“মানুষ কেমন করে এত প্রেমের কবিতা লেখে ?
কেমন করে এত ছন্দ উপমা সাজিয়ে গান গায় ?
শব্দের পৃথিবীতে হাত বাড়ালেই দেখি সব এলোমেলো,
যেন কোন সমাগত প্রায় ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে
তারা প্রাণপণে এলোপাথাড়ি ছুটছে ।
শব্দে শব্দে এত বিদ্বেষ – কেমন করে তাদের দিয়ে নৈবেদ্য সাজাই ?
বৃষ্টিতে যখন চারপাশের সবুজ স্নান করে পবিত্র হয়ে ওঠে,
ঠান্ডা বাতাস যখন বিনবিন করে চুলে বিলি কাটে,
তখনও কেন শব্দরা পোড়াকাঠ-গন্ধমাখা শ্মশান-অন্ধকারে
চুপিসারে গা ঢাকা দেয় ?
কেন পারি না লিখতে
চাঁদ-জোছনা-মেঘ-বৃষ্টিমাখা একটা কোমল কবিতা ?
জীবনের গতির প্রচন্ডতা কি
এমনই করে ছিটকে দেবে
তার সবুজ সত্ত্বাকে, ক্রমশ ?”
রাতজাগা প্রহরগুলো এলোপাথাড়ি লিখে বেশ খানিকটা পার করে দেয়া যায়। ঘুম চটে গেছে পার্থর, “কইন্যা, আমার ঘুমের বারোটা বাজায়া তুমিই দেখি হাপিস মারসো!” নীপুর ফোন হঠাৎ কেটে যাওয়ার পর, কিছুক্ষণ বুভুক্ষুর মত গ্রীল আঁকড়ে জোছনা গিলেছিল পার্থ, তারপর এইসব, তার ভাষায়, “কাগজ-কালি অপচয়ের মচ্ছব” – যদিও ‘মচ্ছব’ শব্দটার যথার্থতা নিয়ে সে নিজেই সন্দিহান। নীপুর ফোন আসার আগেও পুর্ণেন্দুপত্রীতে ডুবে ছিল। এমনিতে তার রাতঘুমের কোন সমস্যা নেই; কিন্তু যখন ‘স্যাডিজম’ পেয়ে বসে, তখন, হাল্কা ভল্যুমে সামিনা চৌধুরী, শব্দোত্তর শুভঙ্কর-নন্দিনী, অলসতম ঘড়ির কাঁটা, আর সময়ের কোন দগদগে বৃত্তে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকা … … … ।
“কার জন্য লিখি এত ছাইপাশ?” আবার শুরু দ্বৈরথ।
“লেখক তো লেখে নিজের খেয়ালেই, নিজেরই তাগিদে, কারো ‘জন্য’ তো সে লেখে না!”
“ওটাই তো মুশকিল! আমি যে লেখক নই, আমার লিখতে গেলে তাই একটা ‘জন্য’ লাগেই।”
“নীপুর জন্য নয়?”
“ধূর! ও একটা আস্ত রামগর্দভ! মানে, রামগর্দভী! গর্দভী না গর্দভা? যা-ই হোক, কচু-ঘেচু একটা কিছু বানিয়ে বললে বা লিখলেই ওই মহিলা মুগ্ধতার ঠেলায় চিৎপটাং! অবশ্য এ-ও হতে পারে, ওর মুগ্ধতাটা পুরোপুরি অভিনয়, হয়তো আসলে এটা একধরণের টেকনিক্যাল তোয়াজ।”
“তোমাকে তোয়াজ করার কি আছে?”
“হয়তো আমিও তার Time pass, অথবা Fill in the blanks, যেমনটা সে আমার! স্রেফ কথা আর কবিতার প্রশংসা দিয়ে একটা ব্যাচেলর ছেলেকে পরকীয়া সম্পর্কের জন্য বগলদাবা করে রাখা গেলে, মন্দ কি?”
“গলাবাজী করিস না! তুই কি শুধু কবিতা ঘেরা মুগ্ধতার টানে যাস?”
“জ্বী না স্যার। ওইটা তো বোনাস! প্রেমের কাব্যময়তা নিয়ে যে ফ্যান্টাসীটা অপূর্ণ ছিল, উপরি পাওনা হিসেবে সেটা তো লোভনীয়ই। যেটার টানে আমি কমান্ডো সৈনিক, ওই একই বস্তুর টানেই তো দূর্গম দূর্গের জানালা দিয়ে রাজকন্যা কেশবতীর কেশ-রজ্জুর হাতছানি! মাহফুজ ভাই নর্মাল হলে, শুধু মন ভোলানো কথার জন্য? – আমার কোন চান্সই ছিল না।”
“তুই একটা ঠগ!”
