“ভাত খেয়ে নাও ... ... ”
“পেস্ট আর সাবান প্রায় শেষ ... ... ”
“আমি শুয়ে পড়লাম ... ... ” –
রাত আটটা থেকে সাড়ে বারটা অবধি, এই হল নীপু-মাহফুজের সাকুল্যে কথোপকথন ।
প্রথম দুটি নীপুর, শেষেরটি মাহফুজের ।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, ওদের ভাষায় “উথাল-পাথাল প্রেম” এর সফল পরিণতি বিয়ে – তার মাত্র ন’মাস পরের, এই হল জীবনাবয়ব । বিয়ের আগে, এদের কাছ থেকে ( এবং সম্ভবত এদের মত আরও অজস্র কপোত-কপোতীর কাছ থেকেও ) মোবাইল নেটওয়র্ক কোম্পানীগুলো, তাদের কলরেটের জন্য, কিম্বা মাঝে মাঝে সিগন্যাল ডাউন থাকার জন্য, কতবার যে নতুন নতুন পিতৃ, মাতৃ এবং গোষ্ঠী পরিচয় লাভ করেছে, তার ইয়ত্তা নেই । তখন এত কথার যোগান কে দিত ? রাত জেগে বারান্দায় পায়চারী করতে থাকা নীপু, না চাইলেও ক্ষণে ক্ষণে চতুর্থ মাত্রার উল্টোদিকে পিছলে যাচ্ছিল ।
নীপু ইনসমনিক । সমস্যাটা স্কুল জীবন থেকে । মাত্র একটা বছর আগেও রাতগুলো এমন নিঃসঙ্গ ছিল না । অভিশপ্ত ইনসমনিয়াও তখন রাতের স্পেশাল রেটের কল্যাণে অনবদ্য আশীর্বাদ । যে মানুষটার কারণে তখন মধ্যরাতেও সূর্যোদয় হত, অন্ধকার আকাশে দেখা মিলত রামধনুর, সে-ই এখন কুম্ভকর্ণের একনিষ্ঠ অনুসারী । আর এদিকে, প্রতিটি রাত, রাতের প্রতিটি প্রহর, ক্রমাগত বিছানা-বালিশ, ক্রমাগত জগ-গ্লাস-পানি, হেডফোনে বহুশ্রুত গান, পুরো ঘরে নিঃশব্দ পায়চারী, কখনো দরজা, কখনো টেবিল, কখনো বারান্দায় ঝোলানো পোশাকের সাথে কথা বলা, কিম্বা প্রলাপ বকা ... ... ... ... । টুটি চেপে ধরা নৈঃশব্দ থেকে বাঁচতে, কখনো হঠাৎ অস্থির হয়ে রান্নাঘরে সশব্দে এবং সজোরে হাঁড়ি-পাতিল সব এদিক থেকে ওদিকে, আবার ওদিক থেকে এদিকে ... ... ... । হাঁড়িতে ফুটতে থাকা তরলের ওপরকার ঢাকনার মত কেমন একটা কাঁপুনি সারা শরীরে । ইচ্ছে করে পাগলের মত চীৎকার করতে করতে, দিকচিহ্নহীনভাবে ছুটতে ছুটতে রাতকে, নৈঃশব্দকে, এবং এদের সবার রেণু রেণুতে মিশে থাকা ভয়বহ একাকীত্বকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফালাফালা করে দিতে । যেন অনন্তকাল ধরে এমন এক নিঃসঙ্গ দ্বীপে বসে শুধু ঢেউ গোণা, না উদ্ধার, না মৃত্যু – কেউই যে দ্বীপের ঠিকানা জানেনা !
