যেদিন থেকে প্রথম ট্রেইলার রিলিজ পেলো, সেদিন থেকেই অপেক্ষার পালা শুরু, কবে মুভিটি বের হবে, কবে ভালো প্রিন্ট আসবে, আর কবেই বা দেখা হবে।গতকালকেই ব্যাটম্যান ট্রিওলজির শেষ পার্ট দ্যা ডার্ক নাইট রাইজেসের ব্লু রে প্রিন্টটি হাতে পেলাম, ঝটপট ডাউনলোড করে আজকেই দেখে ফেললাম।এবং এইমাত্র দেখা শেষ করেই সামুতে দুই চার লাইন লিখতে বসলাম। এককথায় বলবো, অ সা ধা র ণ !!!! দুর্দান্ত ট্রিওলজির দুর্দান্ত একটা এন্ডিং হলো এ পর্বের মাধ্যমে।
মুভিটি যখন মুক্তি পেলো, অর্থাৎ জুলাই মাসের ২০ তারিখে, মুক্তির প্রথম মুহূর্তেই ঘটলো ভয়াবহ এক অঘটন, আমেরিকার ডেনভারের কলোরাডোতে অরোরা সিনেমাহলে মিডনাইট স্ক্রিনিংয়ের সময় একটি শ্যুটিং ইন্সিডেন্ট ঘটে, এবং জেমস হোমস নামের এক লোক গুলি করে ১২ জনকে মেরে ফেলে, এবং সেই ঘটনায় অন্তত ৫৯ জন আহত হয়েছিলো। সেই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য সেসময় ওপেনিং উইকের বক্স অফিস রেকর্ডটি সবার কাছে গোপন রাখা হয়েছিলো।তবে পরে জানা যায়, সেই চরম আতঙ্কগ্রস্থ সময় সত্ত্বেও ওপেনিং উইকে মুভিটি খোদ আমেরিকাতেই ১৬০ মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করেছিলো। তবে ঐ দূর্ঘটনাটি যে ডার্ক নাইট রাইজেসের ব্যবসায়িক সাফল্যে কিছুটা ব্যঘাত ঘটিয়েছিলো সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, এছাড়া ঐসময় শুরু হয় লন্ডন অলিম্পিক। এই দুটোর বেশ খানিকটা প্রভাব পোহাতে হয় বক্স অফিসে।তবে যতোটা আশা করেছিলাম ঠিক ততোটা না হলেও দ্যা ডার্ক নাইট রাইজেস ছিল বেশ ব্যবসাসফল একটি মুভি। ২৫০ মিলিয়ন ডলারের বিগ বাজেটের এই মুভিটি ওয়ার্ল্ডওয়াইড এক বিলিয়ন ডলারের মতোন ব্যবসা করে, এবং আমেরিকাতে এর পরিমাণ ছিলো প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের মতো।এ প্রসংগে একটি কথা বলে নেয়া দরকার, মুভিটির ওপেনিং উইকএন্ডের আয় ছিলো টুডি মুভির ইতিহাসে সর্বাধিক আয়।
যাই হোক, এইবার মুভিটির ব্যাপারে আসি। দ্যা ডার্ক নাইটের অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে সাথে জোকার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করা হিথ লেজার ও তার অকালপ্রয়াণ সবকিছুই একটা আলাদা আলোচনার বন্দোবস্ত করে রেখেছিলো এই নতুন এবং ব্যাটম্যান সিরিজের শেষ পর্বটির সাথে। কারণ সবার মনে ছিলো একটাই প্রশ্ন,নোলান কি পারবেন দ্যা ডার্ক নাইটকে অতিক্রম করতে, বেনের ক্যারেক্টারে অভিনয় করা টম হার্ডি কি পারবেন জোকার চরিত্রে হিথ লেজারকে অতিক্রম করতে? এইসব প্রশ্ন উঠে আসাটা কিন্তু একেবারেই স্বাভাবিক। কারণ মুভির পরিচালক যে স্বয়ং ক্রিস্টোফার নোলান, দ্যা আল্টিমেট মাস্টারমাইন্ড। গল্পের প্লট আর স্টোরিলাইন আর ক্যারেক্টার বিল্ডআপে যার কোনো তুলনা চলে না, এছাড়া এজ ইউজ্যুয়াল চিত্রনাট্যে তার সাথে আছেন ভাই জোনাথান নোলান, আরেক বস পাবলিক। সুতরাং দ্যা ডার্ক নাইট রাইজেস নিয়ে অন্য সবার মতোন আমিও বেশ উৎসুক ছিলাম। তবে খানিকটা সন্দেহও ছিলো ভিতরে ভিতরে, হয়তো শেষ পর্বটি আগেরটার মতোন এতোটা এপিক হবে না, একটু আগে মুভিটি দেখা শেষ করে মনে হলো, হয়তো ততোটা এপিক হয় নি, তবে যা হয়েছে রীতিমতো দুর্দান্ত লেভেলের। একটি দুর্দান্ত ট্রিওলজির দুর্দান্ত এন্ডিং।
মুভিটির রানিংটাইম বেশ লম্বা, প্রায় পৌনে তিন ঘন্টার মতো। কিন্তু কাহিনির স্টোরিলাইনটি এতোটাই জমজমাট যে বোর হবার কোনো সুযোগই নেই।আগের পর্বে যেখানে এসে কাহিনিটা শেষ হয়েছিলো, সেটারই এৃকটা ধারাবাহিকতা রেখে নতুন পর্বটি শুরু হয়।আগের পর্বে দেখেছিলাম, হার্ভি ডেন্টের সেই পুলিশ অফিসারদের খুনের দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে ব্যাটম্যানকে পালাতে হয় গথাম সোসাইটি থেকে, কারণ তখন গথাম সিটির মানুষদের দরকার ছিলো হার্ভি ডেন্টের মতোন একজন ভালো মানুষের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের। তাই সমাজের চোখে ভিলেন হতে হয় ব্যাটম্যানকে। সেই ঘটনার আট বছর পরের সময়কাল দিয়ে শুরু হয় দ্যা ডার্ক নাইট রাইজেসের কাহিনী।এই পর্বের ভিলেন "বেন" নামের একজন দূর্ধর্ষ ক্রিমিনাল। বেন একজন মার্সিনারি, মানে টাকার বিনিময়ে যেকোনো কাজ করে দেয় সে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য মুখে অদ্ভূত এক মুখোশ পরে সে, তার রয়েছে নিজস্ব বাহিনী।আর গথাম সিটির সুয়ারেজের ভিতর ছিলো বেনদের মূল আস্তানা।
বেনের চরিত্রে টম হার্ডি:
একরাতে একটি ইন্সিডেন্ট ঘটার পর পুলিশ কমিশনার গর্ডনকে ধরে আনে বেনের গ্রুপের দুই সদস্য। কিন্তু সেখান থেকে ভাগ্যক্রমে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন গর্ডন, কিন্তু পালিয়ে আসতে পারলেও বেশ মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি, এই ঘটনার পর ব্রুস ওয়েইন হাসপাতালে গিয়ে মুখোশ পড়ে গর্ডনের সাথে কথা বলেন, গর্ডন তাকে জানায়, ব্যাটম্যানের অবশ্যই গথাম সিটিতে রিটার্ন করতে হবে এবং বেনের এই অর্গানাইজেশান থেকে বাঁচাতে হবে।ব্রুস ওয়েইন পরে জানতে পারেন, এই বেন হচ্ছে সেই লিগ অফ শ্যাডোসের একজন প্রাক্তন সদস্য। গথাম সিটি ধ্বংসের ভয়ংকর সব পরিকল্পনা আঁটতে থাকে বেন এবং তার বাহিনীর কাছে ক্রমেই ধরাশায়ী হতে থাকে গথামের পুলিশ বাহিনী।কাহিনীতে আরো বহুত দিক আছে যেগুলোর মধ্যে অজস্র প্যাঁচ রয়েছে, এবং সবগুলোই ইন্টারলিংকড হওয়ায় সেগুলো এইখানে বলাটা ঠিক হবে না, তাতে মুভিটি দেখার মজা কমে যেতে পারে। বেশ কিছু নতুন ক্যারেক্টারের দেখা মিলবে যাদের গোটা কাহিনীতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।
এইবার মুভিটির ক্যারেক্টার এনালাইসিসে আসি। দ্যা ডার্ক নাইট আর দ্যা ডার্ক নাইট রাইজেসের মধ্যে কম্পেয়ার করতে গেলে একটা কথা অবশ্যই বলবো, আর তাহলো, দ্যা ডার্ক নাইটের হাইলাইট নিঃসন্দেহে ছিলো জোকার চরিত্রটি, আর দ্যা ডার্ক নাইট রাইজেসে এসে মনে হলো মুভিটিতে ব্যাটম্যানের চরিত্রটি একটি অন্যরকম মাত্রা পেয়েছে।জিনিসটি কিন্তু এমন নয় যে বেনের চরিত্রটি দূর্বল ছিলো কিংবা কম শক্তিশালী ছিলো। কিন্তু এই পার্টে এসে মনে হলো, ব্যাটম্যানের চরিত্রটি আর টিপিক্যাল সুপারহিরো ক্যারেক্টারে বসে নেই।তার ভিতর একটা সুন্দর ফিলোসফিক্যাল ফ্লেভার যোগ হয়েছে।আমার আগে মনে হতো, সুপারভিলেইনদের ভিড়ে ব্যাটম্যান ক্যারেক্টারটিকে হয়তো ওভারলুক করা হচ্ছে, কিন্তু এই পর্বে এসে আমার সেই আক্ষেপটি পুরোপুরি ঘুচে গেলো। এছাড়া নতুন যেইসব ক্যারেক্টারের সমাবেশ করা হয়েছে প্রত্যেকে ছিলেন অসাধারণ। আনা হ্যাথাওয়ে, জোসেফ গর্ডন লেভিট, মারিয়ান কটিলার্ড প্রত্যেকেই ছিলেন অনবদ্য। আর টম হার্ডির বেন চরিত্রটি ছিলো এককথায় বেশ শক্তিশালী। একটা জিনিস বলে রাখা দরকার মুভিতে বেনের ক্যারেক্টারে টম হার্ডির ফেসিয়াল এক্সপ্রেশান একেবারেই দেখানো হয় নি, কাজেই তার জন্য গোটা ব্যাপারটি ফুটিয়ে তোলা খুবই কঠিন ব্যাপার ছিলো, সেদিক থেকে বিচার করলে টম হার্ডিকে দশে দশ দেয়া যায়।