ডিসি কিংবা মার্ভেল কমিকস মানে কেবলমাত্র সুপারহিরো নয়, সুপারহিরোর পাশাপাশি রয়েছে দুর্ধর্ষ সব সুপারভিলেইন। সুপারহিরো বলতে সবার আগেই উঠে আসে সুপারম্যান, ব্যাটম্যান কিংবা স্পাইডারম্যানের নাম। আর যদি আপনাকে টপ নটোরিয়াস ভিলেইনের একটি তালিকা করতে বলি তাহলে নিশ্চিতভাবে সবার আগে উঠে আসবে দ্যা ক্লাউন অফ প্রিন্স খ্যাত দ্যা জোকারের নামটি। কমিক পড়ুয়াদের মধ্যে জোকার যেমন জনপ্রিয়, সুপারহিরো ফ্র্যাঞ্চাইজি মুভি লাভারদের তালিকায়ও অবধারিতভাবে চলে আসে তার নাম। ডিসি কমিকসের এই আইকোনিক সুপারভিলেইনের জনপ্রিয়তা ছিলো একদম শুরু থেকেই। এখন প্রশ্ন হলো, অন্যান্য সুপারভিলেইনদের মতোন কোনো প্রকার সুপারপাওয়ার না থেকেও, স্রেফ রক্ত মাংসে গড়া এই জোকারের মাঝে কি এমন ছিলো যা তার গ্রহনযোগ্যতাকে এতোখানি আকাশসম করে তুলেছিলো? উত্তর হলো, দ্যা এমাউন্ট অফ ইনস্যানিটি। এই জোকার কখনো টাকা, ক্ষমতা, খ্যাতি এমনকি জীবনের পরোয়া করেনি। তার ভাবনাজুড়ে ছিলো কেবলই ব্যাটম্যান আর গথাম সিটি । জোকার বনাম ব্যাটম্যান পুরোটাই কেওটিক ম্যাডনেস বনাম মেথডোলজিক্যাল অর্গানাইজড ফাইটব্যাক। আর তাই মানুষজন এই পারষ্পরিক ডুয়েলের সম্পর্কটা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছে।
কমিকের মতোন সিনেমার ফিতায়ও জোকার ছিলো একটি অন্যরকম চরিত্র।টিম বার্টন যখন ১৯৮৯ সালে "ব্যাটম্যান" সিনেমাটি বানালেন, একটু ডার্ক আর ভায়োলেন্ট থীমের জন্য অল্প বিস্তর সমালোচিত হলেও সব মিলিয়ে সিনেমাটি বো্দ্ধাদের কাছে বেশ প্রশংসিত হয়েছিলো। তবে সব প্রশংসার মূলে ছিলো জ্যাক নিকলসনের জোকারের অসাধারণ চরিত্রায়ন। আমেরিকার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ভ্যারাইটি লিখেছিলো," জ্যাক নিকলসন স্টোল এভ্রি সিন।" শুধু তাই নয়, এই চরিত্রটি তাকে এনে দিয়েছিলো গোল্ডেন গ্লোবের মনোনয়ন। তবে জোকার চরিত্রটিকে অবধারিতভাবে সবচেয়ে আইকোনিক আর হিস্টোরিক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড়ো অবদান যার, তার নাম হিথ লেজার। ২০০৮ সালে এই সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের দ্যা ডার্ক নাইট সিনেমাটি আনুষ্ঠানিক মুক্তি পাওয়ার ছয় মাস আগে অ্যাক্সিডেন্টাল ড্রাগ ওভারডোজের কারণে মাত্র ২৮ বছর বয়সে মারা যান হিথ লেজার। সিনেমাটি মুক্তির পরপরই পুরো সিনেওয়ার্ল্ডে শোরগোল পড়ে যায়। বক্স অফিসে প্রথম সপ্তাহ থেকেই অভাবনীয় সাড়া ফেলে দ্যা ডার্ক নাইট। সিনেমার গল্প, ক্রিস্টোফার নোলানের অসাধারণ মেকিংকে ছাড়িয়ে সবখানেই ছড়িয়ে পড়ে জোকার চরিত্রে হিথ লেজারের অসামান্য এই আউট অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড লেভেলের পোট্রেয়াল। ফলশ্রুতিতে ব্যাপক ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি হিথ লেজার জিতে নেন অস্কার, বাফটা, গোল্ডেন গ্লোব সহ নামীদামি সব পুরষ্কার। দ্যা জোকার আর হিথ লেজার সিনেমার ইতিহাসে একই সাথে চরম আকর্ষণীয় আর চরম বেদনাভরা এক গল্পের নাম।