আগে খুঁচিয়ে, গুঁতো মেরে, খামচি কেটে, চুল টেনে, চুমু খেয়ে, সুড়সুড়ি দিয়ে মাহফুজকে জাগিয়ে দিত নীপু । হাসি – বিরক্তি – ঝগড়া – ঝাড়ি – সময়ের আবর্তনে বিবর্তিত হয় প্রতিক্রিয়াও, যার সমাপ্তিসূচক চিহ্নটি সশব্দে নীপুর গালে প্রতিষ্ঠিত করতে মাহফুজকে কোন কুন্ঠা-দ্বিধার বৈতরণী পেরুতে হয়েছে বলে মনে হয়না নীপুর । ঐটুকু পর্যন্ত হলেও হয়ত, আরও অনেক নির্বিবাদী নিরুপায় নারীর মত নীপু খাপ খাইয়ে নিত । কিন্তু এ নিয়ে যখন নিজের এবং মাহফুজের বাবা-মায়ের হিতোপদেশ আরোপিত হতে আরম্ভ করে, ঠিক তখনই মাহফুজের প্রতি নীপুর শ্রদ্ধাবোধ ভাটির টানে ভেসে যেতে থাকে । ভালবাসার সবচে’ বড় অবলম্বন পারষ্পরিক শ্রদ্ধা – ঐটে ছাড়া যাবতীয় প্রেম ভালবাসা মঞ্চে দাঁড়ানো সার্কাসের কিংকর্তব্যবিমূঢ় সং এর মত উৎকট ! নীপু ভেবে পায় না, একজন পুরুষ কতটা ব্যক্তিত্বহীন হলে তার রাত-ঘুম ব্যাঘাতের জন্য নিজের বাবা-মা এবং শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছে নিজের বউ এর বিরুদ্ধে নালিশ করতে পারে !
ওই চোরা ফাটল দিয়েই আবারো সচল হয় মোবাইল ফোন – অন্যপ্রান্তে তখন পার্থ ।
পার্থ নির্ঘুম, পার্থ নিরলস, পার্থ কখনো না ফুরনো কথার ফুলঝুড়ি, পার্থ অফুরান অর্ঘ্য হাতে অকম্প্র পূজারী । কোন নারী স্তব শুনতে ভালবাসেনা ? সেসব কাঙ্খিত শব্দগুলো, কথাগুলো যখন অজুত নিযুত ধারায় চারপাশটা ঘিরে রাখে, তার স্রোতের তোড়ে তৃষ্ণার্ত মনটাকে না ভাসিয়ে কাঁহাতক পারা যায়? সুতরাং নীপু ভেসেছে, ভাসিয়েছে নিজেকে, ভেসে যাওয়ার মধ্যেই আশ্রয় খুঁজেছে । পার্থ আর নীপুর শুরুটা ছিল এভাবেই – কথার ভেলায় চড়ে । যদিও নীপুর চিরকালই নিশ্চিত ধারণা ছিল এবং আছে, আজ পার্থ যদি মাহফুজের জায়গায় থাকত, তাহলে সে-ও একটা সময় এসে ঔদাসীন্য দেখাতে কার্পণ্য করতনা । মানুষের ধর্মই এই । অপ্রাপ্ত কিম্বা অপ্রাপ্যের জন্যই তার যত আরাধনা ।
নীপুর হাতে মোবাইল ।
পার্থ ভালবাসা, নাকি আশ্রয় ? – এই প্রশ্নের মীমাংসা নীপু কখনো পুরোপুরি করতে পারেনা । নিজেকে কখনো জানায়, ও একটা আশ্রয়, যেখানে ভালবাসা কিম্বা তার কিছু ডেলিকেট ডুপ্লিকেট পাওয়া যায় । আবার তাতেও মন পুরোপুরি সায় দেয় না । কখনো সখনো নিজের ওপর ঘেন্না ধরে, নিজেকে ধিক্কার দেয়, “পরকীয়া ! ছিঃ !” উদভ্রান্তি কাটেনা । পার্থ’র প্রশ্নটা মনে ধরেছিল, “ Fill in the blanks ?” কিন্তু “হ্যাঁ” বলার সাহসটুকু নিজের ভেতর থেকে যুগিয়ে উঠতে পারেনি ।
“জানতাম, তুমি না এলেও, তোমার আওয়াজ আমায় ঠিকই খুঁজে নেবে ... ... ” ওপাশ থেকে পার্থ । এভাবেই বলে সে । যেন অনন্তকাল ধরে বলে যাওয়ার কথা-ধারাবাহিকতা । “ঘুমাও নি ?” নীপুর মুখে মুচকি হাসি । কেটে যাচ্ছে ধূসর ধূলিঝড়, রোদেলা বৃষ্টির উজ্জ্বল উষ্ণ ছাঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গ !
