গত বছরের কথা, একদিন ঢাকা পরিবহনে করে মতিঝিল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। পাশের সিটে একজন ভদ্রলোক বসা, কিছুক্ষন পর পর ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন। একসময় উনার সেধেই আলাপ করলাম। প্রথমেই নাম জিজ্ঞেস করলাম। সাথে আমার নামও জানালাম। বললাম, আপনি কি মতিঝিলে চাকরি করেন? বললো, হ্যা ভাই আমি শ্রম মন্ত্রণালয়ে চাকরি করি। এরপর আরও কিছু আলাপচারিতা চললো। মূল পর্বে চলে গেলাম, তাকে জানালাম ভাই আমি বেকার চাকুরী খুজতেছি, আর এক দুই বছর আছে সরকারী চাকুরীর বয়স, কি করি এখন।
উনি বললেন, চেষ্টা করতে থাকুন, হয়ে যাবে। আমারও এরকম অবস্থা হয়ে ছিলো আমি চাকুরিটা পেয়েছি যখন সরকারি চাকুরীর বয়স আর মাত্র আড়াই মাস আছে তখন।
এবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই অর্থমন্ত্রী যে বেতন স্কেল দিয়েছেন সে ব্যাপারে আপনি কি বলবেন? (গত বছরের কথা)
উনি বললেন, খুব স্ট্যান্ডার্ড স্কেল।
বললাম, ভাই জানেন এটা গরিব মারার স্কেল!!
কেন ভাই, আপনার এমন মনে হলো?
আপনি জানেন, এই বেতন স্কেল প্রণয়ন করলে বাজেটে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে, ভ্যাট আর ট্যাক্স বেশ পরিমান আদায় করতে হবে, বাজারে প্রত্যেকটা দ্রব্যের দাম বাড়বে।
দাম বাড়বে কিন্তু সমস্যা নাই!
কেন সমস্যা হবেনা?
দেখেন একজন গার্মেন্টস শ্রমিক তারা হাজবেন্ড ওয়াইফ মিলে চাকুরী করে মাসে ১৬-১৮হাজার টাকা কামায়। তাহলে বলেন কোনো সমস্যা হবে কিনা।
ভাই যার ওয়াইফ নাই, একলা পুরো ফ্যামিলি চালায়, সেতো হিমশিম খাবে আর একটাকা সঞ্চয় করতে পারবেনা।
না ভাই আপনি এটা ভুল বলছেন, এমন আমি কখনো দেখি নাই।
বুঝলেন তো ব্যাপার টা, উনি উনার মত করে পৃথিবী দেখেন। তার মানে সরকারি চাকুরী যারা করেন তাদের মতে দুনিয়ার সবই সহজ, সুন্দর, কোনো অভ্যন্তরীণ সমস্যা নাই।
আমাদের অর্থমন্ত্রী সাহেবেরও একই অবস্থা হয়েছে, উনি নাকি জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট দিয়েছেন। উচ্চাভিলাসী বাজেট। মানুষ মারার জন্য শ্রেষ্ঠ বাজেট (অনেকেই একমত হবেন না মনে হয়)।
বাজেট কাকে বলে এক নজরে দেখে নিই-
একটি নির্দিষ্ট সময়ে সাধারণত এক বছরে সরকারের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব বিবরণীকেই বাজেট বলা হয়। বাজেটে সরকারের আয়ের বিভিন্ন উৎস এবং ব্যয়ের বিভিন্ন খাত লিপিবদ্ধ থাকে এবং সরকারের একটি নির্দিষ্ট সময়ের আর্থিক পরিকল্পনার সুষ্ঠু প্রতিফলন থাকে। বাজেট সম্পর্কে অনেকেই মতামত দিয়েছেন যেমন : অধ্যাপক জন এফ ডিউ বলেন, ’A budget is the real sense of the term is a financial plan for a specified period of time.’
সংজ্ঞা সূত্র: একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির অর্থনীতি দ্বিতীয় পত্র।।
আমার এক কাকার সাথে বাজেট নিয়ে আলোচনা করছিলাম অনেক দিন আগের ঘটনা। উনি বললেন, বাংলাদেশের বাজেট হলো মানুষ মারা বাজেট। একটু কৌতূহল হয় জিজ্ঞেস করলাম কেন কাকা?!
