রশীদুলের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়। গ্রামে যে জমিজিরেতটুকু ছিল গ্রাম্য কোন্দলের কারনে বেচে দিয়ে জীবন আর জীবিকার তাগিদে স্ত্রী আর ৩ ছেলে-মেয়েকে নিয়ে এসে আমাদের এই নোংরা ব্যাস্ত শহরের মান্ডার এক সংকীর্ণ গলিতে নামমাত্র ভাড়া দিয়ে উঠেছিলেন তিনি।
সংকীর্ণ গলিতে থাকলেও মনের দিক থেকে রশীদুল মোটেও সংকীর্ণ নন! পেশায় একজন লোকাল-বাসের ড্রাইভার হলেও স্বপ্ন দেখতেন অনেক বড়। ক্লাস এইট পাশ করা মানুষটি নিজের বড় ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর স্বপ্ন দেখেন যে কিনা বাবা মায়ের বার্ধক্যে তাদের দু:খ মোচনের ভার নেবে।
তার আরেকটি স্বপ্ন; নিজের একটি বাস হবে। তাই ভিটেমাটি বিক্রির টাকা আর কিছু জানাশোনা থাকার কারনে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে শেয়ারে একটি পুরাতন বাস কেনেন।
ড্রাইভিং তার পেশার চেয়েও বড় নেশা। তাই বাসটা নিজেই চালাতেন। দ্বৈত মালিকানার অংশ আর সুদের টাকা পরিশোধের পর অনেক কষ্টে ছেলেমেয়েদের লেখা-পড়ার খরচ যোগান আমাদের এই দিনমজুর ভাইটি। পরিশ্রমের এক একটা দিন বড় কষ্টে কাটছিল মানুষটির। লোকাল বাসটা চালিয়ে যে ক'টা টাকা পান তা দিয়ে এই বাজারে সংসার যে কি উত্তমরূপে চলে তা বোধকরি আপনাদের উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হবে না!
সেদিন সকালে শাহবাগের মোড়ে বাস থামিয়ে যাত্রী নেবার সময় বুঝে উঠতে না উঠতেই একদল ছাত্র তার মুড়ির টিনের মত জীর্ন বাসটির দিকে ছুটে আসতে থাকে। প্রথমে কিছু না বুঝলেও পরে তাদের উদ্ধত ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারেন রশিদুল; নিশ্চয় ক্যাম্পাসে কোন গন্ডগোল হয়েছে। কিন্তু তার বাসটি কিভাবে এই গন্ডগোলের এক অংশ হল তা মাথার ঢোকার অনেক আগেই ছাত্ররা ভাংচুর শুরু করে।
আসন্ন অর্ধাহার আর অনাহারের দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে আসতেই লোকটি হাউমাউ করে কেঁদে অচেনা ছাত্রদের কে তার ও তার পরিবারের প্রতি দয়া দেখাতে বললেন।
দয়া??? কিসের দয়া??? দয়া দেখানোর সময় নেই আমার ছাত্রভাইদের! কারন তাদের প্রিয় সহপাঠি "তারেক" সকালে মারা যায়।
মৃত্যুর কারন ছিল "পূর্বদিগন্ত" বাসের কর্মচারিদের সাথে সংঘর্ষ ও এক পর্যায়ে স্টাফকর্তৃক তারেককে ট্রাকের নিচে ধাক্কা দিয়ে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া।
তাই তারাতো তাদের বিদেহী ছাত্রভাইয়ের আত্মাকে শান্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আর অন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ একটি মহৎ কাজ করছেন। অত:পর ষোলকলাপূর্ণ করে বাসটিতে তারা আগুন লাগিয়ে দিলেন। চারিদিকে কেবলই জ্বালাও, পোড়াও, ভাংগো-ভাংগো রব!
চোখের সামনে নিজের স্বপ্নকে পুড়ে খাক হতে দেখলেন মানুষটি।
(গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক)
গত ৬ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ছাত্র রেদওয়ানের মৃত্যুতে বিভাগীয় ছাত্রসহ অন্যান্য ছাত্ররা বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। যার ফলশ্রুতিতে ছাত্ররা শাহবাগসহ আশেপাশের এলাকায় যানবাহন ভাংচুর শুরু করেন। এ ঘটনায় প্রায় অর্ধশতাধিক যানবাহন ভাঙ্গা হয়। নারীশিশু ভ্রমনরত প্রাইভেট কারগুলো পর্যন্ত এই ঘটনার শিকার হয়।
রেদওয়ান আমাদের মেধাবি ছাত্রভাই। এ ধরনের একটি বর্বর ঘটনার মধ্য দিয়ে তার অকাল প্রায়ানে আমরা শোকাহত। এই ক্ষতি অপূরনীয়।
তাই আমরা সবাই এক হয়ে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারতাম। আমরা চাইলেই অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য বিষয়টাকে আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতাম। আমরা চাইলেই হিমালয় বাস কোম্পানির মালিককে এনে কানে ধরে মাফ চাওয়াতে আর স্টাফদের জুতোপেটা করতে পারতাম। আমরা চাইলে আইনগতভাবে বিষয়টি মিমাংসা হতে পারত। আপনাদের মনে আছে ঢাকা ভার্সিটি এলাকা থেকে সেনাবাহিনীকে তুলে দিতে বাধ্য করেছিলাম? আমরা চাইলেই সুন্দর একটা সমাধান হতে পারত। যদিও রেদওয়ানকে আমরা আর ফিরে পাব না! তবে আর কোন রেদওয়ানের সাথে যেন এমনটা না হয় তা সুন্দরভাবে প্রতিহত করতে পারতাম।
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য আমার ছাত্রভাইদের ছোট করা বা তিরস্কার করা নয়। আমি শুধু একথা বলতে চাই যে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শ্রেষ্ঠ ছাত্র হয়ে আজকে আপনারা এই যে ভাংচুরের মত যে কাজটা করলেন সেটা কি আদৌ ঠিক হয়েছে?
প্রায়ই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাধারন ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এ ধরণের ভাংচুর হয়। যার ফল ভোগ করে সাধারণ মানুষ। এটাকি বিবেকসুলভ?
একবার ভাবুনতো; আজকে যদি গল্পের এই রশীদুল আপনাদের কারো বাবা হতেন তবে কি আপনারা পারতেন বাবার বাসটিকে... তার স্বপ্নকে... পরিবারের বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ঐ বাসটিকে এভাবে বাবার চোখের সামনে বলি দিতে???
একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ কি আমরা আরেকটি অন্যায়ের মধ্য দিয়ে করব?? আজকে ভাবুনতো কতগুলো মানুষের কতগুলো পরিবারের অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে যারা এই অন্যায়ের অংশ নয়, এই শাস্তির প্রকