অল্পকিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে বিছানা নিয়েছিলাম।
সারাদিন একপ্রকার শুয়েই কাটাতাম। তখন পরিচয় হয় খুবই ছোট্ট আর অপ্রয়োজনীয় একটা মানুষের সাথে যে কখনও আমাদের মত দোলনায় শুয়ে শুয়ে দোল খায় নি! একটা নতুন জামা যে কিনা হয়ত শুধু দোকানেই ঝুলতে দেখেছে। যাকে নিয়ে তার মা অনাহূত আবেগ দেখায় না! যার কিনা শিশুবেলার প্রতিটা দিন কাটে ধূলায় ধূসরিত হয়ে! অথচ তার মধ্যেও আছে বিবেকের তাড়না, তীব্র অপরাধবোধ, চক্ষুলজ্জা আর বিনয়।

এই আমাদের টোকি!!

টোকি ওর নাম না। নিকটা আমাদের ভাইবোনদের দেয়া।

লক্ষীপুর অঞ্চলে চকলেট, টফি কে গ্রাম্য-ভাষায় টোকি বলে।

তাই পিচ্চিটার নাম ফাহমিদা হলেও আমরা তাকে টোকি বলেই ডাকি! কারন সে টোকির মতই সাইজে ছোট্ট আর মিষ্টি!!

সেদিন অনেক বেলা করে ঘুম ভাংগল টোকির ছোট্ট মুখের কিছু আধো-বুলি শুনে। তাকিয়ে দেখি ওয়াশরুমের দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকা ছোট্ট একটা বাচ্চা।


কারো দয়া করে দেওয়া পুরনো, মলিন একটা বেবি-ফ্রক পরা। বয়স কত হবে?! আনুমানিক ৫! অথচ তার মার সাথে ক্রমাগত বকে যাচ্ছে তো বকেই যাচ্ছে....যেন একটা পিচ্চি পটকা!


তার মা আমাদের বাসায় নতুন। ঐ খালা আমার মাকে বাসার কাজে সাহায্য করেন। তিনি কাপড় ধুচ্ছিলেন।
বাচ্চাটা বকের মত একপায়ে ভর দিয়ে দরজা ধরে কোমরে হাত দিয়ে তার ব্যস্ত মাকে প্রশ্ন করছে...
টোকি: তুমি হেনো কাপড় ধুইতে আইছ??

খালা: হুম।
টোকি: কেন?? হেরা ধুইতে পারে না?

খালা: হুম।
টোকি: বাসাত যাইবানা?

খালা:হুম।
টোকি: এইখানে সকালে আইছ, আবার বিকালে আইবা??

খালা:হুম।
টোকি: এতবার আস কেন??নানীর কাছ তে ছুটি নিতে পারনা??

খালা:চুপ।

আরো অনেক প্রশ্ন। এবং প্রতিদিনই সে তার মাকে মোটামোটি একই প্রশ্ন করে!!!

কেন আমাদের বাসায় এতবার আসে আর কেন আমরা তার মাকে দিয়ে এত কাজ করাই?!?!?! কেন ছুটি দেইনা?!?!


তার শিশু মনের এই সরল জিজ্ঞাসাগুলো তার খেটে খাওয়া মা দিতে পারেন না! তাই হয়ত মেয়ের আধো-মুখের কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন হুম-হাম করে।


তো যাই হোক! এভাবে টোকি তার মায়ের সাথে প্রতিদিন আমাদের বাসায় আসে! কিন্তু কখনও কিছুতে হাত দেয় না। দুষ্টুমি করেনা। শুধু দাড়িয়ে মায়ের কাজ দেখে আর মাকে ঐ প্রশ্নগুলো করে যায়।


মাঝে মাঝে আম্মুর কাছে আপিল করে তার মাকে তাড়াতাড়ি ছুটি দেওয়ার জন্য!

তার পার্সোনালিটি আবার অনেক স্ট্রং।

সেদিন আমি তাকে নাশতা খাবার সময় একটা পরোটা আর এক টুকরো মুরগি নিয়ে খেতে দিয়েছিলাম। ভাবলাম ছোট মানুষ একটা! আমি খাব আর ও চেয়ে দেখবে; কেমন অস্বস্তিকর।

ওমা!!!!! না!!!!...সে খাবেনা!!


যতই দিলাম সে নেবে না!!

পরে খালা বললেন ও নাকি এভাবে কিছু খায় না! লজ্জা পায়!

আমার সাথে ওর তেমন সখ্য নেই! আমাকে দেখলেই পালিয়ে যায়!

এত ডাকি...কাছে আসে না!


অথচ বাচ্চাটা এত ডিফরেন্ট যে এত মায়া লাগে!!
এর দুদিন পরের ঘটনা!
কেন যেন ও বারান্দায় দাড়িয়ে সমানে কাঁদছিল। আর বারান্দা এ মাথা থেকে ওমাথায় যাচ্ছিল। নিচে তাকাচ্ছিল বার বার!
আমার আম্মু, ছোট বোন তার মা জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে??
আমার ছোট বোন যতই জিজ্ঞেস করছিল উত্তর না দিয়ে কেঁদেই যাচ্ছিল! বেশ ভীত দেখাচ্ছিল!!
কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করছিল নিচে যাব নিচে যাব বলে।
ওর মা বলল কেন???? সে বলে চল নিচে এক্খন!
খালা বললেন আমি যাইতে পারুম না!কাম আছে!
তারপর সে ফুপিয়ে কান্না করতে লাগল!!
সেকি কান্না!!

আমার মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে বলল নানী দরজা খুইলা দেও আমি যাবাম!
আম্মু ওর চোখের পানি দেখে দরজা খুলে দিলেন।

যাই হোক আমরা বারান্দা দিয়ে দেখলাম নিচে গিয়ে সে একটা গেইট ধরে দাড়িয়ে থকল।
কেঁদেকেটে কিছু খোঁজার চেষ্টা করল! কলোনির ছেলেদের সিটিং ছিল ওটা! ওরা না থাকলে তালা দেয়া থাকে। তাই গেইট দিয়ে বেচারি উঁকি দিয়ে কেঁদেই চলল! এভাবে ১৫-২০ মিনিট!!!!!!


যতই ডাকি ওপর থেকে সে পাত্তা দেয় না!!!
পরে দেখলাম একটা ছেলে কান্না দেখে গেইট খুলে দিল।
তারপর সে নানারকম আবর্জনা থেকে কি যেন একটা খুঁজে নিয়ে এল।


বাসায় ঢুকে কারো সাথে কোন কথা না বলে সরাসরি যেখানে ছিল সেখানে রেখে পালিয়ে গেল।
দেখুন সেই রত্ন!!



এটা সে খেলতে গিয়ে ফেলে দিয়েছিল যেটা আসলে আমার হেয়ার ব্যান্ড ছিল!


তাই আমার ভয়ে লজ্জায় বেচারির প্রাণ ওষ্ঠাগত।


ভেবেছিল হয়ত এটার জন্য আমি তাকে শাস্তি দিতে পারি!



আর তাই বাচ্চাটি চক্ষু লজ্জায় আর অপরাধবোধে এত বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল!


এত ছোট অপরাধ করেও এত পার্সোনালিটি আর এত অপরাধবোধ!

আর আমরা এত বুড়া বুড়া ধামড়াগুলা..........।


থাক! পোস্টকে দীর্ঘায়িত করে সে কথায় আর না গেলাম!

ছোট্ট টোকির জন্য শুভকামনা!!

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৩৫