somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পারভার্ট – ২

২৬ শে নভেম্বর, ২০১০ সকাল ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধোঁয়া ছাড়ার সময় হঠাৎই হাসি পেয়ে যায় পার্থর – শুভঙ্করের একটা কথা মনে পড়ায় । শুভঙ্কর , পূর্ণেন্দুপত্রীর লেখা “কথোপকথন” উপন্যাসে , নন্দিনীকে বলেছিল ,
“যে মানুষ প্রশ্নে দীর্ণ নয়
প্রশ্নে হত্যা হয়নি যে ঘুমে ,
বরমাল্য তাকেই পরিও ।”
“তাইলে যে মানুষ প্রশ্নের ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে , তার গলায় কি জুটবে ? কুরবানীর মালা ?” কিছুক্ষণ আপনমনে হাসার পর চোখ পাতে সি এন জি’র দু’পাশে ছুটন্ত শহরে । আলো-অন্ধকার , দালান-দোকান , পথ-ফুটপাথ ধাঁ করে করে ছুটছে । চিরচেনা পথের দুটো পাশ – সহস্রবার দেখার পরও তাদের ছোটখাট ডিটেলস নিয়ে এক্কেবারে নতুনের জেল্লা নিয়ে হাজির । তেলছবি , জলছবির মত এ হল জীবনের ‘ছুটছবি’ – দৃষ্টিসীমার এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্তই শুধু বর্তমান , সামনে আর পেছনে ভবিষ্যৎ আর অতীত - দুটোই অন্ধকার ; ফারাক স্রেফ – একটা অদেখা , আরেকটা বিস্মৃত (অথবা বিস্মরণের ভোগের জন্য বরাদ্দকৃত) ।

-“কোথায় যাও ?”
-“যাচ্ছি যে কত না , তার আবার হেথায়-কোথায় ! স্থাণু তো হয়ে নেই !”
-“ব্রাউনীয় ?”
-“হবে হয়তো সেরকম কিছু !”
-“তাহলে দিনের শেষে ? নচিকেতা যদি গেয়ে ওঠে- ‘অনেক চলার শেষে দেখলাম শুরু থেকে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি !’ তখন ?”
-“হতেই পারে ! জীবনটাই তো একটা বৃত্ত । চোখের সামনে যেটা সরলরেখার মত সোজা পথ , সেটাও তো আসলে অনেক বড় বৃত্তের ছোট্ট একটা অংশ ।”
-“তারপর ?”
-“তার আর পর নেই , আছে শুধু পৌনপুণিক । মানুষ তার সব স্মৃতিকে সতেজ রাখতে পারেনা । তাই একই বৃত্তে ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়েও তার কাছে প্রতিনিয়ত অনেক কিছুই নতুন ঠেকে ।”
-“এইভাবে যাওয়া কিম্বা চলাটা কি খুব জরুরী ?”
-“কি জানি ! হয়তো হ্যাঁ , হয়তো না । অত ভেবে কি লাভ ? হয়তো ঠিক না , হয়তো ভুল , হয়তো পরে পস্তাতে হবে । ঠিক কাজ করে পস্তানোর চে’ ভুল কাজ করে পস্তানোতে কষ্ট কম ।”
-“মানে পস্তাবই যখন , ভুলটা উপভোগ করেই পস্তাই । তাই না ?”
-“হুঁ ! নরকে যখন যাবই , ষড়দেবতার পূজোটা সাড়ম্বরেই করি !”
-“শালা , তুই একটা অমানুষ !”
-“মানুষের সংজ্ঞাটা যে কি , সেটাই তো এখনো স্থির হয়নি !”

মনোজাগতিক যে দ্বৈরথ নীপুকে অস্থির করে, সেই দ্বৈরথটাই পার্থ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে । একসময় প্রশ্নকর্তা খুব শক্তিশালী ছিল । প্রশ্ন-ঝড়ে তাকে একেবারে ছ্যাড়াব্যাড়া করে ছেড়ে দিত । কিন্তু যখন থেকে পার্থ নিজের আয়নায় নিজেকে শুদ্ধতম সিদ্ধপুরুষ হিসেবে দেখার বাসনা বিসর্জন দিয়েছে , তখন থেকেই জেরাকারীর হাতে জেরবার হওয়া থেকে মুক্তি মিলেছে ।

গান-না-শেখা মানুষ যখন হঠাৎ আপনমনে গাইতে শুরু করে , আসলে তখন সে তার মনের ভেতর গাইতে থাকা গায়ক / গায়িকার সাথে গলা মেলায় , আর মেলায় গানের সাথে অনুভব । পার্থ এখন তা-ই করছে । সামিনা চৌধুরীর সাথে গুনগুনিয়ে গাইছে ,
“মনে কি পড়েনা , স্মৃতির ফুলগুলো , সোনালী সুতোয় বোনা হারানো সে দিন ,
মনে কি পড়েনা , রোদেলা সুখে , দু’জনে ছিলাম কত কাছাকাছি ... ...”

