গরিব দেশগুলো বঞ্চিত হচ্ছে
গত কয়েক দশক জুড়ে বিজ্ঞানীরা জলবায়ুর ওপর মানুষের প্রভাব ও মানুষের ওপর জলবায়ুর প্রভাব বিষয়ে গবেষণা করছেন। গবেষণায় উঠে এসেছে একটি সাধারণ বিষয় : জলবায়ুর ওপর মানুষের প্রভাব ও মানুষের ওপর জলবায়ুর প্রভাবÑ উভয় দিক থেকেই পৃথিবীর ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য।
প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব মানুষ ঝুকির মধ্যে রয়েছে তারা গরিব দেশগুলোর বাসিন্দা। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য গৃনহাউস গ্যাস উৎপাদন গরিব দেশগুলোতে কমই হয়। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ ঝুকির মধ্যে রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই খুবই গরিব। যেসব দেশের ঝুকি কম সেগুলোর এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার মতো পর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষমতা আছে। এ ধরনের অধিকাংশ দেশই পৃথিবীর ধনী দেশ।
পৃথিবীর গৃনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে সবার জন্য সমান পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে ধনী বনাম গরিব দেশের এ বৈষম্যটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ রবার্ট ম্যানডেলসন বলেন, আমরা সবাই এ জন্য (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) দায়ী। এ কথাটি বাজারে প্রচলিত। কিন্তু গবেষণা ফলাফলে তা দেখা যায় না। আমরা সবাই এ জন্য দায়ী নই, তিনি জানান।
ভৌগোলিক কারণে পৃথিবীর শিল্পোন্নত দেশগুলো অনেকখানি নিরাপদ স্থানে আছে। এদের অনেকগুলোর আবহাওয়াও নাতিশীতোষ্ণ।
আমেরিকান কর্ন বেল্ট এবং ফ্রান্স ও নিউ জিল্যান্ডের মতো দেশগুলোও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, যাদের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।
এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো উন্নত দেশগুলোর সম্পদ তৈরিই হয়েছে এভাবে। প্রায় এক শতাব্দী ধরে তাদের গাড়ি, ইন্ডাস্ট্রি, এয়ার কন্ডিশনার ও বিলাস দ্রব্যের পেছনে ব্যয় হয়েছে কয়লা, তেল ও অন্যান্য ফসিল ফুয়েল বা জ্বালানি শক্তি।
যুক্তরাষ্ট্র বা ইউনাইটেড স্টেটসের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান মাত্র ৪%। কিন্তু আফৃকার দেশ মালাউয়ির ৯০% মানুষ গ্রামে বাস করে এবং অর্থনীতির ৪০% দাড়িয়ে আছে বৃষ্টিপাত নির্ভর কৃষির ওপর।
ইন্ডিয়া ও চায়নার মতো বড় উন্নয়নশীল দেশগুলো যতোই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসছে, ততোই তারা গৃনহাউস গ্যাস উৎপাদন বাড়াচ্ছে। অল্প কিছুদিন পরই চায়না বার্ষিক কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপাদনে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে।
যদিও পৃথিবীর বাতাসে দীর্ঘদিন ধরে জমা হওয়া মোট কার্বন ডাইঅক্সাইডে এসব দেশের অবদান অতি সামান্য। প্রকৃতিগতভাবেই তাপ ধারণকারী এ সব গ্যাস দীর্ঘদিন বায়ুম-লে টিকে থাকে ও ক্ষতি করতে থাকে।
চায়না এখন পরিণত হচ্ছে একটি পাওয়ার হাউসে। তবে ১৮৫০ সালের পর থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপাদনের হিসাবে চায়নার অবদান মাত্র মাত্র ৮%-এরও কম। কিন্তু ইউনাইটেড স্টেটসের অবদান ২৯% ও পশ্চিম ইওরোপের অবদান ২৭%।