“মোটেই না! ওই যে বললাম, শূন্যস্থান পূরণ; আসলে প্রেম-ফ্রেম কিচ্ছু না, স্রেফ cover up। মৌসুমীর গানটার মত – মেঝেতে অনেক গর্ত, গর্ত বোজার সঙ্গতি নেই, তাই ওপরে দামী কার্পেটের আচ্ছাদন।”
“বিকল্প ছিল না?”
“হয়তো ছিল। But this is chosen. Every ‘today’ we chose our path, every ‘tomorrow’ we regret for it.”
“পাপিষ্ঠ!”
“জ্বী জাঁহাপনা! এই একটা কথার জবাব নেই আমার কাছে।”
পার্থ নিজেও জানেনা, কিম্বা তার সচেতন মন কখনো স্বীকার করে না, এইসব তার আত্মরক্ষার কৌশল মাত্র। সত্যি সত্যি নীপুকে ভালো না বেসে ফেলার, অথবা ঐ ভালবাসাটাকে একটা বিরাট সত্য হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়তে দেখার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে, আরও ঠিক করে বললে, পালিয়ে বাঁচতে, এভাবেই নিয়ত নীপুকে, তার সাথে সেঁটে থাকা মূহুর্তগুলোকে অপমানের আর অপব্যাখ্যার নোংরা নর্দম-জলে স্নান করিয়ে যাওয়া। নীপুতে নিমজ্জিত হওয়ার চেয়ে নিজেকে একটা পাপিষ্ঠ পারভার্ট হিসেবে দেখা পার্থর জন্য অনেক বেশী সহনীয়। পার্থ নীপুকে ঘৃণা করে না, নীপুর প্রেমে ‘পড়ে যাওয়া’টাকে, হয়তো ঘৃণা, এবং হয়তো কিছুটা ভয় করে। ঘর পোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
*** *** *** ***
“আরি! ডাক্তারদের মোবাইলেই বিনা নোটিশে মিডনাইট কল আসে জানি, এখন তুই নিজে ডাক্তার হয়ে আমার মত সাইকোরে কল দিলি! ঘটনা কি?”
“ডাক্তার হওয়া এখনো পুরা হয় নাই, ইন্টার্ণী শেষ হোক, তারপর।”
“নামের আগে তো এখন থেকেই তো ডি আর ডট লিখিস!”
“আজাইরা প্যাচাল তোর মুখে সবসময় রেডী থাকে?”
“আচ্ছা, আজাইরা কথায় ব্যাজার হইসনা। কি কইতে চাস, ক।”
“মন মেজাজ খারাপ। কাউরে কঠিন পেইন দিতে মন চাইসে ... ...”
“ওই ব্যাটা বলদ শর্মা! আমি তোরে পেইন দিবার লাইসেন্স কবে দিসি?”
বিপ্রতীপ শর্মা বাদল, পার্থর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। ‘বলদ শর্মা’ তার বন্ধুজাগতিক নাম। স্কুল থেকে কলেজতক একসাথে আসার পর রাস্তাবদল হয়েছে শুধু, আর কিছুই বদলায়নি।
“সুমী ফোন ধরেনা!” বাদল জানে, পার্থর সাথে তর্কে জড়ানোর মত বেহুদা বেওকুফী দ্বিতীয়টি নেই, তাই ভূমিকা টপকে সোজাসুজি প্রসঙ্গে।
একটা গা-জ্বালা করা বিচ্ছিরি খ্যাক খ্যাক হাসির পর পার্থর গলায় রাজ্যের আমোদ ঝরে পড়ে, “তোদের টম এন্ড জেরী ফের শুরু? তা এইবার জেরী ক্ষ্যাপলো ক্যান?”
“বুঝতেসি না। এক সপ্তা ধরে ঠিকমত কথা বলে না। রাতে মাঝেমধ্যে ফোন ধরলেও দায়সারা কথা বলে। গতকাল থেকে টোট্যালী অফ মারসে!” বাদল প্রাণপণে চেষ্টা করে কথার সাথে মিশে থাকা ব্যাথার স্বরটাকে কষে এ্যাম্প্লিফাই করতে। ফল হয় উল্টো, সেটা পার্থর সুড়সুড়ি বাড়িয়ে দেয় – আরেক দফা কুচ্ছিত খ্যাক খ্যাক হাসি!
“ভালোই তো! এই চান্সে তুই অন্যখানে ট্রাই মার। দ্যাখ কোন পেশেন্টের সুন্দরী ভাগ্নী জোটাইতে পারসনি!”
শব্দের চেয়ে নৈঃশব্দে বেদনারা বেশী বাঙ্ময়। ওপাশের নীরবতা পার্থর প্রগলভতার রাশ টেনে ধরে।
“মৌসুমী তো মাঝেমধ্যেই চটলে এইরাম করে। এতো টেনশন নিস না!”
