ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান বুঝি নৈঃশব্দেরই জয়ধ্বনি। ঝিরঝিরে বাতাসের অবহেলে ছুঁয়ে যাওয়ার আনন্দে নাচতে থাকা নারকেল পাতায় পিছলে পড়া প্রবল জোছনা ধূসর মাটিতে বিছিয়ে দেয় নিশ্চুপ রূপোলী আঁচল। রাতজাগা কিছু বোকা মানুষ স্বপ্নাতুর হাত বাড়িয়ে দেয় ঐ আলোর পানে, আর দু’হাত ভরে শূন্যতা যখন ফিরে আসে, স্বপ্ন-বাস্তবতার ভঙ্গুর সীমারেখা তখন ক্রমদোদুল্যমানতার আত্মদহনকে আরও উসকে দেয়। সম্ভব অসম্ভবের সমাধানহীন সমীকরণে মন তখন পথভ্রষ্ট মুমূর্ষু যাযাবর। আগামী-কেন্দ্রিক স্বপ্নশূন্যতার তাড়া খেয়ে কল্পনাকাংখী মানুষের তখন স্মৃতির চেনা গলি ঘুপচিতে সন্ধানী টহল – যদি কিছু জোটে, যার অনুসিদ্ধান্তে ভর করে সমুখগামী ভাবনারা নৈরাশ্যের অন্ধকার দেয়ালটা টপকে যেতে পারে! এত আলোর মাঝেও তাই বাদলের একটুখানি আলোর জন্য হাঁসফাঁস।
মোবাইলে জমে থাকা পুরোনো এস এম এস-গুলো যেন টাইম মেশিন! স্মৃতির মত ভয়ানক শত্রু আর প্রগাঢ়তম বন্ধু মানুষের দ্বিতীয়টি নেই। সেদিনের সেই কিছুতেই ফুরোতে না চাওয়া আড্ডা, সেই গনগনে শ্লোগানের উত্তাপ, সেই তর্কযুদ্ধে দেশোদ্ধার, রক্তের মাঝে মিসিসিপি, একটা মানুষের মাঝেই একটা আস্ত নতুন পৃথিবীর আবাদ, সেইসব শুরু না হতেই ফুরিয়ে যাওয়া সময়খন্ডগুলোতে আজকের কক্ষচ্যুত বাদল খুঁজতে থাকে আশ্রয়, জীবনের ন্যূনতম নির্যাস, যার আলোয় চারপাশের চেপে ধরা আঁধারটার সাথে লড়াই করা চলে।
ইন্টার্ণী হোস্টেলের ছাদে ঘোর লাগা বাদলের ব্রাউনীয় চারণ। সময় স্রোতে উল্টো সাঁতার থমকে দাঁড়ায় একটা এস এম এস-এ এসে –
I don’t insist to be
Beside u
Behind u
Around u
Surround u
I just wana be
WITH YOU !
ঠাকুমা’র ঝুলি থেকে হঠাৎ বেরিয়ে পড়া রূপকথা নয়, সত্যিই একদিন মৌসুমী এমনতরো শব্দপুঞ্জে মুহুর্তগুলোকে জোনাক-আচ্ছন্ন করে রাখত। বন্ধুবৃত্তে বিখ্যাত ‘বলদ শর্মা’ তার গোপনে পাওয়া “উল্কা” নামটাকে নিয়েই নিভৃতে ঝিনুক হয়েছিল। স্মৃতির সেলুলয়েডে অতীতের হাইলাইটস – রোমন্থনের সুখ-সাঁতারে বাদল ক্ষণিকের জন্য হলেও বর্তমান বেদনার বেষ্টনী থেকে ফস্কে বেরিয়ে আসে।
“একটা মানুষ কোথাও নাই! দুনিয়াটা এত্তো ফাঁকা!” রোমন্থনের শেষে, সুখস্মৃতিরাই সবচে’ নৃশংস পিশাচ। সব কল্পনারই সমাপ্তি আছে, সমাপ্তি নেই শুধু শূন্যতার। ক্ষণিক বিরতির পর যখন সে ফেরে, ফেরে সে অনেক বেশী ক্ষ্যাপাটে হয়ে। “কারও সাথে যদি একটু কথা বলা যাইত! কারে করা যায় ফোন?” বাদলের অস্থিরতা গুণোত্তর হারে বাড়ে। পার্থর মিলিয়ে যাওয়া কথাগুলো আবার কান ফাটানো চেঁচামেচি শুরু করে, “এক নম্বরীর শুধু নম্বরটাই আছে, দুই নম্বরীর ভোগে আস্ত পৃথিবী!”