উন্নত বনাম উন্নয়নশীল (বা অনুন্নত) দেশগুলোর এ ধরনের বৈষম্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এবং ক্লাইমেট এক্সপার্টদের চিন্তিত করে তুলেছে। কারণ এনভায়রনমেন্টাল আইন ও কূটনীতি বিবেচনা করলে দেখা যাবে তৃতীয় বিশ্বের কাছে প্রথম বিশ্ব ঋণী। ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসিফিক ইন্সটিটিউট ফর স্টাডিজ ইন ডেভেলপমেন্ট, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সিকিউরিটির কো ফাউন্ডার পিটার গ্লিক বলেন, ক্লাইমেট চেঞ্জের জন্য আমরা দায়ী এবং দোষী দেশগুলোকে ক্লাইমেট চেঞ্জের জন্য দায়ী করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
পৃথিবী ব্যাপী এ ধরনের বহু উদাহরণ আছে যেখানে দেখা যায়, ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব রোধ করতে সক্ষম। অন্যদিকে গরিব দেশগুলো ভৌগোলিক ও ইতিহাসগত দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুকির মধ্যে রয়েছে।
ব্ল্যানটায়ার, মালাউয়ি
গরিব দেশগুলোর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের সামর্থ্য নেই
মালাউয়ির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ব্ল্যানটায়ারে ২৫ বছর বয়স্ক হ্যারল্ড এনকোহোমা সরকারি আবহাওয়া কেন্দ্রের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থেকে দিনে দু’বার করে রিডিং রেকর্ড করেন। অবশ্য তিনি ব্যারোমিটারে মাপ নিতে পারেন না। কারণ এটির লাইট কাজ করছে না এবং সংখ্যাগুলোও পড়া যাচ্ছে না। প্রায় ছয় মাস ধরে তাকে নতুন ব্যাটারির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
ইভাপোরেশন প্যানটিও তিনি ব্যবহার করতে পারেন না। যন্ত্রটি দিয়ে নির্ণয় করা হতো, মাটি কতো দ্রুত পানি শোষণ করে। এর কিছু অংশের রঙ উঠে গেছে। যন্ত্রের তারের জালটাও ছিড়ে গেছে।
সূর্যরশ্মির স্থায়িত্ব মাপার যন্ত্রটিও তিনি ব্যবহার করেন না। কাগজের ওপর সূর্যতাপের চিহ্ন এতে সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। যন্ত্রটিতে ব্যবহারের জন্য কোনো কাগজ নেই। চার বছর আগেই এর কাগজ শেষ হয়ে গেছে।
তার সুপারভাইজর ওয়েরানি চিলেঙ্গা এসব কারণে খুবই বিরক্ত। তিনি জানান, ভাঙা যন্ত্রপাতি, পুরনো টেকনলজি, বিশৃঙ্খল ডেটা ও এলোমেলো আবহাওয়া স্টেশনÑ সবকিছুই ঠিক করা সম্ভব মাত্র ১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের বিনিময়ে।
তিনি বলেন, চার বছর ধরে আমরা আমাদের দেশের সূর্যরশ্মির স্থায়িত্ব সম্পর্কে কিছুই জানি না। তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন আমরা কিভাবে মাপবো? বিষয়টিকে অত্যন্ত করুণ বলেই তিনি মনে করেন।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং মোকাবেলায় আবহাওয়া তথ্যের অভাব মালাউয়ির অতি সামান্য এক সমস্যা। এছাড়াও সেচের পানির অভাব, মাত্র একটি ফসলের ওপর নির্ভরশীলতা, মাছ উৎপাদন কমে যাওয়া, বনভূমি উজাড় হয়ে যাওয়া ও ভূমির উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়াও দেশটির অন্যতম সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে।
