতা মেয়ের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে – বুঝেও ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দিতে থাকেন। আর ছ’মাস পরেই পিউকে National Kids Care Centre এ ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। তখন সপ্তায় মাত্র একদিন মা-কে কাছে পাবে পিউ। “খুব ভুগবে মেয়েটা” – দুঃশ্চিন্তা কাটেনা শান্তার।
হঠাৎ জানালায় আলর হোলি খেলে যায়। অদ্ভুত সুন্দর সুরের মূর্ছনা সর্বত্র। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে পিউ। অভিমান-কান্নার মেঘ কেটে গিয়ে এখন তার মুখ জুড়ে খিলখিলে হাসির রোদ্দূর।
“Light and sound!” পিউর রিনরিনে আওয়াজে উপচে পড়া খুশি। বিছানা থেকে টুক করে নেমে জানালার কিনারা ঘেঁষে দাঁড়ায়। তার পেছনে তার মা। চিরচেনা ম্যাড়ম্যাড়ে পৃথিবীটাই যেন হয়ে উঠেছে বর্ণিল হলোগ্রাফিক স্ক্রীন। নীচে বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণী, Laser-light সম্বলিত পোষাকে, রেড ওয়াইন আর স্কচ ছিটিয়ে, মেতে উঠেছে উদ্দাম আনন্দে। ঘড়ির কাঁটা বারো’র ঘর পেরুতেই এখানে উপস্থিত হয়েছে ঐতিহাসিক একটা দিন – ১৬ই ডিসেম্বর!
“আজ 16th December?” কচি কন্ঠের কৌতুহলী প্রশ্ন।
“হুঁম!” শান্তার আঙ্গুল পিউর ফিনফিনে চুলে বিলি কাটতে থাকে।
“16th December এ কি হয়?”
মেয়েটা কিচ্ছু মনে রাখতে পারেনা! আগেও কতবার তাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন শান্তা।
“আজ সে almost 150 years আগে, এই দিনে, আমাদের দেশটা স্বাধীন হয়।”
“স্বাধীন কি?”
“Freedom, Independence।”
“কাঁহা সে freedom হয়?”
“পাকিস্তান সে।”
“পাকিস্তান? What’s that?”
“Today যেটা পাক-রিপাবলিক, আগে ওটারই নাম ছিল পাকিস্তান”।
“ও! পাক-রিপাবলিক? ওদের আগে different name ছিল কেন?”
“জানিনা মম!”
“Freedom হয় কেন?”
“Cause, আগে ওরা আমাদের দেশে ছিল। ওরা আমাদের খুব torture করত। আমাদের all belongings snatch করত। তাই আমরা ওদের থেকে separate হয়ে যাই।”
“পাক-রিপাবলিকরা খুব খারাপ?”
“না মা, they’re very good. Long ago, ওরা খারাপ ছিল, but now ওরা খুব ভাল।”
শেষের কথাগুলো শান্তা বলেন বাধ্য হয়ে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে। আজকের কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত একান্নবর্তী বিশ্বে লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম বা জাতিসত্ত্বার ধুয়ো তুলে কোন ব্যক্তিবিশেষ বা মানবসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিষোদগীরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যান্ত্রিকতা-সর্বস্ব জীবনে খানিকটা আদিম উল্লাসের ঠাঁই দেবার শুধু উৎসবের উপলক্ষ্য হিসেবে এই ব্যাপারগুলো এখনও টিকে আছে। মানব সম্প্রদায়কে একান্নবর্তী করে রাখতে না পারলে কর্পোরেটদের মার্কেট যে সংকুচিত হয়ে যেতে পারে!
আগামীকাল একটা সীমীত জনগোষ্ঠী “লিবারাল এস্পেসো” উপভোগ করবে। অর্থাৎ, আগামীকাল তাদের সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, অফিস-কারখানা নিয়মিত সময়ের দুই ঘন্টা আগে ছুটি হবে। “বিজয় দিবস” উপলক্ষ্যে দুই ঘন্টার ছুটি!
“মম, আগে আমাদের দেশের নাম কি ছিল?” প্রায় আধঘন্টা পর বিছানায় শুয়ে পিউর প্রশ্ন ফের শুরু।
“বাংলাদেশ।”
“বা-ং-লা-দে-শ? Why?”
“তখন সব্বাই যে বাংলায় কথা বলত!”
“আবভি তো সবাই বাংলায় বলে!”
“এখন, মানে আবভি যেটা বলে, সেটা হল Modified বাংলা, not original Bangla।” উত্তরটা দিয়েই শান্তার মনে হল, কথাগুলো একটু বেশী জটিল হয়ে যাচ্ছে।
“Modified কেন?”
শান্তা উত্তর হাতড়ে বেড়ান। উৎসুক পিউ তার মায়ের পানে চেয়ে থাকে উত্তরের জন্য।
“Tell না মাম্মি, Modified কেন?”
“Don’ know!” হাল ছেড়ে দেয়া দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে উত্তরটায়।
“পাকরা আগে এখানে ছিল?” শিশুরা যেটায় আগ্রহ পায়, সেটায় সহজে হাল ছাড়েনা।
“হুঁ”।
“আমাদের বক্সে?”
“1971 এ, almost 150 years আগে, such box ছিলনা, তাব সবাই home এ থাকত।”
“তুমিও home এ থাকতে?”
“নাহ! But আমার grampa, মানে তোমার great grampa home এ থাকত। Then তোমার grampa, মানে আমার ড্যা, ফ্ল্যাটে থাকত। তাব এক massive disaster হয়। Then, for safety আমরা বক্সে shift করি। ঐ disaster এর পর, air oxygen এত low হয়ে যায়, আর কেউই free air এ ... ... ...”
