ধোঁয়া ছাড়ার সময় হঠাৎই হাসি পেয়ে যায় পার্থর – শুভঙ্করের একটা কথা মনে পড়ায় । শুভঙ্কর , পূর্ণেন্দুপত্রীর লেখা “কথোপকথন” উপন্যাসে , নন্দিনীকে বলেছিল ,
“যে মানুষ প্রশ্নে দীর্ণ নয়
প্রশ্নে হত্যা হয়নি যে ঘুমে ,
বরমাল্য তাকেই পরিও ।”
“তাইলে যে মানুষ প্রশ্নের ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে , তার গলায় কি জুটবে ? কুরবানীর মালা ?” কিছুক্ষণ আপনমনে হাসার পর চোখ পাতে সি এন জি’র দু’পাশে ছুটন্ত শহরে । আলো-অন্ধকার , দালান-দোকান , পথ-ফুটপাথ ধাঁ করে করে ছুটছে । চিরচেনা পথের দুটো পাশ – সহস্রবার দেখার পরও তাদের ছোটখাট ডিটেলস নিয়ে এক্কেবারে নতুনের জেল্লা নিয়ে হাজির । তেলছবি , জলছবির মত এ হল জীবনের ‘ছুটছবি’ – দৃষ্টিসীমার এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্তই শুধু বর্তমান , সামনে আর পেছনে ভবিষ্যৎ আর অতীত - দুটোই অন্ধকার ; ফারাক স্রেফ – একটা অদেখা , আরেকটা বিস্মৃত (অথবা বিস্মরণের ভোগের জন্য বরাদ্দকৃত) ।
-“কোথায় যাও ?”
-“যাচ্ছি যে কত না , তার আবার হেথায়-কোথায় ! স্থাণু তো হয়ে নেই !”
-“ব্রাউনীয় ?”
-“হবে হয়তো সেরকম কিছু !”
-“তাহলে দিনের শেষে ? নচিকেতা যদি গেয়ে ওঠে- ‘অনেক চলার শেষে দেখলাম শুরু থেকে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি !’ তখন ?”
-“হতেই পারে ! জীবনটাই তো একটা বৃত্ত । চোখের সামনে যেটা সরলরেখার মত সোজা পথ , সেটাও তো আসলে অনেক বড় বৃত্তের ছোট্ট একটা অংশ ।”
-“তারপর ?”
-“তার আর পর নেই , আছে শুধু পৌনপুণিক । মানুষ তার সব স্মৃতিকে সতেজ রাখতে পারেনা । তাই একই বৃত্তে ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়েও তার কাছে প্রতিনিয়ত অনেক কিছুই নতুন ঠেকে ।”
-“এইভাবে যাওয়া কিম্বা চলাটা কি খুব জরুরী ?”
-“কি জানি ! হয়তো হ্যাঁ , হয়তো না । অত ভেবে কি লাভ ? হয়তো ঠিক না , হয়তো ভুল , হয়তো পরে পস্তাতে হবে । ঠিক কাজ করে পস্তানোর চে’ ভুল কাজ করে পস্তানোতে কষ্ট কম ।”
-“মানে পস্তাবই যখন , ভুলটা উপভোগ করেই পস্তাই । তাই না ?”
-“হুঁ ! নরকে যখন যাবই , ষড়দেবতার পূজোটা সাড়ম্বরেই করি !”
-“শালা , তুই একটা অমানুষ !”
-“মানুষের সংজ্ঞাটা যে কি , সেটাই তো এখনো স্থির হয়নি !”
মনোজাগতিক যে দ্বৈরথ নীপুকে অস্থির করে, সেই দ্বৈরথটাই পার্থ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে । একসময় প্রশ্নকর্তা খুব শক্তিশালী ছিল । প্রশ্ন-ঝড়ে তাকে একেবারে ছ্যাড়াব্যাড়া করে ছেড়ে দিত । কিন্তু যখন থেকে পার্থ নিজের আয়নায় নিজেকে শুদ্ধতম সিদ্ধপুরুষ হিসেবে দেখার বাসনা বিসর্জন দিয়েছে , তখন থেকেই জেরাকারীর হাতে জেরবার হওয়া থেকে মুক্তি মিলেছে ।
গান-না-শেখা মানুষ যখন হঠাৎ আপনমনে গাইতে শুরু করে , আসলে তখন সে তার মনের ভেতর গাইতে থাকা গায়ক / গায়িকার সাথে গলা মেলায় , আর মেলায় গানের সাথে অনুভব । পার্থ এখন তা-ই করছে । সামিনা চৌধুরীর সাথে গুনগুনিয়ে গাইছে ,
“মনে কি পড়েনা , স্মৃতির ফুলগুলো , সোনালী সুতোয় বোনা হারানো সে দিন ,
মনে কি পড়েনা , রোদেলা সুখে , দু’জনে ছিলাম কত কাছাকাছি ... ...”