প্রায় ১৪ মিলিয়ন জনসংখ্যা বিশিষ্ট অন্যতম গরিব দেশ মালাউয়ি। আগামী তিন বছরে দেশটির ২৩ মিলিয়ন ডলার অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন। দেশটি জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে এ প্রয়োজনের কথা জাতিসংঘকে জানিয়েছিল।
এক বছর পরও দেখা যায়, দেশটির সরকার এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, মালাউয়ির এনার্জি, খনি ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রী হেনরি চিমুন্থু বান্ডা বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, এ বিষয়ে আমরা এখনো কোনো টাকা পাইনি।
অবশ্য মালাউয়ি যে একেবারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তা বলা যায় না। বড় খাদ্য সংরক্ষণাগার তৈরি, কৃষি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এবং নতুন বাধ তৈরি করা হচ্ছে। প্রতি ১০ জন মালাউয়ির মধ্যে নয়জনই কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
মালাউয়ির ৩৯ বছর বয়স্ক অস্টিন ক্যামপেন এ বিষয়ে এখনই খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। গত বছর একটি অলাভজনক সংস্থা তাকে হোস পাইপ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্র উপহার দিয়েছে। টেকনলজি পুরনো হলেও এর দ্বারা কার্যকরভাবে ফসল ছিটানো যায়। তিনি ভুট্টার পাশাপাশি তুলা, সবজি, আলু ও অন্যান্য ফসল চাষ করার পরিকল্পনা করছেন।
গত জানুয়ারিতে এক সপ্তাহ ধরে হওয়া বৃষ্টিতে নদীর পানি উপচে তার সাত একর জমির ফসল তলিয়ে যায়। তার ৭৫ জন প্রতিবেশী বাড়িঘর হারায়। তবে তিনি আশাবাদীÑ এবার তিনি নতুন করে চাষাবাদ শুরু করবেন।
পার্থ, অস্ট্রেলিয়া
আকাশের পানি সামান্য কিন্তু সাগরের পানি অফুরন্ত
অস্ট্রেলিয়অর পার্থে দাড়িয়ে নতুন প্রজন্মের কেমিস্ট গ্যারি ক্রিসপ পশ্চিমের ঝলসে ওঠা নীল সমুদ্র থেকে খাবার পানির সম্ভাবনা দেখছিলেন। তার পেছনে ছিল একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। ট্যাংক, পাইপ, স্ক্রিন, ফিল্টার ও কেমিকালের স্তূপ। এখান থেকে সমুদ্রের পানিকে খাবার উপযোগী করা হয়। প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষের শহরটির ১৭% খাবার পানি এখান থেকেই সরবরাহ করা হয়।
পৃথিবী ক্রমান্বয়ে গরম হচ্ছে এবং খাবার পানি হয়ে উঠছে মহামূল্যবান। অস্ট্রেলিয়ার পার্থে অবস্থিত সি ওয়াটার ডিস্যালাইনেশন প্লান্টটি বাতাস ও সাগরের রিনিউয়েবল এনার্জি ব্যবহার করেই পানির লবণাক্ততা দূর করে। তবে দেশটির অর্থ আছে বলেই এ ধরনের বড় প্রকল্প নেয়া সম্ভব হয়েছে, যা অন্য অনেক দেশেরই নেই।
৩১৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এ ধরনের প্লান্টটি গত নভেম্বরে চালু করা হয়েছে। প্লান্টটি বর্তমানে প্রতিদিন ১৪৪ মিলিয়ন লিটার বা ৩৮ মিলিয়ন গ্যালন পানি পরিশোধন করছে। প্রতি ৩৮০০ লিটার পানির জন্য এর উৎপাদন খরচ পড়ে ৩.৫০ ডলার। প্লান্টটিতে সাগরের পানি তোলা হয় যে পাইপটির মাধ্যমে তার মুখ প্রায় ২০০ মিটার বা ৬৫০ ফিট চওড়া। প্লান্টে ঢোকানোর পর রিভার্স অসমোসিস নামে একটি জটিল প্রসেসের মাধ্যমে অর্ধেক পানি পরিশোধন করে শহরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অবশিষ্ট পানি আবার সাগরে চলে যায়।