“Disaster কা story জানি, মাম্মা!” পিউ একটু বিরক্ত! কিভাবে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে মানুষের অস্তিত্বের জন্য ভয়াবহ রকমের বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল, এবং মানুষ কিভাবে সেখান থেকে রক্ষা পেয়েছে, সেটা মোটামুটি চর্বিত-চর্বণ আকারে শিশুদের মন-মগজে নিখুঁতভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে। আজকের পৃথিবীতে শিশুরা বিশ্বনাগরিক হিসেবে, এবং বিশ্বজুড়ে শিশুদের পাঠ্য ইতিহাস বলতে গেলে প্রায় একই – ‘The Great Disaster’ ।
“ঔক্কে বাবা, now sleep!”
কিন্তু পিউ’র চাহিদা তখনও অপূর্ণ। কোন একটা গল্প পেলে, সেটাকে ঘিরে কল্পনার বহুবর্ণময় বিন্যাস সাজাতে সাজাতে ঘুমিয়ে পড়ায় অভ্যস্ত পিউ তখনো মায়ের চোখের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে। চোখের ভাষা বুঝেই বেশ বিরক্ত হন শান্তা। আর একঘন্টা পরই পিয়েরো আসবে, তার সাথে আজ “ECSTACY”র মিডনাইট পার্টিতে যাওয়ার কথা। আর এখন মেয়েকে বসে বসে শোনাও রূপকথার গল্প! “কেন যে ছাই বাচ্চাদের সাড়ে তিন বছরের আগে কীডস কেয়ারে ভর্তি করানো যায় না!” – মনের ভাবনা এবং ভাব চেপে গিয়ে মেয়েকে প্রশ্ন করেন, “কোন Tale শুনবে?”
“16th December tale”
“Long ago, একটা দেশ ছিল ... ... ... ...” শান্তার গল্প শুরু হয়। খানিকটা নিজের দাদুর মুখ থেকে শোনা, খানিকটা নিজের কল্পনা মিশিয়ে বলতে থাকেন শান্তা। এর কতটুকু সত্যি, তা তাঁর নিজেরই সঠিক জানা নেই। আজকাল প্রায়ই, বিশেষত এই দিনে, একটা বিষয় নিয়ে বেশ তর্ক বাধে। একদল মানুষ দাবি করে, Freedom fight বলে ইতিহাসে কিছু নেই। আসলে, ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশীয় ব্লকের কিছুসংখ্যক জনগোষ্ঠী, কিছু ভূখন্ডের দখল নেয়ার জন্য ভিন্ন এক জনগোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় – ১৬ই ডিসেম্বরে ঐ জনগোষ্ঠী সাময়িকভাবে বিজয়লাভ করে। তবে এই ঘটনার সাথে জাতিসত্ত্বা সংক্রান্ত কোন কিছুর যোগ নেই। এটা ছিল স্রেফ ভূমি দখলের লড়াইয়ে এক পক্ষের বিজয়োৎসব। যুদ্ধে বিজয়ী হবার পর তারা ঐ ভূমিখন্ডের ভোগ দখলের জন্য নিজেদের মধ্যেই হানাহানিতে লিপ্ত হয় এবং মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই নিজেদের গোত্রের নেতৃস্থানীয় অনেককে নিজেরাই হত্যা করে। এসবের সাথে পাক রিপাবলিকের নাম জড়ানোর একটাই কারন, বিশ্বজুড়ে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে তাদের পণ্যের বাজার ধ্বংস করা।
শান্তা বরাবরই এদের প্রতিপক্ষের দলে। এই দলের লোকজন এখনও বিশ্বাস করে, বর্তমানের Zonas Bengle আসলে, ঐ great disaster এ নিজের শতকরা ৬০ ভাগ ভূমি সমুদ্রগর্ভে খোয়ানোর আগে, ছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, একটি স্বতন্ত্র জাতির একটি স্বাধীন দেশ, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীন সত্ত্বা! ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়া একটি ক্ষণজন্মা রাষ্ট্র। শান্তার দাদু প্রায়ই ক্ষোভের সাথে বলতেন, প্রতি পাঁচ বছর পরপর যে জাতির ইতিহাসের খোলস আর রঙ পাল্টায়, তার অস্তিত্বের সংকট কখনো কাটেনা। দাদুর কথাগুলো শান্তা শুনেছেন তাঁর বাবার মুখে, দাদুর আক্ষেপ-আশংকা অনেকাংশে সত্য হবার পর। শান্তার বাবা “মৌলিক বাংলা”র চর্চা করতে গিয়ে সিংহভাগ বাঙ্গালীর কাছে শুধু ব্রাত্যই হননি, পরিণত হয়েছিলেন মোটামুটি একটা গোঁড়া প্রাচীনপন্থী ভাঁড়ে। অতটা লড়াকু শান্তা হতে পারেননি, অতটুকু সাহসও তাঁর নেই। এবং তাঁর মত আরও অনেকেই ধীরে ধীরে সাহস হারাচ্ছেন, আস্থা হারাচ্ছেন নিজের ওপর, হাল ছেড়ে দিচ্ছেন গতানুগতিকতার প্রচন্ড স্রোতের তোড়ে। প্রতিটি প্রজন্ম ক্রমান্বয়ে সময়ের দাবীর সাথে একটু একটু করে আপোষ করতে করতে, শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে – ভাবতে পারেন না শান্তা।
ঘুমন্ত পিউ এর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য তাঁর বুকটা মুচড়ে ওঠে। আত্মপরিচয়ের অহংকারের যে ক্ষীয়মাণ, ন্যূনতম, তবুও আঁচটুকু শান্তা পেয়েছেন, পিউরা কি সেটাও পাবে না?