লেখার শুরুতে একটু আতলামী করে নেই। কেউ হয়ত রাগ করে বলবেন আপনি লেখার শুরুতে কিছু কোড করেছেন। বিখ্যাত সব লোকের কথা বলেছেন। এতে আতলামীর কি হলো। রাগ করবেন না, আপনার কথাই সত্যি আসলে এগুলো আতলামী নয়। কেউ হয়ত বলবেন আতলামীই তো। থাক থাক এসব কথা… মুল লেখাটিতে ঢুকে যাই। আপনি কিছু ভালো ভালো কথা শুনতে প্রস্তুত। তাহলে শুরু করি।
পবিত্র কোরআনের সর্বপ্রথম যে বাণী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুনতে পেয়েছিলেন তাতে আছে ‘আল্লামা বিল কলমি’ অর্থাৎ আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন, ‘কলমের মাধ্যমে’। আর কলমের আশ্রয় তো পুস্তকে।
পবিত্র কোরআন মাজিদে আরও বলা হয়েছে, ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। পড়, আর তোমার রব মহামহিম’ (সূরা আলাক :১-৩)।
নবী করিম (সা.) এক হাদিসে উল্লেখ করেছেন, ‘ঘণ্টাখানেকের জ্ঞান সাধনা সমগ্র রজনীর ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ’। এখানে জ্ঞান সাধনা বলতে মূলত বই পড়ার ওপর সর্বাধিক তাগিদ দেয়া হয়েছে। সনাতন ধর্মের কঠোপনিষদের ৪ নং শ্লোকে লেখা হয়েছে ‘দুরমেতে বিপরীতে বিষূচী অবিদ্যা যা চ বিদ্যেতি জ্ঞাতা’ অর্থাৎ-বিদ্যা বলতে এখানে জ্ঞানকে বুঝানো হয়েছে। যে জ্ঞান মানুষের চরম লক্ষ্য। আর এই চরম লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে বিদ্যা শিক্ষা অর্থাৎ বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে বাইবেল শব্দের অর্থই হলো ‘বই’।
জগৎ খ্যাত কবি ওমর খৈয়ম বলেছিলেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু একখানা বই সব সময় অনন্ত-যৌবনা যদি তেমন বই হয়।’
সৈয়দ মুজতবা আলী ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে লিখেছেন,
‘বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলে হয়নি। বই কেনার বাজেট যদি আপনি তিনগুণও বাড়িয়ে দেন, তবুও তো আপনার দেউলে হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
আল্লামা শেখ সা’দী বলেন, ‘জ্ঞানের জন্য তুমি মোমের মতো গলে যাও। কারণ জ্ঞান ছাড়া তুমি খোদাকে চিনতে পারবে না।’
বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন, ‘সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়ানোর প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভেতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, ভবযন্ত্রণা এড়ানোর ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়।’
এবার আসি এত কথা কেন বললাম?
একজন সৃষ্টিশীল মানুষ পৃথিবীতে বইয়ের বিকল্প কিছুই চিন্তা করতে পারেন না। বই মানুষের জীবন সঙ্গী। বই অবসরের প্রিয় বন্ধু। বই পাঠ মানুষকে সত্য পথে চলতে, মানবতার কল্যাণে অনুপ্রাণিত করে। বই সুখের সময় মানুষের পাশে থাকে। দুঃখের সময় মনোবল বাড়াতে সাহায্য করে। যে লোকটি বইকে নিত্যদিনের সঙ্গী বানিয়েছে, সেই লোকটি সমাজের অন্য ১০ জন মানুষ চেয়ে ভিন্ন। তার মন-মনন আলাদা। চিন্তাচেতনা ভিন্ন। সহিষ্ণুতা আর বিশ্বাসের ধরনটাও আলাদা। ইচ্ছা করলেই বিবেক বিক্রি করে তিনি নষ্ট পথে ধাবিত হতে পারেন না। এক কথায় যিনি জ্ঞানী তিনি কখনই সমাজ বিপর্যয়ী কাজে অংশ নিতে পারেন না। একজন পাঠক মাত্রই জ্ঞানের সাধক।
কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই বলবেন, সময় বদলাচ্ছে। পুঁজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থায় বই পড়ে কী হবে? অধিকাংশই জ্ঞান অর্জনের চেয়ে অর্থ রোজগারে থাকেন অভ্যস্ত। তাই বই পড়া থেকে অনেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। পুঁজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থায় অনেকে শিল্পপতি, আঙ্গুল ফুলে হঠাৎ ধনী হয়েছেন। তাদের ধারণা বই পড়ে কী হবে? পৃথিবী তো টাকার গোলাম। টাকার কাছে হেরে যাচ্ছে মেধা-মনন আর সততা।