অস্ট্রেলিয়ার পার্থের প্লান্টটি এ ধরনের প্ল্যান্টগুলোর মধ্যে নতুন। ধনী দেশগুলোতে ধীরে ধীরে এ ধরনের প্লান্ট ছড়িয়ে পড়ছে। এদের মধ্যে আছে মধ্যপ্রাচ্য, যেখানে পানির দাম মেটানো হয় তেল দিয়ে। এছাড়া আমেরিকার দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় এ ধরনের বেশকিছু প্লান্ট আছে।
পার্থের প্লান্টটি অন্যগুলোর তুলনায় শুধু সাইজেই বড় নয়, এটির বায়ুচালিত ইঞ্জিনটিও বড়। প্লান্টটি চালানো হয় ৪৮টি টারবাইন বিশিষ্ট ইমু ডাউনস উইন্ড ফার্মের শক্তি দিয়ে। ১৬০ কিলোমিটার বা ১০০ মাইল দূরে অবস্থিত উইন্ড ফার্মটি প্রতিদিন ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা প্লান্টটির মোট প্রয়োজনের চেয়ে তিন গুণ বেশি। এতে অন্যান্য প্লান্টগুলোর মতো ডিজেল পোড়ানো হয় না। ফলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসও এতে উদ্গীরণ হয় না।
পার্থ প্লান্টের পৃন্সিপাল ডিস্যালাইনেশন ইঞ্জিনিয়ার গ্যারি ক্রিসপ বলেন, বাতাসকে খাবার পানিতে পরিণত করার এ প্রযুক্তিকে আমরা অ্যালকেমি বলি।
এভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে মরুময় মহাদেশটির অধিবাসীরা অর্থবিত্তের কারণে নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে।
জানা যায়, যদিও পানি সাশ্রয়ের মাধ্যমেও তারা অর্থের অপচয় রোধ করতে পারতো। কিন্তু রাজনীতিবিদরারা সেদিকে বাদ সেধেছেন। তারা বাগানে পানি ছিটানো বন্ধ করতে চান না। কারণ তার ফলে তাদের ভোট কমে যেতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ায় অতীতে বড় ধরনের বেশ কয়েকটা খরা হয়েছে। পার্থের নদীগুলোর পানি গত ৩০ বছরে সঙ্কুচিত হয়েছে দুই তৃতীয়াংশ। যদিও প্রতি বছর শহরটির জনসংখ্যা ২০ হাজার জনেরও বেশি বাড়ছে।
পার্থে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ ধরনের আরো একটি বা দুটি বড় প্লান্ট তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়াও সিডনি ও কুইন্সল্যান্ডের টুগুনে এ ধরনের প্লান্ট তৈরি করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
ধানাউর, ইন্ডিয়া
অতিবৃষ্টি ও নদীর হাতে অসহায় মানুষ
বাগমাতি নদীর পানি প্রতি বছর বৃষ্টিতে দু’কূল ছাপিয়ে যায়। হিমালয় থেকেও নেমে আসে পাহাড়ি ঢল। এর ফলে গ্রামটি প্রায়ই পানিতে ডুবে যায় এবং পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।
এ কারণে বছরের পর বছর গ্রামের গবাদি পশু ভেসে যায় ও কাদামাটির ঘরগুলো মাটিতে মিশে যায়। ধানাউর ও তার আশপাশের ডজন খানেক লোক এ ধরনের দুর্যোগে মারা যায়। ২০০৪ সালে এখানে সর্বশেষ বড় বন্যাটি হয়। এ সময় বিহারে ৩৫১ জন মারা যায়। ইন্ডিয়ার বিস্তীর্ণ ফ্লাড প্লেন বা প্লাবন সমভূমিতে ঝুকির মধ্যে এ ধরনের বহু মানুষ বাস করে।
