প্রায় আধ ঘন্টার মতো হতে চললো। এখনো তাদের আসবার কোন নাম গন্ধই নেই। ভার্সিটি চত্বরে এই প্রকান্ড পাতাওয়ালা গাছ গুলি আছে বলেই শান্তি। নাহলে পড়ন্ত দুপুরের এই কাঠ ফাঁটা রোদে আধ ঘন্টা দাড়িয়ে থাকাটা সম্ভব হতো না। একটা বড় বট গাছের চারপাশের সিমেন্টের বেড়িতে বসে বসে টানা ৪ টা সিগারেট শেষ করলাম। আর একটা সিগারেট আছে মাত্র। এটা ধরালেই শেষ। কিন্তু ৫ মিনিটের বিরতি দিয়েই অধৈর্য হয়ে এই সিগারেটটা ও ধরিয়ে ফেললাম। সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে চারপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।
বিগত চার বছরের সবচেয়ে চেনা এবং সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। জীবন পথের আবেগঘন চারটি বছর কেঁটেছে এখানেই। কতো হাসি-কান্না,সুখ-দুঃখের সাক্ষি হয়ে আছে এই ভার্সিটি তার কোন ইয়ত্তা নেই। প্রতিদিন ক্লাস শেষেই এখানে সেখানে আমাদের আড্ডা গানে মুখরিত হয়ে উঠতো এই ভার্সিটি ক্যাম্পাস। সর্বদা দুহাত ভরে যে সোনালী দিন গুলি এই ভার্সিটি আমাদের দিয়েছে সেই ঋণ কখনো শোধ হবার নয়। হয়তো সারা জীবন ধরে চেষ্টা করলেও শোধ করা যাবে না!
আজকেই শেষ। আজকের পর হয়তো আর এভাবে বন্ধুদের নিয়ে আসা হবে না এখানে। আমাদের ব্যাচের বেশিরভাগ ছেলে মেয়েরাই ইতিমধ্যে হোস্টেল ত্যাগ করে চলে গেছে যার যার বাসায়। কালকে সকালে আমারও যাবার পালা। তাই শেষবারের মতো চলে এলাম কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। কিন্তু কিসের কি! কারোরই খবর নেই এখনো!
হঠাত্ পিঠে সজোরে একটা থাপ্পড় অনুভব করলাম। বুঝতে একটুও দেড়ি হলো না যে কে মেরেছে। কয়েক বছর ধরে মাহাবুব এই কাজটা করে আসছে। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও এখন আর লাগে না। বলা যায় এটা তার একটা বদ অভ্যাস।মাহাবুব এসে আমার ঠিক পাশে বসলো। আমি তার দিকে না তাকিয়েই সিগারেটে একটা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
- বাকিরা কই?
- কি জানি! আমি তো হোস্টেল থেকে আসলাম। আসার সময় কারো সাথেই দেখা হয় নাই।
- হুম! তুই যাবি কবে?
- দেখি কালকে ট্রেনের টিকেট কাঁটবো।
আমাদের কথা বলাল ফাঁকেই দেখলাম অন্যরা এসে হাজির। সুজিত,মুসফিক,সামিয়া,সঞ্জয়। সবাই এসে একে একে পাশে বসলো। হঠাত্ সঞ্জয় বলে উঠলো,
- কিরে ঈষাম। তুই এখানে কেন? যাওয়ার আগে বুঝি প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে দেখা করতে আসলি?
আমি সবিস্ময়ে বললাম,
- মানে?
সঞ্জয় একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
- পেছনে তাকিয়ে দেখ!