এক সময় লাইব্রেরিগুলোতে পাঠকের উপচেপড়া ভিড় লেগে থাকত। যদিও এখন অধিকাংশ লাইব্রেরি পাঠকশূন্য। প্রযুক্তির কারণে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ সাইটের মোহ আর অনলাইনে পাঠ সামগ্রীর প্রাচুর্যে পাঠক এখন কিছুটা বইবিমুখ।
কথা সত্যি। এক সময় বিশেষ করে রাজনীতিকরা প্রচুর বই পড়তেন। বড় রাজনীতিক হতেন। দলের তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে পরিচিত হতেন। সারা পৃথিবীর খোঁজখবর রাখতেন। জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতেন। প্রত্যেক রাজনীতিকের ব্যক্তিগত একটি লাইব্রেরি ছিল। ছিল তাদের চমৎকার সংগ্রহশালা। তারা রাজনীতি করতেন, পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতেন। আর দিন-রাতের নির্ধারিত একটি নির্দিষ্ট সময়ে পড়াশোনা করতেন। নানা বিষয়ে গবেষণা করতেন।
আর এখন! স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতিকদের বড় একটি অংশ বই পড়েন না। তারা বই পড়বেন বা কেন? কারণ রাজনীতিতে এখন আর মেধার তেমন প্রয়োজন হয় না। পেশি আর কালো টাকা এ দু’য়ের মিলন হলেই যথেষ্ট। তিনি ভালোভাবে জানেন, মেধা দিয়ে রাজনীতি করে নেতা হননি। গুণীর মর্যাদা পাননি। তিনি দেশের হর্তা-কর্তা হয়েছেন বটে; তবে কালো টাকার বিনিময়ে। বড় নেতা হয়েছেন পেশিশক্তি প্রদর্শন করে। কেন তিনি বই পড়বেন? কেন অযথা সময় নষ্ট করবেন? এই চরিত্র কী শুধু রাজনীতিকদের বেলায়? সর্বত্র পেশায় একই দুরবস্থা। তবে একটু পার্থক্য আছে। কম আর বেশি।
জ্ঞানার্জন ক্ষমতা ও ধনার্জনের চেয়ে মহত্তর
একজন আরব পন্ডিতের উদ্ধৃতি দিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী বোঝাতে চেয়েছেন, ‘ধনীরা বলে, পয়সা কামানো দুনিয়াতে সবচেয়ে কঠিন কর্ম। কিন্তু জ্ঞানীরা বলেন, না জ্ঞানার্জন সবচেয়ে শক্ত কাজ। এখন প্রশ্ন কার দাবিটা ঠিক, ধনীর না জ্ঞানীর? আমি নিজে জ্ঞানের সন্ধানে ফিরি, কাজেই আমার পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া কঠিন। তবে একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি, সেইটে আমি বিচক্ষণ জনের চক্ষুগোচর করতে চাই। ধনীর মেহনতের ফল হলো টাকা। সে ফল যদি কেউ জ্ঞানীর হাতে তুলে দেয়, তবে তিনি সেটা পরামানন্দে কাজে লাগান এবং শুধু তাই নয়, অধিকাংশ সময়ে দেখা যায়, জ্ঞানীরা পয়সা পেলে খরচ করতে পারেন ধনীদের চেয়ে অনেক ভালো পথে, উত্তম পদ্ধতিতে। পক্ষান্তরে, জ্ঞানচর্চার ফল সঞ্চিত থাকে পুস্তকরাজিতে এবং সে ফল ধনীদের হাতে গায়ে পড়ে তুলে ধরলেও তারা তার ব্যবহার করতে জানে না।বই পড়তে পারে না’।
অতএব প্রমাণ হলো জ্ঞানার্জন ধনার্জনের চেয়ে মহত্তর। আসলে ধন সাময়িক মাত্র। নশ্বর এই পৃথিবীতে প্রকৃত জ্ঞানী-গুণীরা চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন এবং আছেন।
এত কথা বলার পর এবার নিজের কথায় আসি। বিরক্ত হচ্ছেন না তো? আচ্ছা না হয় একটু বিরক্তই করি।
আমি নিজে অন-লাইন জগতে মানুষ। ব্লগ, ফেসবুকেই লেখা প্রকাশ করি। কিছু পাঠক আছেন। পড়েন। নিশ্চয় জানেন ব্লগ বা ফেসবুকে পাঠক ফিটব্যাগটা বুঝা যায়। এই পাঠকদের পুজি করে এবার বই মেলায় আমার লেখা ৫ টি গল্প ও একটি মিনি উপন্যাস নিয়ে একটি গল্পের বই করেছে স্বরচিহ্ন প্রকাশনী সংস্থা।
গল্পের বই। জ্ঞান বিতরণের জন্য লিখিনি।
অবসর সময় বইটি নিয়ে কাটাতে পারেন। আপনি যদি বই পড়ে মজা পান, আমি আপনাকে বলছি আমার বইটি পড়েও মজা পাবেন।
উপরের লেখাটি যেখান থেকে সংক্ষিপ্ত করে লেখা হয়েছে।
সূত্র:
বই কেন পড়বেন
এম মাফতুন আহম্মেদ
লেখক : আইনজীবী ও খুলনা থেকে প্রকাশিত আজাদ বার্তা পত্রিকার সম্পাদক