জোকার চরিত্রায়নের পিছনে হিথ লেজারের প্রস্তুতি, ডেডিকেশন আর গ্রাউন্ডওয়ার্ক ছিলো অবিশ্বাস্য। যেমন, শুরুতেই তিনি প্রায় এক মাসের জন্য একটি হোটেলরুমে নিজেকে আইসোলেটেড করে রেখেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিলো সমাজ থেকে নিজেকে একদম সরিয়ে নেওয়া। প্রিপারেশানের পাশাপাশি তিনি একটি ডায়েরি/জার্নাল তৈরি করেছিলেন, যেখানে তিনি নিজের হাতে অনেক এন্ট্রি লিখতেন। এছাড়া অনেক ছবিও তিনি সেইখানে সন্নিবেশ করেছিলেন। এন্ট্রিগুলো ছিলো মূলত জোকারের চিন্তা-ভাবনাকে ঘিরে। সেই হোটেল রুমে বসে, তিনি জোকার চরিত্রের জন্য প্রতিনিয়ত অনুশীলন করতেন। তিনি চাচ্ছিলেন জোকারের কন্ঠ, হাসি, অভিব্যাক্তিগুলো একটু অন্যরকম হোক, আইকোনিক হোক। অনুপ্রেরণা নিয়েছেন ব্যাটম্যান কমিকের অরিজিন জোকার স্টোরি দ্যা কিলিং জোক, আরখাম এসাইলাম,কুবরিকের মহান সৃষ্টি এ ক্লকওয়ার্ক অরেন্জ আর ব্রিটিশ মিউজিশিয়ান সিড ভিশিয়াসের মাঝে। হিথ লেজার জোকারকে দেখতেন পুরোমাত্রায় সোশিওপ্যাথ, কোল্ড ব্লাডেড মাস মার্ডারিং ক্লাউন হিসেবে। জোকার কি করবে, কি বলবে, তা কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখায় মাপা যাবে না। কোনোকিছুই তাকে ভয় দেখায় না, কোনো কিছুরই সে পরোয়া করে না, সব কিছু তার কাছে বিগ জোক ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এইসব প্রস্তুতির পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রথমবারের মতোন উঠে আসে হিথ লেজারকে নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারি "ঠু ইয়ং টু ডাই" এর মাধ্যমে। সেখানেই প্রথমবারের মতোন সেই ডায়েরিটি দেখানো হয়। যা দেখলে স্পষ্টত বোঝা যায়, কিভাবে ক্রমশ জোকার চরিত্রের সাথে লেজারের অ্যাটাচমেন্ট কিংবা আসক্তির মা্ত্রাটি বাড়ছিলো। ইতিহাসের জটিলতম এই চরিত্রের জন্য নিজেকে তৈরি করতে কি পরিমাণ সময় তিনি দিয়েছিলেন, তারও একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় তার সেই ডায়েরির প্রতিটি পাতা ঘাঁটলে। যেমন, এ ক্লকওয়ার্ক অরেন্জ এর সেই অ্যালেক্স চরিত্রটি থেকে অনুপ্রেরণা, যেটির সাজেশান দিয়েছিলেন পরিচালক স্বয়ং নিজেই। এছাড়া ছোটোবেলায় খেলার ছলে হিথ লেজারের বোন তাকে নার্সের মতোন করে সাজিয়ে দিতেন, যার সাথে ডার্ক নাইট সিনেমার সেই হসপিটাল রুমের দৃশ্যের একটা এক্সপ্লোরেশান করে নেন লেজার, সেটি নিয়ে হসপিটাল রুম নামে একটি এণ্ট্রিও ছিলো ডায়েরিতে । এছাড়া, সিনেমা শ্যুটের প্রায় আট মাস আগে জোকারের মেক-আপ টেস্টেরও একটি ছবি পাওয়া যায় সেইখানে। হিথ লেজার ডায়েরিটি শেষ করেছেন পেন্সিলে "বাই বাই" লিখে। ডায়েরির বিভিন্ন পাতায় তিনি কিছু ডায়ালগ লিখে রেখেছিলেন, যেমন, "It’s simple. Kill the Batman," কিংবা "Like my mother always told me, when you’re good at something don’t do it for free." এক জায়গায় লেখা ছিলো, "Things that make me laugh: blind babies, land mines, AIDS, beloved pets in bad road accidents, statistics, pencil cases, brunch, the periodic table of the elements."। জোকার চরিত্রটির উপর লেজার কি পরিমাণ পড়াশোনা করেছিলেন তার ডায়েরিটি ছিলো চাক্ষুস প্রমাণ। ধারণা করা হয় এই চরিত্রটির অনুশীলনের কিংবা প্রসেসের মাঝে যাওয়ার দরুণ বড়োসড়ো মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়ে তার উপর। যদিও ফরেনসিক রিপোর্টে তার মৃত্যুকে বলা হয়েছিলো দূর্ঘটনাবশত। কিন্তু অনেক ফ্যান ধারণা করে থাকেন, ঠু মাচ অবসেশনই হিথ লেজারের মৃত্যুর জন্য প্রভাবিত করেছিলো।
জোকার চরিত্রটির পিছনে লেজারের অভিনব প্রস্তুতির ঝলক দেখা যায় প্রোডাকশানের একদম শুরুতেই। জোকার আর ব্যাটম্যানর সেই ঐতিহাসিক দৃশ্যটির সিংহভাগই ছিলো ইম্প্রোভাইজড করা। আর সিকোয়েন্সের আবহ আনার জন্য ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি ওয়ালি ফিস্টার আর প্রডাকশান ডিজাইনার নাথান ক্রলি দিনরাত খেটে যাচ্ছিলেন। উজ্জ্বল আলোতে যেনো আরো পরিপূর্ণতা পায় তার জন্য ব্যাটস্যুটটি নতুন করে ডিজাইন করা হয়। এতো পরিকল্পনার পরও সবকিছু নির্ভর করছিলো, ব্যাটম্যান চরিত্রে ক্রিশ্চিয়ান বেল আর জোকার চরিত্রে হিথ লেজারের উপর। কারণ সবার সম্মতিতেই, তারা দুইজন এই দৃশ্যের রিহার্সাল খুব বেশিদূর করেন নি, তারা চাচ্ছিলেন, পুরো দৃশ্যে যেই ভয়াবহতা আর স্নায়ুর খেল দেখানো দরকার তা যেনো তাদের নিজেদের ভিতর থেকেই আসে। তাই ফাইটিং কোরিওগ্রাফি ছাড়া আর মোটামুটি সব কিছুই ইম্প্রোভাইজেশানের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন পরিচালক নোলান।
দৃশ্যটি ধারণ করার সময় যেই ভায়োলেন্সটি চাচ্ছিলেন নোলান, তারা দুইজন যেনো উজাড় করে তার থেকেও বেশি কিছু পরিচালকের হাতে তুলে দিলেন। দৃশ্যটির ফিজিক্যালিটি এতোটাই বাস্তবসম্মত হয়েছিলো পরিচালক সহ প্রোডাকশানের সবাই ভীষণরকম অবাক হয়ে যান। তবে নোলানকে ভীষণরকম মুগ্ধ করেছিলেন হিথ লেজার। জোকারের কন্ঠটি যখন নোলান প্রথম শুনেছিলেন, শীতল রক্তের স্রোত বয়ে গিয়েছিলো শীরদাঁড়া দিয়ে। বেশ ভয় পেয়েছিলেন তিনি, লেজারের কন্ঠ, হাত ও মুখের অভিব্যাক্তিগুলো ছিলো সারপ্রাইজ আফটার সারপ্রাইজ।
হিথ লেজারের এই অকালে চলে যাওয়াটা এতোটাই মর্মস্পর্শী আর বেদনাকর ছিলো এখনো সেই মৃত্যুকে অনেকেই মেনে নিতে চান না। অসম্ভব প্রতিভাবান এই অভিনেতা এই অল্প সময়ে নিজেকে যেই উচ্চ আসনে বসিয়েছিলেন, মানুষ আফসোস করে এই কারণেই, ভবিষ্যতে তিনি এই সিনেজগতকে না জানি আরো কতো কিছু উপহার দিতে পারতেন! এই জোকার চরিত্রের জন্য হিথ লেজার অমর হয়ে থাকবেন অনন্ত অসীম সময়কাল ধরে। যতোদিন সিনেমা তৈরি হবে, যতোদিন মানুষ সিনেমা দেখবে, মনের অজান্তে কোটি কোটি দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে উঠবে চারপাশের বাতাস।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:০৭