নিজের ওপর শারীরিক নির্যাতন করে সুখ পেতে থাকা মানুষেরাই স্যাডিস্ট হিসেবে ডকুমেন্টেড । অথচ নিজের মনের ’পরে চাবুক চালানোর আসক্তিটাও যে একধরণের স্যাডিজম , তা কিন্তু ডকুমেন্টেড করা মুশকিল ; করা গেলে হয়তো দেখা যেত , পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষই নথিভুক্ত হয়ে বসে আছে , যার একজন হত এই পার্থ । এই গান , ঐ চাবুকেরই একটা অংশ ।

*** *** *** ****

“পৃথীবিতে এমন কোন মানুষ আছে , যার কাছে নিজ ঘরে ফেরা এতোটাই তেতো ?” চাবি ঘোরানোর সময় ক্লান্ত মাহফুজের কপালে তীব্র ভাঁজ । এতটাই ক্লান্ত যে , রাগ করবার জোরটুকুনও খুঁজে পাচ্ছেনা । সারাদিন অফিসে একটানা একঘেঁয়ে অভিনয়ের পর , বাসায় আরেক মঞ্চ প্রস্তুত ! কিছু ক্লাউন নাকি আছে , লাগাতার রঙ মাখতে মাখতে , মুখের আসল রংটাই ভুলতে বসে । আর কত অভিনয় , আর কত ভাণ ধরলে পরে মিথ্যেরা , লুকোচুরিরা নিজেকে নিয়ে ক্লান্ত হবে ?

মানুষের অন্তর্গত ভাঙনের কতটুকু তার চেহারায় ভেসে ওঠে কে জানে ! মাহফুজের দোমড়ানো-মোচড়ানো মুখছবিটা দেখে নীপু প্রশ্ন করে , “শরীর খারাপ ?” আওয়াজে আন্তরিকতার ছাপটা বড় অস্বাভাবিক স্পষ্টতা নিয়ে হামলে পড়ে মাহফুজের কানে । এই হৃদ্যতাটুকুন অপ্রত্যাশিত , যাকে বলে পড়ে পাওয়া – তাই সেটা শান্তি দেয়ার বদলে ক্লান্তি আর ক্ষোভের বোঝার ওপর চেপে বসে থাকা সন্দেহের প্যাটরাটাকে আরও ভারী করে তোলে । এইরকম আন্তরিকতা , যেটা স্বর্গীয় হয়ে উঠতে পারত , নরক যন্ত্রণার চেয়েও বীভৎস , যখন তার উৎসরণ ভালবাসা না হয়ে , হয় অপরাধ কিম্বা অপরাধবোধ গোরস্থ করবার তাগিদ । মনের ভেতর সন্দেহের অ্যানাকোন্ডা অনুভবের চোখটা গিলে না ফেললে মাহফুজ , হোক সত্য বা মিথ্যা , তবু একটু ভালোলাগায় ভিজে উঠতে পারত – কপালে রাখা নীপুর ঠান্ডা হাত যে অতটা অনান্তরিক ছিলনা – সেটুক ঠাউরে নিতে পেরে । অথচ , ঐটুকুন স্পর্শের জন্যই আজকাল চাতক হয়ে থাকতে হয় , বিয়ের এক বছর পূর্ণ না হতেই ! আর আজ যখন মেঘের পলেস্তরা দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে এক চিলতে জোছনাও ঠাস বুনোটের ভীড়ে কোন এক চোরাগলিতে লুটিয়ে পড়তে বসেছে , তখন , একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস চেপে মাহফুজ নিজেকে নীপুর কাছ থেকে সরিয়ে ফেলে । “অফিসে ঝামেলা বেশী ছিল” উত্তরটা বাচ্চাদের ভুলিয়ে রাখার ললিপপ যেন । খুব ইচ্ছে করছিল তার বলতে , রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে , সভ্যতা-ভব্যতা ভুলে গিয়ে , নীপুর ওপর পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে , তাকে এলোপাথাড়ী চাবকে-চাপড়ে-থাপড়ে রক্তাক্ত করে চীৎকার করে বলতে , “হারামজাদী ! দিনভর নাগর নিয়া লটর-ফটর কইরা একখন সতীপনা চুদাস ... ...” !!!

আজ সবকিছুই ক্লেদাক্ত । আজ সবকিছুই বিষাক্ত । ঘরে ফেরার পথে যখন গলির ভেতর ঢোকার মুখে মাহফুজের সি এন জি , তখন থেকেই তার গলায় যেন কাঁটাতাঁরের ফাঁস চেপে বসেছে । যে সন্দেহের অস্তিত্ব নিয়েই মাহফুজ এতদিন সন্দিহান ছিল , গত কয়েকদিনের আবহ , এবং সর্বোপরি ওই মুহুর্তটি , তার কাছে প্রবলভাবে সেটারই অস্তিত্বের জানান দিয়ে যায় ।

দেখেছিল , উল্টোদিক থেকে পার্থ , তাকে ঠিক খেয়াল করেনি , ঐ গলি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ।



(চলবে)
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×