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। গাছের বিপরীত পাশে নদী বসে আছে তার দুই বান্ধবীর সাথে। একই ডিপার্টমেন্টের কিন্তু এক বছরের জুনিয়র সে।
এই মেয়েটির সাথে প্রায় দুই বছরের মতো সম্পর্ক ছিল আমার। কিন্তু বড় ধরনের কিছু ভুল বুঝাবুঝির কারণে গত কয়েক মাস হলো আমাদের ভালবাসার সম্পর্কে চির ধরেছে। বর্তমানে আমার আর তার মাঝে কোন প্রকারের যোগাযোগ নেই তবুও এখনো তাকেই ভালবাসি খুব। হয়তো কখনো বলা হবে না আর মুখ ফুঁটে।
নদীকে দেখার পর কেন জানি একটা অজানা অস্বস্থি কাজ করলো মনের ভেতর। বুঝতে পারলাম যে এখানে আর বেশিক্ষণ থাকাটা ঠিক হবে না। তাই হঠাত্ উঠে দাড়ালাম এবং হাতের সিগারেটটাতে শেষ টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলাম পেছনে। বন্ধুদের বললাম,
'চল শেষবারের মতো তোদের সাথে কোথাও গিয়ে খেয়ে আসি!'
বলেই হাটা ধরলাম সাথে সাথেই এবং আমার ঠিক পেছনেই আসতে লাগলো অন্যরা।
ভোরের রক্তিম সূর্য্যালোক জানালা ডিঙ্গিয়ে চোখে এসে পরতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। হোস্টেল জীবনের শেষ সকাল। ভাবতেই মনটা এক অজানা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। অনিচ্ছা সত্তেও বিছানা ছেড়ে উঠলাম। সকাল ৮ টার বাস। তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে রওনা দিতে হবে আমাকে।
বাস স্ট্যাশনে বসে আছি প্রায় ১৫ মিনিট হলো। বাস ছাড়তে আরো অনেক দেড়ি। কানে হেডফোন গুজে চোখ বন্ধ করলাম। হঠাত্ বন্ধ চোখের নিকশ আঁধারে নদীকে দেখতে পেলাম এক বিন্দু আলোকরেখা রূপে। আজ এতো দিন পরে তার কথা কেন বারবার মনে পরছে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। হয়তো হৃদয়ের গভীরে বিশাল একটা অংশ জুড়ে রয়ে গেছে সে এখনো।
মেয়েটাকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিন থেকেই প্রেমে পরে যাই তার। নবীনবরণ অনুষ্ঠানে এই ডানা কাঁটা লালপরীটাকে দেখে হৃদয়ের সুপ্ত ভালবাসা গুলি আর শিকল বন্ধি করে রাখতে পারি নি।
তারপর কিছু বন্ধুর কল্যাণে পরিচয় পর্বটা খুব সহজেই হয়ে যায় আমাদের। এই পরিচয় থেকে ক্রমেই ভাল বন্ধু এবং সবশেষে একে অপরের ভালবাসার মানুষ। মেয়েটাকে যতো দেখতাম ততোই মুগ্ধ হতাম। এতো স্নিগ্ধ এবং কোমল মেয়েও যে পৃথিবীতে থাকতে পারে সেটা আমার আগে জানা ছিল না। নদীর মাঝে আমি নিজেকে হারিয়ে খুঁজে পেতাম আবার নতুন আরেক রূপে।
হেডফোনে গান বন্ধ হয়ে গেল হঠাত্। ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসি সাথে সাথেই। মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি মাহাবুব কল করেছে। মোবাইলের সবুজ বাটনে চাপ দিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই অপর পাশ থেকে যা শুনলাম তাতে আমার চারপাশে পুরো দুনিয়াটা নিমিষেই থেমে গেলো। পুরো শরীরটা যেন নিথর হয়ে আসে আমার। মাহাবুব আরো অনেক কিছু বলে ফোনটা কেঁটে দেয়ে। কিন্তু সেসব কিছুই আর আমার কর্ণকুহর ছেদ করে মস্তিষ্কে আলোরণ সৃষ্টি করেনি। শুধু একটি কথাই মাথায় ক্রমাগত বাজতে থাকে,
'ঢাকা মেডিকেল হস্পিটাল বার্নিং ইউনিট'
মুহূর্তের মধ্যেই পৌছে যাই হস্পিটালে। দৌড় লাগাই বার্নিং ইউনিটের দিকে। গিয়েই সব গুলা বেডে খুঁজতে থাকি তাকে। একেবারে শেষের দিকে দেখা পাই তার।
আমার সেই লালপরীটাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে সাদা বিছানায়। পুরো শরীর তার সাদা বেন্ডিজের আবরণে ঘেরা এবং মুখে লাগানো মোটা অক্সিজেনের পাইপ।
আমি আস্তে করে তার পাশের চেয়ারে গিয়ে বসি। অজ্ঞান হয়ে পরে রয়েছে নদী। তার সেই স্নিগ্ধ কোমল চেহারায় এখন এক নিদারুণ কষ্টের স্পষ্ট ছাপ প্রতিভাত হচ্ছে। আমি উঠে গিয়ে নদীর এক বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে এটা ঘটলো!
সে বললো,
'কাল দুপুরে নদী ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বট তলায় আমাদের সাথেই বসে ছিল। কিন্তু হঠাত্ দেখলাম যে তার জামাতে পেছন থেকে আগুন জ্বলছে। নেভানোর আগেই তার সারা শরীরে আগুন ছড়িয়ে পরে। পরে জানা যায় যে জলন্ত সিগারেটের টুকরা থেকে তার জামাতে আগুন ধরে যায়।'
বলেই কেঁদে ফেলে মেয়েটি।
তার কথা শুনে মাথায় বাজ পরে আমার। হঠাত্ মনে পরে ঐখান থেকে চলে আসার সময় আমিই তো জ্বলন্ত সিগারেট পেছনে ফেলেছিলাম। তাহলে কি আমিই নদীর এই অবস্থার জন্য দায়ী!
নাহ্! আর ভাবতে পারছি না। ভাবনার তার গুলি একে একে ছিড়ে যাচ্ছে অন্তর থেকে। কাল বিলম্ব না করেই হস্পিটাল থেকে বেড় হয়ে আসলাম। শাহবাগের সুবিশাল রাস্তার ফুটপাথ ধরে হাটছি এবং মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছি একটা মেয়ের সুন্দর জীবনটা নষ্ট করে দেয়ার জন্যে।
বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। ইচ্ছে করছে নিজেকে ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু নিজেকে ধ্বংস করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে?
না!আমাকে প্রায়শ্চিত্ব করতে হবে।
নিজের মনকে নিজেই বোঝালাম।
পরেরদিন সকালে উঠেই চলে গেলাম নদীকে দেখতে। এখনো জ্ঞান ফিরেনি। আরো দুই একদিন সময় লাগবে।
আমি প্রতিদিন দুই তিনবার করে হস্পিটালে যাই নদীকে দেখতে। এখন এটাই আমার একমাত্র কাজ। শিয়রের পাশে বসে বসে ঘুমন্ত রাজকন্যাকে দেখতে থাকি। নদীর কষ্টের কথা চিন্তা করে তার পরিবারের মানুষরা সারাদিন কাঁদতে থাকে। আমি তাদেরকে সান্তনা দেই। মাঝে মাঝে আমার চোখ দিয়েও কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পরে। কিন্তু কাউকে জানতে দেই না। আঁড়ালে গিয়ে কাঁদি আমি নির্জনে।
প্রায় পাঁচ দিন পরে নদীর জ্ঞান ফিরে। প্রথম কয়েকদিন কথা বলতে না পারলেও এখন ধীরে ধীরে কথা বলতে পারে। প্রথম দিন আমাকে হস্পিটালে দেখে খুব অবাক হয়েছিল সে। হয়তো আমাকে এখানে দেখবে বলে কল্পনাও করেনি।
বেশ কিছু দিন কেঁটে গেলো। নদী কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। তবে শরীরের ক্ষতগুলি একেবারে শুকিয়ে যায় নি। এখন আমরা খুবই ভালো বন্ধু। আমি দিনের বেশিরভাগ সময়ই নদীর সাথে কাঁটাই। তার নিঃসঙ্গ সময় গুলির সঙ্গী হই! সারাদিন গল্পে গানে তার মন ভরিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে সে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে আমার দিকে। হয়তো ভাবে কেনই বা আমি তার কাছে অযথা সময় নষ্ট করছি! একদিন জিজ্ঞেসও করেছিল,
'ঈষাম! কেন আমার জন্য তুমি তোমার মূল্যবান সময় গুলি নষ্ট করছো?'
কিন্তু আমি কপট হাসি দিয়ে এড়িয়ে যাই। কিছুই যে বলার নেই আমার!
প্রায় দুইমাস পরে নদী পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়ে উঠে। হস্পিটাল ছেড়ে বাড়িতে চলে যায় সে। এর মাঝে আমিও পাশ করে একটা ভাল চাকরী পেয়ে যাই এবং বাবা-মা কে ঢাকায় নিয়ে আসি।
অফিসের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরায় নদীকে আর তেমন সময় দেয়া হয় না। তবুও প্রতিদিন একবার করে খোঁজ খবর নেই তার। মনে মনে নদীকে অনেক ভালবাসলেও বুঝতে দেইনা তাকে কিছুতেই।
এরই মাঝে নদীর বিয়ের জন্যে পাত্র খোঁজা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাড়ায় তার পোড়া শরীর। নদীর পোড়া শরীরের কথা জেনে কোন পাত্রই আর সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সম্মত হয় না।
হস্পিটাল থেকে ফেরার পর আর দেখা হয় নি নদীর সাথে। তাই এক ছুটির দিনে চলে গেলাম তাদের বাসায়। সাথে নিলাম এক মুঠো লাল গোলাপ আমার লাল পরীটার জন্য।
সারাদিন নদীর সাথে গল্প করে যখন ফিরতে উদ্দত হলাম তখন নদীর বাবার সাথে দেখা হলো। উনার সাথে কথার ফাঁকে জানতে পারলাম নদীর জন্য পাত্র খোঁজার অপারগতার কথা। বলতে বলতে একসময় তার চোখ বেয়ে জল নেমে আসলো। উনাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারলাম না। বলে দিলাম নদীকে ভালবাসার কথা এবং বিয়ের প্রস্তাব দিলাম।
পরের কয়েকদিন চলে গেল বিয়ের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায়। আজ আমাদের বিয়ে। ঘন্টাখানেক পরেই নদীর বাড়িতে যাব তাকে বৌ করে ঘরে নিয়ে আসার জন্যে। ভাবলাম বিয়ের আগে তাকে তার শরীর পোড়ার সব সত্যি বলতে হবে। মিথ্যা দিয়ে একটা ভালবাসার নতুন জীবন শুরু করাটা ঠিক হবে না।
সাথে সাথেই ফোন দিলাম নদীকে। কয়েকবার ফোন করার পরেও যখন ফোন ধরলো না তখন সরাসরি চলে গেলাম তাদের বাড়িতে।
নদীর রুমে ঢুকে দেখলাম নদী নেই। হয়তো পার্লারে গিয়েছে সাজতে। তাই বারান্ডায় গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম এবং মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম কিভাবে সবকিছু গুছিয়ে বলতে হবে।
হঠাত্ পেছন থেকে কেউ একজন জড়িয়ে ধরলো আমাকে। বুকে মেহেদী রাঙ্গা হাত দেখেই নদীকে চিনতে একটুও অসুবিধা হলো না। আমি কিছু বলার আগেই সে বলে উঠলো,
'তুমি যে আমার জীবনে এভাবে আবার ফিরে আসবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার সবকিছু জেনেও তুমি আমাকে আপন করে নিয়েছো। হয়তো আমার পুরো জীবন দিয়েও এই ঋণ শোধ করতে পারবো না.....'
বলতে না বলতেই নদীর কান্নার শব্দ পেলাম। আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম আমার লালপরীটার চোখ থেকে গালের আঙ্গিনা বেয়ে অঝোর ধারায় জল পরছে।
ভাবলাম,
'থাক না সত্য গুলি গোপন! কিছু সত্য গোপন থাকাটাই হয়তো সবার জন্য ভাল। আর আমি চাইনা আমার পরীটা আমার কাছ থেকে আরেকটি বার হারিয়ে যাক। তাকে হারানোর ব্যাথা সহ্য করার শক্তিটুকু যে আর নেই আমার...'
দুহাত দিয়ে তার চোখের পানি গুলি মুছে দিতে দিতে বললাম,
'আজকেই শেষ! আজকের পরে যদি আর কাঁদতে দেখেছি তো একেবারে মেরেই ফেলবো...'
আমার কথা শুনে নদী হেসে ফেললো। আর আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম বুকের মাঝে পরম ভালবাসায়.....
- ঈষাম আরমান