বৃহস্পতিবারটা ছিলো ছাত্রজীবনে কাঙ্খিত দিন। ওই দিন টিফিন পিরিয়ডেই ছুটি। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত ‘ম্যালা সময়’। স্কুল ফেরত কিশোরকে ওই দিনে দল বেঁধে আড্ডা দিতে মা বাবা কখনো বাঁধা দিতেন না। শুক্রবার দিনভর মাস্তিতো ছিলোই। পাঁড়ার সকল ছেলে দলবেঁধে বাড়ির পাশের ‘আরশি নগর’ অর্থাৎ চা বাগানের টিলায় লুকোচুরি, কখনোবা পাখি শিকারে কিংবা পাখির ডিম দর্শণে দিন কাটতো। এছাড়া বিশাল ‘কালাপাথর’ মাঠে তো আমরা সবাই রাজা ছিলাম। প্রতিদিন বিকেলে কখনো ফুটবল, কখনো ক্রিকেট খেলায় দিন কাটতো। জমতো প্রাণের আড্ডা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাগান কিংবা মাঠে আড্ডার দিনগুলো ফুরিয়ে যায়। নতুন উদ্যেমে সিলেটের সবচেয়ে সুন্দর ক্যাম্পাস এমসি কলেজের দীঘিরপাড় কিংবা টিলার কোনো ঢালে প্রাণের ‘সখাসখি’ মিলে কতো যে আড্ডা দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সে সব আড্ডায় ন্যূনতম ২০/২৫ জন মিলতাম। হাসিগান, আনন্দ আর বন্ধুদের খ্যাপানো ছিলো নিত্যদিনের কাজ। তাই বলে আমাকে যে ক্ষ্যাপানো হয়নি তা, কিন্তু না।
লেখাপড়ার পাঠচুকিয়ে কর্মজীবনে, চলতি পথে শৈশব কিংবা কৈশোরের আড্ডার সাথীদের সাথে দেখা হলে ছোট্ট পরিসরে এখনো আড্ডা জমে। কিন্তু সেই প্রাণের আবেগ হারিয়ে গেছে। সপ্তাহের দেড় দিনের (বৃহস্পতিবার অর্ধেক, শুক্রবার পুরো দিন) আড্ডায় তৃপ্তি নেই এক ফুটোও। এক বই দশজনে পড়া, তাও নেই এখন।
এতো গেলো আমাদের শৈশবের গল্প। আর এখনকার প্রজন্ম! আড্ডার সংজ্ঞাই পাল্টে গেছে। সারাদিন হাতে হাতে স্মার্টফোন, লাইক, শেয়ার আর কমেন্টে আড্ডাবাজি করছে। এখানে নেই প্রাণের কোনো টান। প্রজন্মান্তরে আড্ডা শব্দটাই বিলুপ্তির পথে। সারাদিন বইয়ের ‘গাট্টি’ বয়ে চলে সময়। কখনো প্রাইভেট টিউটর, কখনো কোচিং ক্লাস, আবার রয়েছে নাচ গানের ক্লাসও। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাসে কিংবা দুই মাসে পরিবার কিংবা বন্ধুদের সাথে কোনো চায়নিজে একটু স্যুপ কিংবা নুডুলস আর সেলফিতে বন্দি হয়ে গেছে আড্ডা। তাও আবার সীমিত সময়ের জন্য। আনলিমিটেড আড্ডা সে সুযোগ তো নেই, এ প্রজন্মের শিশু কিশোরদের। মাসিক কিংবা দ্বি মাসিক আড্ডার সেলফিগুলো নিউজ ফিড ঘুরে বার বার। এছাড়া কখনো চ্যাটে, ভিডিও কলে চলে প্রাণহীন আড্ডা। যেনো প্রাণের আড্ডা আজ আধুনিকতায় বিলীন হয়ে গেছে।
দেড়যুগ আগেও আড্ডায় বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে মান অভিমান হতো। আমরাই কেউ না কেউ আবার তা ভাঙ্গিয়ে দিতাম। যাতে করে আড্ডার প্রাণ না কমে। আর এখন মান অভিমান হলে মিলিয়ে দেওয়ার কেউ থাকে না। কারণ রাগ হলেই ব্লক, জানি আমি আর তুমি। ফলে সম্পর্কগুলো যতো দ্রুত গড়ে উঠে, ততো দ্রুত ভেঙ্গে যায়।
আবার ২/৩ জন রেস্টুরেন্টে ২ পরটা আর এক কাপ চা খেতে খেতে গল্প করার সময় তোলা সেলফিগুলোই এখন আড্ডা নামে পরিচিতি পাচ্ছে। ঘাসের সবুজ গালিচা, কিংবা বালুতে বসে ‘মাস্তি’ এটা নতুন প্রজন্ম অনেকটা রূপকথার গল্প মনে করে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু শুধু প্রযুক্তিপ্রেমী হয়ে আড্ডাবাজরা এখন মানবপ্রেমী হতে ভুলে গেছে। বন্ধু-বান্ধবের ভালোবাসা এখন আর টানে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এ ব্যস্ততা আমাদের আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে। এখন আর আমরা অন্যের সুখে হাসি না, অনেক দুখে কাঁদাতো দুরের কথা।
বি.দ্র. : সিলেটের পূর্ব শাহী ঈদগাহর কালাপাথর মাঠ। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক তারকা রাজীন সালেহ, অলক কাপালী, তাপস বৈশ্য, জাতীয় ফুটবল দলের ইয়ামিন চৌধুরী মুন্নাসহ অনেক খেলোয়াড়ের কাছে তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত। চা বাগান লাগোয়া এ মাঠে হাত পাঁকিয়ে দেশের পতাকা তুলে ধরে তারা। আজ ৩ নভেম্বর ২০১৮ । রাজিন সালেহ সব ধরণের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের টেস্ট অভিষেকের অনুষ্ঠানে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৩০