“কি জানি! এখন ওর হাবভাব কেমন জানি লাগে!”
“কেমন লাগে?”
“বুঝি না!”
“আচ্ছা ঠিক আসে, কইতে না চাইলে কইসনা।”
আবার চুপচাপ। বাদল প্রাণপণে হাতড়েও কথা খুঁজে পায় না। যখনই একটা কথা দাঁড়ায়, ঐ খ্যাঁকানো হাসির রেশ সেটাকে নিমেষেই গুঁড়িয়ে দেয়। আশৈশব বন্ধুর কাছে নিজের সীমাহীন অপমানও, শুধু সহনীয় নয়, ক্ষেত্রবিশেষে আনন্দময়ও হতে পারে; কিন্তু কিছু কিছু নির্বোধ আবেগ সামান্যতম অমনোযোগেই অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে মুখের ওপর কুলুপ এঁটে দেয়। যে কোন কথাই পার্থর ঠাট্টার নির্দয় শিকার হবার আশঙ্কায় মস্তিষ্কের এদিক থেকে সেদিকে ছুটে বেড়ায়, কিছুতেই বাগযন্ত্রের ধারে কাছেও যায় না।
এসব স্যাঁতস্যাঁতে, ন্যাতানো প্রেম-পুরাণের ওপর পার্থর চরম বিরক্তি। কিন্তু বাদলের শব্দশূন্যতাকে, আর তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়া তার অসহায়ত্ব আর দিশেহারাত্বকে উপহাসের তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিতে পার্থর মন পুরোপুরি সায় দেয় না। কিছু একটা বলা দরকার। মোবাইলে মৌনব্রত পালনের কোন মানে হয় না। “ব্যাটা জেনুইন বলদ” গালিটাকে চেপে বাদলকে বলে, “তোদের এরকম ঝগড়া তো কম হয় নাই। আমরা সবাই এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেসি। বরং তোদের ঝগড়া না হলেই মনে হইত সামথিং রঙ। মাগার, এখন ঘটনা কি দোস্ত?”
“ওর এম. এস. পার্ট ওয়ান হই গেসে।”
“তো? এইটা তো পুরানা খবর!”
“তারপর থেকেই সব উল্টাপাল্টা। আসলে ফেল্টুসদের জন্য প্রেম নাই।”
“এইটা অবশ্য হক কথা। তোর ক্লাসমেট হইয়া তোর গার্লফ্রেন্ড পার্ট ওয়ান কইরা ফালাইলো, তুই এখনো ইণ্টার্ণী, মানে নাবালক ডাক্তার। সে তোরে কিক করলে, সেইটা হবে ষোল আনার উপ্রে বত্রিশ আনা লজিক্যাল শট।”
“তুইও এইরাম ক’বি?”
“তো কি কইতাম? সে কদ্দিন বইসা থাকবো? বরং এক কাম কর, ল্যাং খাওয়ার আগেই রাস্তা চেঞ্জ কর।”
বাদলের গলায় একটু একটু আনুনাসিক্য এসে ভর করতে শুরু করে, “আমি পিছাই গেসি, ক্যান, সেইটা তোর থিকা ভালো আর কে জানে?”
“জানি দোস্ত, কিন্তু এখন দ্যাখ, পলিটিক্স তোর পুটকিটা কেমন মাইরা দিল। লস শুধু তিনটা বছর না, গোটা লাইফটাই!”
“তুই খালি পলিটিক্সটাই দেখলি? আমি তো ... ...”
কথাটা বাদল কেন সম্পূর্ণ করতে পারেনা, টের পেয়ে, পার্থ এবার সুরে খানিকটা কোমলতাকে প্রশ্রয় দেয়। “জানি, তুই চেঞ্জ চাইসিলি, অনেক বড় একটা শেপের খোলনলচে পাল্টাইতে চাইসিলি। তোর উদ্দেশ্য যে মহৎ ছিল, এইটা নিয়া কোন আর্গুমেন্ট নাই। কিন্তু, ঐ যে তোকে বলসিলাম, এক নম্বরীর জন্য শুধু নম্বরটাই আছে, দুই নম্বরীর ভোগে আস্ত পৃথিবী ... ... ... ... ...”
ফোন কেটে গেছে।
“balad sharma” নামটা , স্ক্রীন থেকে মুছে যাওয়া পর্যন্ত, পার্থর চাউনীকে স্থির ধরে রাখে। মোবাইলের আলো নেভার সাথে সাথে, জড়বৎ পার্থর কাছে, হঠাৎ পৃথিবীটা বড্ড অন্ধকার মনে হয়।
(চলবে)