অনেকদিন পর, অনেক অনেকদিন পর, একটি রাত, যে রাত গড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে নিদ্রাদেবীর আঁতুড়ঘর থেকে । নীপুর জন্য, কখনো অনিচ্ছাসত্ত্বেও, প্রচন্ড ঘুমচোখে পুরো রাত – কম জাগেনি মাহফুজ ; কিন্তু বিছানায় শুয়ে এমন নির্ঘুম রাত ! জমে থাকা ক্ষোভ-অভিমান সবকিছু ছাপিয়ে একটা বিষন্ন প্রশ্ন গলায় আর চোখে অদ্ভুত শক্তিতে চেপে বসেছে – “এমন কেন হল ?” অশ্রুর অস্তিত্ব টের পেতেই, হঠাৎ কি হয়, মাহফুজের অন্য একটা সত্ত্বা – তিল তিল করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সযত্নে গড়া ‘পৌরুষ’ সত্ত্বা সিংহবিক্রমে জেগে ওঠে । “তোর বউ রাতভর পরপুরুষের সাথে চ্যাটাং-চ্যাটাং করে , আর তুই বেটা হিজড়া, কাইন্দা বালিশ ভিজাস” – নিজের ওপর ধিক্কার, ঘৃণা, অপমানের আচমকা কশাঘাতে হিত এবং অহিত – সবকটা জ্ঞানই হারিয়ে বসে মাহফুজ । সম্মোহিতের মত, অনেকটা ঘোরের মধ্যে, বেড়াল-পায়ে নীপুর পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় । খোলা বারান্দায়, প্রচন্ড জোছনা এলোচুলে মেখে, পাতাবাহার গাছের পাতায় আদুরে স্পর্শ বোলাতে বোলাতে, মুখজুড়ে হাল্কা হাসির অভ্র-আলো, আধবোজা স্বপ্নাতুর চোখ নিয়ে নীপু তখন রাত্রি জাগরণের আনন্দে বিভোর ।
প্রথম থাবা ... ...
মুঠোফোনে মাহফুজের চোখ, পর মুহুর্তে মেঝেতে বিশ্লেষিত যন্ত্র !
দ্বিতীয় থাবা ... ...
নীপুর চুলের গোছা ...
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ নীপুর মহাশূন্য ভ্রমণ, অতঃপর দরজার কাঠে মাথা ঠোকাঠুকি, এবং হঠাৎ সব অন্ধকার !
চেতনা হারাবার আগ মূহুর্তে তার কবিতা আপ্লুত কান দুটো দিয়ে, ফাটল ধরা বাঁধ চিরে বন্যার পানির মত, পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে এগোন জঙ্গী মিছিলের মত, হুড়হুড় করে করে ঢুকে পড়ছিল বীভৎসতম খিস্তি-খেউড়গুলো, সমগ্র দেহ দিয়ে অনুভব করছিল অগুণতি কিল-ঘুঁষি-লাথি-চড় – তার নির্বীর্য স্বামীর ‘হঠাৎ পৌরুষ”খচিত স্বামীত্ব !