নিজের ওপর শারীরিক নির্যাতন করে সুখ পেতে থাকা মানুষেরাই স্যাডিস্ট হিসেবে ডকুমেন্টেড । অথচ নিজের মনের ’পরে চাবুক চালানোর আসক্তিটাও যে একধরণের স্যাডিজম , তা কিন্তু ডকুমেন্টেড করা মুশকিল ; করা গেলে হয়তো দেখা যেত , পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষই নথিভুক্ত হয়ে বসে আছে , যার একজন হত এই পার্থ । এই গান , ঐ চাবুকেরই একটা অংশ ।
*** *** *** ****
“পৃথীবিতে এমন কোন মানুষ আছে , যার কাছে নিজ ঘরে ফেরা এতোটাই তেতো ?” চাবি ঘোরানোর সময় ক্লান্ত মাহফুজের কপালে তীব্র ভাঁজ । এতটাই ক্লান্ত যে , রাগ করবার জোরটুকুনও খুঁজে পাচ্ছেনা । সারাদিন অফিসে একটানা একঘেঁয়ে অভিনয়ের পর , বাসায় আরেক মঞ্চ প্রস্তুত ! কিছু ক্লাউন নাকি আছে , লাগাতার রঙ মাখতে মাখতে , মুখের আসল রংটাই ভুলতে বসে । আর কত অভিনয় , আর কত ভাণ ধরলে পরে মিথ্যেরা , লুকোচুরিরা নিজেকে নিয়ে ক্লান্ত হবে ?
মানুষের অন্তর্গত ভাঙনের কতটুকু তার চেহারায় ভেসে ওঠে কে জানে ! মাহফুজের দোমড়ানো-মোচড়ানো মুখছবিটা দেখে নীপু প্রশ্ন করে , “শরীর খারাপ ?” আওয়াজে আন্তরিকতার ছাপটা বড় অস্বাভাবিক স্পষ্টতা নিয়ে হামলে পড়ে মাহফুজের কানে । এই হৃদ্যতাটুকুন অপ্রত্যাশিত , যাকে বলে পড়ে পাওয়া – তাই সেটা শান্তি দেয়ার বদলে ক্লান্তি আর ক্ষোভের বোঝার ওপর চেপে বসে থাকা সন্দেহের প্যাটরাটাকে আরও ভারী করে তোলে । এইরকম আন্তরিকতা , যেটা স্বর্গীয় হয়ে উঠতে পারত , নরক যন্ত্রণার চেয়েও বীভৎস , যখন তার উৎসরণ ভালবাসা না হয়ে , হয় অপরাধ কিম্বা অপরাধবোধ গোরস্থ করবার তাগিদ । মনের ভেতর সন্দেহের অ্যানাকোন্ডা অনুভবের চোখটা গিলে না ফেললে মাহফুজ , হোক সত্য বা মিথ্যা , তবু একটু ভালোলাগায় ভিজে উঠতে পারত – কপালে রাখা নীপুর ঠান্ডা হাত যে অতটা অনান্তরিক ছিলনা – সেটুক ঠাউরে নিতে পেরে । অথচ , ঐটুকুন স্পর্শের জন্যই আজকাল চাতক হয়ে থাকতে হয় , বিয়ের এক বছর পূর্ণ না হতেই ! আর আজ যখন মেঘের পলেস্তরা দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে এক চিলতে জোছনাও ঠাস বুনোটের ভীড়ে কোন এক চোরাগলিতে লুটিয়ে পড়তে বসেছে , তখন , একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস চেপে মাহফুজ নিজেকে নীপুর কাছ থেকে সরিয়ে ফেলে । “অফিসে ঝামেলা বেশী ছিল” উত্তরটা বাচ্চাদের ভুলিয়ে রাখার ললিপপ যেন । খুব ইচ্ছে করছিল তার বলতে , রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে , সভ্যতা-ভব্যতা ভুলে গিয়ে , নীপুর ওপর পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে , তাকে এলোপাথাড়ী চাবকে-চাপড়ে-থাপড়ে রক্তাক্ত করে চীৎকার করে বলতে , “হারামজাদী ! দিনভর নাগর নিয়া লটর-ফটর কইরা একখন সতীপনা চুদাস ... ...” !!!
আজ সবকিছুই ক্লেদাক্ত । আজ সবকিছুই বিষাক্ত । ঘরে ফেরার পথে যখন গলির ভেতর ঢোকার মুখে মাহফুজের সি এন জি , তখন থেকেই তার গলায় যেন কাঁটাতাঁরের ফাঁস চেপে বসেছে । যে সন্দেহের অস্তিত্ব নিয়েই মাহফুজ এতদিন সন্দিহান ছিল , গত কয়েকদিনের আবহ , এবং সর্বোপরি ওই মুহুর্তটি , তার কাছে প্রবলভাবে সেটারই অস্তিত্বের জানান দিয়ে যায় ।
দেখেছিল , উল্টোদিক থেকে পার্থ , তাকে ঠিক খেয়াল করেনি , ঐ গলি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ।
(চলবে)