গত বছর ইন্ডিয়ার বিজ্ঞানীরা জানান, ১৯৫০ সালের পর থেকে এ ধরনের ঝুকি বেড়েই চলছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং যতোই বাড়ছে ইনডিয়ায় বৃষ্টিপাত ততোই অনিয়মিত হয়ে উঠছে। এ ধরনের অস্বাভাবিক বৃষ্টির প্রবণতা হঠাৎ বন্যার সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইন্ডিয়ার সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় ৮ মিলিয়ন হেক্টর বা ২০ মিলিয়ন একর জমি প্রতি বছর বন্যায় তলিয়ে যায়। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি জানাচ্ছে, এ ধরনের বন্যায় প্রতি বছর ৪.২ মিলিয়ন ইনডিয়ান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিন মাসব্যাপী বর্ষাকালে প্রত্যেক ধানাউরবাসীই বেচে থাকে জলের দয়ার ওপর। স্থানীয় ধনীরা তাদের প্রয়োজনীয় খাবার ও জ্বালানি কাঠ নিরাপদ স্থানে তুলে রেখে বার্ষিক দুর্যোগের জন্য অপেক্ষা করে। গরিবরা আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পায় না। দুর্যোগ শুরু হলে তারা ভিক্ষা ও ধারকর্জ করে খাবার যোগাড় করে। তারা এ সময় আশপাশের উচু স্থানে সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে তৈরি তাবুতে দিন কাটায়।
বন্যার পানিতেই তারা গোসল করে এবং মলত্যাগও এখানেই করে। এ সময় তারা বন্যার পানি পানও করে। পানি ফুটিয়ে পান করার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। ছয় সন্তানের পিতা হিরা মাজহি জানান, গত বছর তার চার বছর বয়স্ক সন্তান কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়। ঘাতক এ রোগটি এখানে প্রায়ই দেখা যায়। সে সময় তার সন্তানকে কচুরিপানার ভেলায় করে হসপিটালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স এখানে কখনো আসে না।
এ এলাকায় বার্ষিক বন্যা প্রতিরোধে সরকারের পদক্ষেপ আদিম পর্যায়ে রয়ে গেছে। উজানে বাধ তৈরির কাজ ৩০ বছর আগে থেকে গেছে। এ বছর বাধ তৈরির কাজ আবার শুরু হওয়ার কথা। গ্রামবাসীরা নিজেদের উদ্যোগেই যাতায়াতের জন্য বাশের বৃজ তৈরি করে নিয়েছে।
গত বছর প্রথমবারের মতো এ এলাকায় বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারি কর্মমকর্তারা বহনযোগ্য এক ধরনের লাউডস্পিকার নিয়ে রিকশায় চড়ে ধেয়ে আসা বন্যার সতর্কবাণী শোনান। যদিও তাদের নিরাপদ আশ্রয় বলতে স্থানীয় স্কুলটিকেই বোঝায়। স্কুলটিতে অবশ্য খাবার পানি এবং টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা নেই।
মার্চের মাঝামাঝিতে বাগমাতি নদীর পানি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। অসময়ের এ বন্যায় এক দিনেরও কম সময়ে এলাকাটিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এ এলাকার একজন আদর্শ কৃষক সুনিল কুমার। গত বন্যায় তার প্রায় এক হেক্টর জমির গম নষ্ট হয়েছে। ফলে তার বার্ষিক আয়ের এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে। বন্যায় নষ্ট হয়ে যাওয়া তার নিজের এবং প্রতিবেশীর বার্লি, সরিষা ও ডাল ক্ষেত দেখার সময় তিনি বলছিলেন, এখানে বাস করাটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উপায়ই আমাদের কাছে নেই।
ম্যাসবোমেল, নেদারল্যান্ডস
বন্যার পানির সঙ্গে সঙ্গে বাড়িগুলোও নিরাপদে ভেসে ওঠে
ভ্যান ডার মোলেন একটা বড় নদীর কিনারে বাস করেন। আক্ষরিক অর্থে এলাকাটি একটি ঝুকিপূর্ণ এলাকা। সমুদ্রের পানিকে এ এলাকায় ঢুকতে বাধা দেয়ার ক্রমাগত চেষ্টা চলছে। কিন্তু মোলেন এ ধরনের বন্যাকে ভয় পান না। তিনি আগামী বন্যার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