“আমার গায়ে যদি ময়লা লাগে, সেটা আমাকেই পরিষ্কার করতে হবে; আকাশ থেকে কেউ নেমে আসবে না সেটা সাফ করার জন্য। রাজনীতির ব্যাপারটাও তেমনি। একে নোংরা বলে তুমি এর কাছ থেকে যত দূরে ভাগতে চাইবে, সে ততই তোমার আড়েপিঠে লেপ্টে যাবে। তুমি চাও বা না চাও, তুমি, আমি, আমরা সবাই, এটারই অংশীভূত। এ কথা অস্বীকার করার মানে হল, রাস্তার ওপর ন্যাংটো হেঁটে দু’চোখ বুঁজে ভাবা, আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। একে বাদ যখন দিতে পারবনা, চলো, একে তাহলে বদলেই ফেলি!” বড়ভাই কাম নেতার সেইসব কথামালায় একদিন আপ্লুত হয়েছিল বাদল, ধরাশয়ী হয়েছিল তার সর্বস্ব চিন্তাশক্তি। বদলে যাবার, বদলে দেবার স্বপ্ন-আফিঙে তখন সে এবং আরও অনেকেই নেশায় চুরচুর। রক্তকণায় স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল শেকল ভাঙার সুতীব্র সংকল্পে। প্রাচীন মানেই তখন অর্বাচীন, দ্বিধা মানেই কাপুরুষতার অযাচিত বহিঃপ্রকাশ, প্রশ্ন মানেই পিছুটান। শুধু পার্থ, গল্পচ্ছলেই, প্রশ্নহীন আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠাত। বাদল তখন বাগ্মী, “শ্যাওলা জমা মড়া নদীতে স্রোতের তোড়েই প্রাণ ফিরতে পারে। একটা বিশেষ লক্ষ্যে চলতে শুরু করলে, আনুগত্য প্রশ্নহীন হওয়াটাই বাঞ্চনীয়। নয়তো প্রশ্নের পাঁকে পাঁকে স্রোতটাই মারা পড়ে।”
পার্থ বেশ বুঝত, কথাগুলো বাদলের নয়, তার গ্রে ম্যাটারে চেপে বসা শরীফ ভাইয়ের। অনুসারীদের চিন্তাশক্তি পর্যন্ত কব্জা করার বিরল প্রতিভা ছিল তাঁর। “লক্ষ্যটা কি?” তবুও থামত না পার্থ।
- “পরিবর্তন। একটা আগাগোড়া পরিবর্তন। এই ঘুণে ধরা ব্যবস্থাটাকে গুঁড়িয়ে দেয়া।”
- “কমন ডায়লগ! আচ্ছা, ভাঙার পর কি করবি? অ্যাব্স্ট্র্যাক্ট ছেড়ে, ম্যাটেরিয়ালিস্টিক বল।”
- “আচ্ছা, তুই যেখানে আছিস, যেভাবে আছিস, সেটা নিয়ে কি তুই খুশী? স্যাটিসফাইড?”
- “না।” একটু ভেবে পার্থর উত্তর।
- “তুই চেঞ্জ চাস না?”
- “চাই।”
- “কি রকম?”
- “এই যেমন, আমার বাবা মা আরও লিবারাল হবে, আমি কিছু বলার আগেই ওরা বলবে, বেটা, বহু লে কে আ … … … !”
- “ধূস শালা!”
এরপর দুজনের হাসিতে হুটোপুটি।
“এক নম্বরীর শুধু নম্বরটাই আছে ... ...”