কাকা বললেন, দেখ আমেরিকায় কৃষিতে ১০০% ভর্তুকি দেয়। এদেশে কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া হয় না, বা কোনো এক সময় দিতো এখন বন্ধ করে দিয়েছে!
আমাদের আগামী বাজেটে ভর্তুকি ও প্রনোদনায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৯ হাজার ৪৫৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এবং বরাবরের মতই এবারও কৃষিতে ভর্তুকি নেই। কৃষিতে ভর্তুকি নেই কেন কেউই এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না!! বেশিক্ষন ডিবেট করলে, হেফাজত, থেমিসের মূর্তি, বনানীর ধর্ষণের ঘটনা ঢুকে যাবে। তখন আর বাজেট মাথায় থাকবে না!!
অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বলেছেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলেও কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না! আবার বিদ্যুৎ বিলেও এখন ৫% বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে ৭.৫% দিতে হয়, নতুন হারে দিতে হবে ১৫%করে, অর্থমন্ত্রী এসব বিষয়ে সোজা সাপ্তা উত্তর দেননি, এড়িয়ে গেছেন। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে দেয়া উনার বক্তব্য থেকে জানা।
অর্থ মন্ত্রী বলেন, ৩০ লাখ ৮০ লাখ টাকা টার্ণওভার (বার্ষিক লেনদেন) হলে ৩ শতাংশ হারে নেয়া হতো, এখন ৩৬ লাখ টাকা থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভার কর নেয়া হবে ৪ শতাংশ। তার মানে আগে কর দিতেন এখন অনেককেই কর দিতে হবে না। আর ৮০ লাখ টাকার বেশি টার্নওভার হতো এ সংখ্যা কম ছিল না।। আর এ কারণেই বলছি যে জিনিস পত্রের দাম বাড়বে না। (উনি বাজার ঘুরে বুঝে উল্টে ফেলেছেন)।
৪ লাখ ২৬৬ কোটীর বাজেট প্রস্তাব করেছেন, এ বাজেটে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর করের চাপ বাড়বে। সকলেরই খুঁটিনাটি ঘাটানো উচিত যে এই অর্থ কথা হতে আসছে, কিভাবে আসবে, কিভাবে ব্যয় হবে, কোন কোন খাতে ব্যয় হবে!! অতিরিক্ত করের বোঝা মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্তদের বহন করা একদম সম্ভব হবে না।
এখন, একটু ছোট করে তুলে ধরি কোন কোন খাত হতে অর্থায়ন করা হচ্ছে,
রেস্তোরাঁয় খেলেই ১৫% ভ্যাট যেসকল রেস্তোরাঁ সাজানো, এসি বা পাখা ঘুরে ওমন রেস্তোরাঁয়, পাখা নেই চারপাশে দেয়াল নেই ওমন অস্থায়ী রেস্তোরায় নয়। তবে আমাদের এখন ওখানেই যেতে হবে।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভ্যাট আছে। ১৫% ভ্যাট বসতে পারে, তবে এখন ফি এর উপর মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ভ্যাট আরোপ করা হবে না।
বারবার ভারতে গিয়ে কেনা কাটায় কর দিতে হবে। জানি না অনেক এ প্রস্তাব মানবে কি না!!
পুঁজি বাজারে ভ্যাট নেই! সব ধরণের সেবায় মূসক অব্যাহতি থাকছে আগামী বাজেটে। হয়তো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে এজন্যই।
জনসংযোগ সেবায় উৎসে কর।
সম্ভবত একদিন জনসংযোগ বিচ্ছিন্ন হবে করের চাপে।
টিআইএন লাগবে ৩১ কাজে, যেমন মোবাইল ব্যাংকিং, রিচার্জ ব্যবসা, পরিবেশক এজেন্সি, ক্যাটারিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, জনবল সরবরাহ ইত্যাদি।
এবার ছোট করে তুলে ধরি কোন খাতে বাজেটের বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে,
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ খাতে ২১ হাজার ১১৮ কোটি টাকার বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই বরাদ্দ প্রস্তাব চলতি অর্থবছরের তুলনায় টাকার অংকে ৬ হাজার ৫৫৭ কোটি এবং শতাংশের হিসাবে প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি। এরপরও লোডশেডিং ছুটবে না, রামপাল নিয়ে দ্বন্দ থেকেই যাবে।ঐ প্রসঙ্গে যাব না।
সামাজিক সুরক্ষায় যেমন বয়স্ক ভাতা ভোগীর জন্য ৩১ লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩৫ লাখ করা হবে। প্রতিবন্ধীদের জন্য আগামী অর্থবছরে ১হাজার ১৭কোটি টাকা বরাদ্দ করেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে বেতন-ভাতায় ৫৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটে এ বরাদ্দ ৫০ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেটে ৪৯ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা।
সুদ পরিশোধের জন্যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ সুদ ৩৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা ও বিদেশি ঋণের সুদ ১ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটে তা ৩৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেটে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছিলো।
(সব তথ্য সংগ্রহকৃত)
এই সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বাজেটের পরে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হল, যাদের ব্যাংকে এক লাখ টাকা আছে তারা সম্পদশালী,তাই ঐ টাকার উপর বাড়তি কর আরোপ করা হয়েছে। উনি যে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে গেছেন কোন সন্দেহ নাই। আর যদি কেউ বলেন যে না উনার মাথা ঠিক আছে তাহলে বলেন এক লাখ টাকা যার আছে সে সম্পদশালী হয় কিভাবে। আপনার কাছে এক লাখ টাকা ব্যাপার না, কিন্তু আমাদের মত গরিব মানুষের কি হবে যারা এক লাখ টাকা ভবিষ্যতে কোনো কাজের জন্য জমিয়ে রাখেন, এখন এই টাকার উপর যদি আবগারি শুল্ক ধরে তাহলে কি উপায় হবে জানেন কি?!
সামনের বছর রিক্সাওয়ালার কাছে কর দাবি করবেনা তা কি কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারবেন?
সরকার এমন একটা অবস্থা করেছেন যে আমরা সাধারন মানুষ ভ্যাট, ট্যাক্স, আবগারি শুল্ক অন্যান্য কর এর বেড়াজালে পুরো ফেঁসে গেছি। আপনি কিছু কিনতে যাবেন সেখানে ভ্যাট দিতে হবে, বাজারে তৈজস পত্র কিনবেন ভ্যাট দিতে হচ্ছে, বাচ্চা যে কৌটোর দুধ খায় সেখানেও ভ্যাট। আপনি বসবাস করছেন তার উপর ট্যাক্স, খাজনা ইত্যাদি আনুসাঙ্গিক কর দিতে হচ্ছে। আপনি ব্যাংকে টাকা রাখবেন সে উপায়ও শেষ, একলাখ টাকা রাখলে সেখানেও আবগারি শুল্ক দিতে হবে। তার মানে আমাদের শেষ পর্যন্ত মরণের উপায়ও শেষ হয়ে যাবে। মানে যদি কেউ মারা যায় তাহলে তাকে সব কর মিটিয়ে তাকে কবরে সমাধিত করা, বিশ্বাস না হয় তো সামনের বছরের জন্য অপেক্ষা করেন। এমন অবস্থা হয়েছে যে আপনি ঘুম থেকে উঠবেন উঠেই ভ্যাট আর ট্যাক্সের সাথে ধাক্কা খাবেন।
একটা তথ্য দিই, আমাদের অর্থমন্ত্রী ইংরেজিতে অনার্স পাশ। আর তিনি দশ বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী। আমি এও শুনেছি যে উনি সচিব পর্যায়ের অনেক বড় আমলা ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি দেশের অর্থনীতি কে শেষ করে দিয়েছেন। মানুষ বলে শত্রুরও অমঙ্গল কামনা করতে নেই। আমি কামনা করি উনি যেন খুব দ্রুত অন্তত বাজেট পাশের আগে বিদায় নেন। আমরা ভাই কষ্ট করে খেটে খাওয়া মানুষ ডাকাতের অধীনে থাকা নিরাপদ নয়।
শেষে বাজেট নিয়ে একটা কৌতুক বলি, এক বয়স্ক লোক এক ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছে কিরে এবার বাজেট কেমন হলো?
ছেলেটা- বাজেট থেকে শুধু "ট" টা সরিয়ে ফেললে যেমন হয় আরকি। (রণবি'র চোখ থেকে)
বেশ বড় হয়ে গেছে পোষ্ট মাফ করিবেন।
ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর মার্জনার দৃষ্টিতে দেখবেন।
বাজেট শুভ হোক, জনগণের সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাক, সবাই ভালো থাকুন...
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৭ রাত ১০:৩১