এখন, নায়িকার অচেতন নিথর দেহ জড়িয়ে ধরে ফিল্মী নায়কের মত, মাহফুজ ডুকরে কেঁদে উঠতে পারত । কিন্তু বাস্তবতার সেলুলয়েডে ভিন্ন ছবি । মাহফুজের কান্না পাচ্ছে না । ধপ করে সোফায় বসা মাহফুজ নিজের সারা শরীরের লাগামছাড়া কাঁপুনি টের পায় । নীপু নিঃসাড় পড়ে আছে । বারান্দার দরজা দিয়ে তার ওপর জোছনার আলোয়ান চেপে আছে । এলোমেলো চুল, কিছুটা রক্তাক্ত, আর বেশ কিছুটা ফুলে ওঠা মুখ, থেবড়ে পড়ে থাকা দেহ আর ছড়িয়ে থাকা হাত পা – এই নীপুকে দেখে মাহফুজের ভেতর কোন অনুভূতি কাজ করে না । না রাগ, না ঘৃণা, না ভয়, না ভালবাসা, না দুঃখ, না অপরাধবোধ – বোধশূন্য দৃষ্টি আটকে থাকে ঐ জড়বৎ অস্তিত্বটাতে । চোখের ওপর যে একটা পলক আছে এবং সেটা যে ফেলা যায়, এইটে, বেশ দেরীতে হলেও, মাহফুজের মস্তিষ্ক সম্পাদন করে ।
কিছুক্ষণ ঝিম ধরে, মাথা নীচু করে সোফাটায় বসে থাকে মাহফুজ । তারপর হঠাৎ আবার তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে, যেরকম গনগনে ঘোরের মধ্যে একটু আগে নীপুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেইরকম ঘোরের মধ্যেই, শরীরের অবাধ্য কাঁপুনি সইতে সইতে, একটু টালমাটাল পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোয় মাহফুজ । এরপর অকস্মাৎ পাশবিক একটা চীৎকার করে দরজার পাশে রাখা ওয়স্ট বাস্কেটে ঝেড়ে লাথি কষায় । প্লাস্টিকের খালি বাস্কেটটা দু’টো দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে আবার মাহফুজের পায়ের কাছে কাৎ হয়ে পড়ে । ফিল্মের শেষ দৃশ্যে নায়ক যেমন প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে বিশ বছর আগে তার বাবা মায়ের হত্যাকারী ভিলেনকে পেটাতে থাকে, অনেকটা সেরকম বিজাতীয় ঘৃণা নিয়ে সমস্ত শক্তিতে তার সমস্ত রাগ দিয়ে ঐ নিরীহ বস্তুটাকে পায়ের তলা দিয়ে দাবড়াতে দাবড়াতে ভেঙ্গে-চুরে-দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে । এরপর মাহফুজ ছাদের দিকে তাকিয়ে, ওপরের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে, থুতু ছিটিয়ে, দু’চোখের বন্দীদের বাঁধন শিথিল করে দিয়ে, গলার শিরা ফুলিয়ে অবিশ্রান্ত বকতে শুরু করে – ঈশ্বরকে অশ্রাব্য অভিশাপে জর্জরিত করে তোলে ।
সব ঘোরেরই একটা সমাপ্তি আছে । ঝড় থেমে যাওয়ার পর প্রকৃতি যেমন অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে ওঠে, তেমনি ঘোর কাটা মানুষও নিমজ্জিত হয় সীমাহীন শ্রান্তিতে । মাঝেতে কুঁকড়ে বসে মাহফুজ কয়েকবার নিজের চুল টেনে ধরে সজোরে মাথার পেছন দিয়ে দেয়ালে আঘাত করে । ব্যাথার অনুভব যখন ঘোরের চেয়ে তীব্র হয়ে ওঠে, তখন ক্লান্তির কাছে আত্মসমর্পন করে সে । জড়পাটকি হয়ে রান্নাঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে । পৌরুষের জৌলুস এখন তার চেতনার ত্রি-সীমানাতেও নেই ; তাই কান্নারা কুন্ঠাহীনভাবে বেরিয়ে আসতে থাকে ।
(চলবে)