‘পার্থ’ যেন থামতেই চাইছেনা। পুরনো একটা ক্ষত আজ আবার গা-ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে। ব্যর্থতা হল আবেগ-সওয়ারী মানুষের গায়ে বিছুটি পাতা। মনোজাগতিক অস্থিরতায় ফের চঞ্চল বাদলের পা দু’টো। হল দখল, ছাত্র ভর্তি কিম্বা টেলিথ্রেটে পরীক্ষা পাশ-ফেল, টেন্ডারবাজী – এসব পাল্টে দেয়া কি সত্যিই খুব অসম্ভব ছিল? পরিবর্তনের ইচ্ছেটা ত সবার মধ্যেই ছিল। জেগেও উঠেছিল অনেকগুলো বুঁজে থাকা চোখ। স্রোত একটা সত্যিই সৃষ্টি হয়েছিল – যার শতভাগ কৃতিত্ব শরীফ ভাইয়ের না হলেও, সুফলটা শতভাগ তাঁরই পকেটে গ্যাছে। ‘পরিবর্তন’ – হল শুধু ছাত্রসংসদের সদস্যদের নেমপ্লেট। সাফল্যের সাথে সাথে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা একগাদা সরীসৃপ হিসহিস করতে করতে পেঁচিয়ে ধরে মসনদ; বিস্মিত, ব্যাথাতুর চোখে সবাই দেখে - হাকিম নড়েছে শুধু, হুকুম নড়েনি। ভাঙনের সেই থেকে শুরু। তারপরও হাল ছাড়েনি বাদল। ভেবেছিল, শরীফ ভাইয়ের মত নিজেই আরেকটা ঢেউয়ের জন্ম দেবে। সেটায় বরং উল্টো লাভই হয় শরীফের। একটা ফোঁসফোঁস করতে থাকা নির্বিষ সাপের ভয় দেখিয়ে অবাধ্য শিশুকে যেমন গুটিয়ে রাখা যায়, বাদলকে তড়পাতড়পির ছোট্ট একটা মঞ্চ দিয়ে নিজ অনুসারীদের অন্তর্কোন্দলের সমূহ সম্ভাবনাকে সুদূর পরাহত করে সেই সুবিধেটাই ষোলকলা আদায় করে নেয় শরীফ। সমস্যা অথবা প্রতিপক্ষ ছাড়া, একগুচ্ছ মানুষকে একত্রিত রাখা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
চারপাশের বাতিগুলো যখন নিভে আসছিল, অজস্র ভুল বোঝাবুঝি আর ভ্রূকুটির নির্মম চাপে বাদল যখন নিজের ওপর, নিজের সমস্ত আইডিয়োলজীর ওপরই বিশ্বাস হারাতে বসেছিল, তখনও কিছু হতচ্ছাড়া তার সঙ্গছাড়া হয়নি। আইনের ছাত্র পার্থ, বি বি এ পড়ুয়া অনন্যা, বায়োটেকের নীপু – আফসোস যে এদের কারুরই ঐ রঙ্গমঞ্চে প্রবেশাধিকার ছিলনা, শুধু সহপাঠী মৌসুমী ছাড়া। কি অদ্ভুত ছিল সময়গুলো তখন! বাদলের যে গোঁয়ার্তুমীর জন্য দিনরাত মৌসুমীর সাথে ঝগড়াঝাটি, সেই একগুঁয়েমীকেই বুকের গভীরে আত্ন-অহংকারের ভিত্তিমূল বানিয়ে বাদলের হয়ে পুরো পৃথিবীর মুখে ঝামা ঘষে দিতে বিন্দুমাত্র শংকিত বা সংকুচিত হত না মেয়েটা। কিন্তু বাদলও ‘অনির্বাণ’ না, মৌসুমীও ‘মাধবীলতা’ না, আর জীবন-বাস্তবতাও “কালবেলা-কালপুরুষ” এর ছক মেনে চলে না। সুতরাং, সময়ের পলি জমতে জমতে শিলা হয়েছে, শিলার স্তর জমে হয়েছে দেয়াল, আর সেই দেয়ালটাই বেয়াড়াভাবে দাঁড়িয়ে গেছে পদ্মা-গঙ্গার মাঝে ফারাক্কা হয়ে।
“সুমীকে আরেকবার ট্রাই করব?” এই প্রশ্নের মুখোমুখি অভিমান আর অভিলাসের টানাপোড়নে টলতে টলতে ক্লান্ত বাদল নেমে আসে নিজের রুমটায়। ঘুমে কাদা রুমমেটের নির্ঘুম মোবাইলে তখন বেজে চলেছে অঞ্জন দত্ত –
“আমি অনেক হেরে গিয়েও
হারটা স্বীকার করি নি,
শুধু তোমায় হারাব
আমি স্বপ্নেও ভাবি নি ... ...”
(চলবে)