বন্যার আগমন বার্তায় তিনি রোমাঞ্চিত। বাড়িতে বসে তিনি বলছিলেন, আমরা এখনো বন্যার পানিতে ভাসিনি। তবে পানিতে ভাসার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।
তার দুই বেডরুমের দোতলা বাড়িটির দাম প্রায় চার লাখ ২০ হাজার ডলার। এটা কোনো হাউসবোট নয় আবার প্রচলিত কোনো ভাসমান বাড়িও নয়। এটা এক ধরনের উভচর বাড়ি। এ ধরনের বাড়ি মাটির ওপরই তৈরি করা হয় কিন্তু পানি এলে ভেসে ওঠে।
ফাপা কংক্রিটের ফাউন্ডেশনের ওপর তৈরি এ ধরনের বাড়ি ছয়টি লৌহদণ্ডে শক্তভাবে লাগানো থাকে। পানি উঠলে বাড়িগুলোও পানির সঙ্গে ভেসে ওঠে। লৌহদণ্ডের কারণে বাড়িটি পানিস্রোতের সঙ্গে ভেসে চলে যায় না। এভাবে বাড়িটি প্রায় সাড়ে পাচ মিটার বা ১৮ ফিট পর্যন্ত ভেসে উঠতে পারে। পানি কমে গেলে এগুলো আবার নিচে নেমে আসে।
ডুরা ভারমিয়ার কম্পানির প্রজেক্ট কনসেপ্ট ডেভেলপার স্টিভেন ডো বোয়ের বলেন, এ এলাকায় বসবাসের জন্য নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার অংশ এটি। জনসংখ্যাবহুল নিচু এ দেশটির আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্যই ৪৬টি বাড়ির এ ধরনের প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে।
মোলেন বলেন, নদীর একটি অংশে থাকতে তিনি খুব ভালোবাসেন। ডাচদের পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই বাচতে হয়। তাই বিষয়টি অন্যভাবে ভাবতে হয়। এভাবেই পানিকে এনজয় করতে হয়।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
জাতিসংঘের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) ২০০৭ সালের রিপোর্টে পৃথিবীর তাপমাত্রা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। এতে দেখা যায়, ২১০০ সালে ১.১ ডিগ্রি থেকে ২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়তে পারে। এতে সমুদ্রের উচ্চতা ৫৯ সেন্টিমিটার বা ২৩ ইঞ্চি বাড়তে পারে। এভাবে সমুদ্রের উচ্চতা মাত্র ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের দক্ষিণাংশের ১৫-১৭% পর্যন্ত এলাকা সমুদ্রে হারিয়ে যাবে। এছাড়া গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে বন্যা, ঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাড়বে বলে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশের অবশিষ্ট অংশের লোকজনও ব্যাপক সমস্যায় পড়বে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় অনাবৃষ্টিও বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করবে।
সুন্দরবন (ছবি-লেখক)
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে বাংলাদেশের দক্ষিণাংশের কোটি কোটি মানুষকে সরে যেতে হবে তাদের আবাসস্থল থেকে। সুন্দরবনের লবণাক্ততা বাড়ছে - ফলে গাছগুলো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে বাংলাদেশের দক্ষিণাংশের সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এখনই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে সুন্দরবনে। এ কারণেই সুন্দরবনের লবণাক্ততা বাড়ছে এবং গাছগুলো মারা যাচ্ছে।
(পুরনো লেখা)
(সুন্দরবন ছাড়া অন্যান্য ছবিগুলো বিভিন্ন ওয়েবসাইটের)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০০৮ সকাল ৮:৩৬