বাড়ছে রাত। শেষ বাসও ছেড়ে দেবে কিছুক্ষণের মধ্যে। টিকিট হাতে এদিক ওদিক তাকিয়েও অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে না। ভেতরে ভয় থাকলেও চেহারায় সামান্যতম ছাপ যাতে ফুটে না ওঠে তার চেষ্ঠা চলছে ভেতরে অবিরত। রাতের মধ্যেই ছাড়তে হবে এ শহর। শহরটা আর টানছে না রিফাতকে। নানা জটিল সময় পার করা এ শহরটার জন্য আলাদা মায়া জন্মে গেছে মনে। হাজার হোক জন্ম শহর বলে কথা।
রিফাত সাত্তার। মাস্টার্স পড়–য়া ছেলে। সদা হাস্যেজ্জ্বল যুবকটি জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে বাড়ি ছেড়েছে। জোৎ¯œায় ¯œান করতো প্রতিরাতে। ধবধবে রূপালি জোৎ¯œাকে ভালোবেসে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে-এমন বিশ্বাসে তার চিড় ধরেছে। সমাজের স্বাভাবিক ¯্রােতধারার বিপরীতে চলতে গিয়ে বুঝেছে তাকে দিয়ে কিছুই হবে না। তবে এমন কিছূ করতে হবে যাতে সমাজের ¯্রােতধারার বিপরীতেও তার জোৎ¯œাপ্রেম আর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়। অনেকে সমাজটাকে ঘুণে ধরা বললেও রিফাত কিন্তু মনে করে সমাজটা এতটাই নিচে নেমে গেছে ঘুণ পোকাও সমাজটাকে ধরতে ঘৃণা করে। তাই বলে নিজেকে সাধু সন্ন্যাসী সেজে সমাজের ত্রাতা হবে এমন কথা তার কোনো দিনই মনে আসে না। তবে সমাজটাকে বদলে দিতে হলে আগে নিজে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। আর এ শক্তির খোঁজে জন্ম শহর ছাড়ছে সে।
বাসের হর্ণের শব্দে ধীরলয়ে এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। জোৎ¯œাকে ভালোবাসে বলেই আকাশের দিকে তাকালো রিফাত। মেঘে ঢাকা চাঁদের একাংশ দেখা যাচ্ছে। যেনো অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হচ্ছে তাকে এ শহর থেকে।
রাত গভীর হচ্ছে। বাড়ছে বাসের গতি। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে চিন্তার স্্েরাত। কাউকে না জানিয়ে শ্রেফ বেড়ানোর কথা বলে শহরটাকে বিদায় জানানো কি ঠিক হলো। চিন্তার সাগরে ডুব দিলো, ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসছে চোখের পাতা।
আচ্ছা মানুষের জীবনটাতো নদী কিংবা বটগাছের মতো। সাধু সন্ন্যাসীরা একের পর এক মানুষের ভালো করে যাচ্ছেন। বিপরীতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদাররাও তো কাজ কিছু মানুষের উপকার করছে। তাদের অধীনে যারা বিভিন্ন অপকর্ম করে থাকে, তাদের পরিবার পরিজন তো ন্যূনতম বাঁচতে পারছে কর্তার রোজগারে। এ বাঁচাকে কি বাঁচা বলা যায় ? যাবে না কেনো, তারা তো জানতে চাইছে না কর্তা কি করে ? কেউ কেউ জানতে পারলেও বিকল্প না থাকায় এটার উপরই ভরসা রাখতে হচ্ছে। তবে কি অপরাধী আর সাধু সন্ন্যাসীরা এক কাতারে চলে যাচ্ছে।
হাটতে হাটতে রিফাতের নজরে পড়লো কিছু মানুষের জটলা। পিছিয়ে যেতে গিয়েও পারলো না। কোনো এক আকর্ষণে সে এগিয়ে গেলো জটলার দিকে। সুঠাম দেহের রিফাত ভীড় ঠেলে একটু সামনে গিয়ে দেখলো সাধু টাইপের এক লোক বিভিন্ন মানুষের হাত দেখে ভবিষ্যত বলছে।
‘মাগো তুমি তো রাজকপাল নিয়া আইছো। তোমার হাতের রেখায় সুখের কথা লেখা আছে।’ দুঃখী চেহারার মধ্যবয়স্কা নারীর হাত দেখা শেষে সাধু টাইপ লোক এ কখা বলেন। দীর্ঘশ্বাস আসতে গিয়ে আসলো না মহিলার। আনন্দে ঝলঝল করে উঠলো তার চেহারা।
‘তোর মনের আশা পূরণ হইবো, তুই যেখানে কাজ করছ সেখানকার মালিক হবি তুই। বাপধন তুই কি করছ ?
