ঈশপকে মাঝে মাঝে বাজারে নিয়ে যাই। ও মুরগী দেখে বলে, “মুরগী কক কক করে ডাকে।” নেটে সার্চ দিয়ে মুরগীর ছবি দেখে। কোনোভাবেই আমি মানতে পারি না- যে মুরগিটিকে ও ভালোবেসে তার ডাক নকল করছে, সেটিকেই আবার কেটে খাবে!
অামি কখনো বলি না, এটা মুরগীর মাংস বা কিছু, বলি, মাংস খাও বা মাছ খাও। নাম বলি না। এটা তো সভ্যতার একটা সমস্যা যে আমাদের হত্যা করে বাঁচতে হয়। তবে সেটি শিশুদের সামনে কোনোভাবেই করা চলে না। ওদের সেটি বলা চলে না। চলে কি?
শুধু দেবদেবীর সামনে বলি দেওয়ার সময় নয়, এমনিও বাজারে গিয়ে এই জিনিসটা দেখতে আমার ভালো লাগে না, আবার এও বুঝি যে আমি যেহেতু মাছ-মাংস খাই তাই এ মায়া মানবিক হয় না খুব একটা। প্রকৃতিতে এ হত্যাকাণ্ড আছেই, এবং সেটি প্রাকৃতিক নিয়মও।
প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ হিসেবে আমরা কি শুধু প্রাকৃতিক জীবনযাপন করি, নাকি অনেক কিছুই আমরা নিয়ম করে নিয়েছি মানব সৃষ্ট সভ্যতার প্রয়োজনে? প্রাণীরা তো প্রকৃতিতে সংগমের কাজটিও প্রকাশ্যে করে, আমরা কি তাই করি? করি না, অর্থাৎ মানুষ হিসেবে আমাদের আলাদা বৈশিষ্ট আছে, আমরা যেমন প্রকৃতির সৃষ্টি আবার অামাদেরও অনেক সৃষ্টি আছে।
এ কারণেই মানুষ বিচার করে, ভাল-মন্দ নিয়ে বিতর্ক করে। কালি পূজোয় পাঠা বলি দেওয়া নিয়ে কথা ওঠে, মানুষ বলেই আমরা এটা নিয়ে কথা বলি। আমরা বুঝি, হল্লা করে হত্যা করা যায় না। ঈশ্বররূপ কিছু কল্পনা করতে হলে এটা ভাবা অনৈতিক যে তিনি তা (বলি) চাইতে পারেন। ঈশ্বর এরকম রক্তলোলুপ হতে পারে না, হতে পারে কি?
অাসলে প্রাগঐতিহাসিক যুগে বলি প্রথার প্রয়োজন ছিল। একসময় পশুপালনই ছিল মানুষের অন্যতম জীবিকা। মুদ্রা ব্যবস্থা যখন ছিল না তখন পশু ছিল অন্যতম বিনিময় মাধ্যমও। ফলে অনেক সময় একসাথে অনেক পশু বলি দেওয়ার প্রয়োজন পড়তো। আবার এ রক্তারক্তি কাণ্ডে মানুষের দ্বিধাও ছিল। ঈশ্বরের নামে করায় সে দ্বিধা খানিকটা তারা কাটাতে পেরেছিল হয়তো।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, একসময় ধনী মানুষ বলতে বুঝাতো যার অনেক পশু ছিল। বছরে একবার সেখানে থেকে কিছু বলি বা কোরবানি দিয়ে মানুষকে বিলিয়ে দেওয়া ভালোই ছিল। এখন অবশ্য দেওয়ার মত অনেক কিছু আছে, তারপরও প্রথাটা রয়ে গিয়েছে।
বিশেষ করে টাকা আবিষ্কার হওয়ার পর কাউকে পণ্য দেওয়া আর লাগে না। কারণ, টাকা দিলে ব্যক্তি তার পছন্দমত প্রয়োজনীয় পণ্যটি কিনে নিতে পারে। তাই, বলি বা কোরবানী দিয়ে মাংস বিলিয়ে দেওয়ার বিষয়টি এখন আর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু নয়।
তারপরেও পৃথিবীতে ধর্ম এখনো খুব প্রভাবশালী। কতটা প্রভাবশালী তার প্রমাণ ধর্ষক-লম্পট-খুনি এবং একইসাথে ধর্মগুরু রামরহীম সিংহ।
সভ্যতার সবচে বড় সংকট হচ্ছে- ধর্মান্ধতা। ধর্মান্ধতা আছে বলেই এরকম ধর্মগুরু আছে। এখনো পৃথিবীর বহুদেশে মানুষ ধর্মের নামে একত্রিত হয়, এবং কাউকে কাউকে এরা এমনভাবে ফলো করা শুরু করে যে ঐ নির্দিষ্ট ব্যক্তি অনেক সময় সকল আইনের উর্ধে চলে যায়।
আমাদের দেশেও বিষয়টি চরমভাবে দৃশ্যমান। সাঈদীকে চাঁন্দে দেখা নিয়ে কম কাণ্ড হয়নি। মারাও গিয়েছিল অনেক লোক! উচ্চ আদালত তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি বলেই ধারণা করায় যায়।
বলতে চাই- যে ঈশ্বরের নামে ধর্ষক আসকারা পায়, খুনি পার পায়, যুদ্ধাপরাধী ছাড়া পায়; যে ঈশ্বরকে পাঠা, মহিষ বা গরু বলি দিয়ে তুষ্ট করা লাগে, সভ্যাতার দাবী হচ্ছে সে ঈশ্বরকে আমরা ত্যাগ করতে চাই, আমরা চাই মানবিক-সুন্দর-পরিশিলীত-প্রেমিক এক ঈশ্বররূপ।
প্রাণীর সামষ্টিক সত্তা হিসেবে এমন এক ঈশ্বর রূপ আমরা কল্পনা করতে চাই যার নামে ঘৃণা, সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা, হত্যা -এসব প্রশ্রয় পাবে না, যার নামে মানুষ লোভী হয়ে উঠবে না, যার জন্য বাধ্য হয়ে প্রার্থনায় বসার প্রয়োজন পড়বে না, যার নামে মানবজাতি খণ্ডিত হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ৯:৫৮