কারণ ফেসিয়াল এক্সপ্রেশান ছাড়াও যে কোনো চরিত্রের ভয়াবহতা এইভাবে প্রকাশ করা যায় তার একটা ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। তবে হ্যাঁ, জোকারের তুলনায় বেন ক্যারেক্টারটি খানিকটা লো লেগেছে, এবং এইটাই স্বাভাবিক। কারণ জোকার ক্যারেক্টারটি ছিলো টোটালি অন্য উচ্চতার, এবং সেইটাকে আরো অনেক উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিলেন হিথ লেজার।
বরাবারের মতোনই নিজ নিজ ক্যারেক্টারে সাবলীল ছিলেন গ্যারি ওল্ডম্যান, মাইকেল কেইন আর মর্গান ফ্রিম্যান।আরেকটা ব্যাপার, অ্যানা হ্যাথাওয়েকে যখন প্রিজনসেলে ঢোকানো হচ্ছিলো, তখন সেই প্রিজনের ক্যাপ্টেনের চরিত্রে প্রিজন ব্রেকের সেই ক্যাপ্টেন বেলিককে দেখে ব্যাপক মজা পেয়েছি।
মুভিটির প্লট আর স্টোরিলাইন নিয়ে কিছু বলতে চাই না, কারণ মেকিং যেহেতু নোলানের, কাজেই এগুলো নিয়ে লেখাটা শুধুই অনর্থক শব্দব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়।সেই সাথে চমৎকার মিউজিক স্কোর, ভিউজ্যুয়ালস, এডিটিং আর ডিরেকশান---- সব মিলিয়ে অসাধারণ এন্টারটেইনিং একটি মুভি।মুভিটির স্ক্রিপ্ট ছিলো খুবই বুদ্ধিদীপ্ত মানের।আর কাহিনীর এন্ডিংটা এতোটাই আউটস্ট্যান্ডিং লেগেছে বলার মতোন নয়। নোলান মুভিটি এমনভাবে শেষ করেছেন, দেখে মনে হয়েছে নিজে হয়তো আর এই ফ্র্যান্চাইজির সাথে জড়াবেন না, কিন্তু ভবিষ্যতে যেনো যে কেউ এইটার প্রোডাকশান পুনরায় শুরু করতে পারেন সে দরজা পুরোপুরি খোলা রেখে গিয়েছেন।
আর সবশেষে বলবো, এই ফ্র্যান্চাইজিকে আমি সুপারহিরো মুভি বলতে একেবারেই নারাজ। মুভিগুলোর কাহিনী আর ক্যারেক্টরাইজেশান একে ভীষণরকম মানবিক রূপ এনে দিয়েছে।শেষ পর্বটির কথাই ধরুন, এই মুভিটিতে অসম্ভব সুন্দর কিছু ম্যাসেজ রয়েছে, দারুন কিছু ইমোশনাল মিক্সিং রয়েছে, যেগুলোর কোনোটারই এক্সপ্রেশান নোলান বাইরে থেকে দেখান নি, বরং সেগুলো একদম ভিতর থেকে অনুভব করতে হয়েছে। সেই হেল অন আর্থের ভিতরকার ডায়ালগগুলো কিংবা আলফ্রেডের সাথে ব্রুস ওয়েইনের ডায়ালগগুলো, সংলাপগুলোর ব্যাপকতা আর ইমোশান ছিলো অনেক গভীরে, এইরকম অজস্র উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
ব্যাক্তিগতভাবে আমি দ্যা ডার্ক নাইটকে কিছুটা এগিয়ে রাখবো দ্যা ডার্ক নাইট রাইজেস হতে। আমি দ্যা ডার্ক নাইটকে দশে দশ দিয়েছিলাম, সেই তুলনায় আমি দ্যা ডার্ক নাইট রাইজেসকে দশে সাড়ে নয় দিবো। এই মুভিটির আইএমডিবি রেটিং কিন্তু বেশ ভালো, ৮.৮ রেটিং নিয়ে এটি আইএমডিবি টপ ২৫০ তালিয়ায় ৩০ নাম্বারে রয়েছে।মুভিটি ২০১২ সালের অন্যতম সেরা মুভি--সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আশা করি আসছে অস্কার সহ অন্যান্য মেজর অ্যাওয়ার্ড গিভিং সিরেমনিগুলোতে এই মুভিটি বেশ প্রশংসিত হবে।সর্বকালের সেরা ট্রিওলজির মধ্যে অবশ্যই অবশ্যই নোলানের এই ব্যাটম্যান সিরিজটি একেবারে উপরের কাতারে গণ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস।
ডাউনলোড লিংক:
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ৩:৪৬