‘আমি রিক্সা চালাই’
তাইলে তুই রিক্সার মালিক হবি। তোর হাতে লেখা আছে একথা।’
ভিড় ঠেলে চল্লিশোর্ধ এক ব্যাক্তি হাত বাড়ায় সাধু বাবার দিকে। ‘তুই তো মালিক হবি। তোর হাতে স্পষ্ট করে লেখা যে কাজ তুই করছ, তাই তোকে জড়ায়ে ধরবে।’
হু হু করে কেঁদে উঠেন তিনি। বলেন, আমার পোলারে বাঁচাতে পারমু না আমি। আমি কবর খুড়ি। আমি কবরে গেলে আমার মা মরা ছেলেটা বিনা চিকিৎসায় মরি যাইবো। আমি খাইয়া না খাইয়া কষ্ট করি পোলাডারে চিকিৎসা করাই।’
লাঠি হাতে এগিয়ে এলো এক শীর্ণ দেহের বৃদ্ধা। ‘আমি কি করবো বাবা, এক পা কবরে আর এক পা মাটিতে তারপরও মরণ আসে না। পোলা মাইয়া খাবার দেয় না। নিজেও চলতে পারি না। বৃদ্ধাশ্রমেও যাইতে মন চায় না।’
‘কষ্টের পর সুখ আসে। রাতের পর যেমন দিন আসে তেমনি তোমার কষ্ট কাটবে।’
ধীরে ধীরে সাধু বাবা বাড়ির দিকে এগিয়ে যান। কেনো যেনো রিফাত তার পিছু নিলো। এ গলি ও গলি পেরিয়ে রেলস্টেশন এলাকা দিয়ে হাটছেন তিনি। হঠাৎ ডানদিকে ছোট্ট খুপরী ঘরে উঁকি দিলেন তিনি। মনে হলো কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছেন তিনি। রিফাতও এগুলো, হঠাৎ চিৎকার!!!
‘বুইড়া আইছে। সারাদিন মানুষেরে উপদেশ বিলায়ে, পেট খালি কইরা আইছে। এখন গামলা ভইর্যা খাইবো।’ থতমত খেয়ে সাধুবাবা, আরো ধীর গতিতে ঘরের ভেতর ঢুকেন। এমন সময় ছোট্ট এক শিশু দাদা, দাদা করে দৌড়ে কোলে এসে উঠে। ধীরে ধীরে হাসি প্রসারিত হয়। শুরু হয় দু’প্রজন্মের খুনসুটি। রিফাত ফিরতে যাবে...
‘কোথায় যাও’-সাধু বাবা হাঁক ছাড়েন। আমার পিছু নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত এসেছো। ‘তুমি কে, কোথায় থাকো, কি করো ?’
এগিয়ে যায় রিফাত। দু’প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি তার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রয়েছে। সাধুবাবা বললেন, জীবন থেকে পালিয়ে লাভ নেই। তুমি তোমার মতো পৃথিবী কখনো পাবে না। পলাতকদের হাতে বিপ্লব ধরা দেয় না। অস্ত্র নিয়ে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। বাইরের রূপ দেখে কাউকে বিচার করা ঠিক না। পৃথিবীতে অন্ধকার কোনো সময়ই স্থায়ী না। আলোর স্পর্শে অন্ধকার কেটে যাবে।
‘বাবা, সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরেন, নাতিকে রেখে হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নিন।’ আবার সেই কন্ঠ, তবে মোলায়েম ভালোবাসায় ভরা।
এবার ভিমড়ি খায় রিফাত। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে আমূল পাল্টে গেলো সবকিছু। যে একটু আগেও কর্কশ স্বরে কটু কথা বলেছে, তার কন্ঠেও শ্রদ্ধা। ভালোবাসা এমনই। কখনো তেতো কখনো মিষ্টি। ভাবনা পাল্টে যায় রিফাতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালোবাসার সমষ্টিই সমাজ। এই সমাজে কখনো ঘুণ ধরার কথা না, ভালোবাসার কারণেই...
দিপু সিদ্দিকী, সিলেট ২৭.১১.১৩ রাত ০১.৫৭
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩৩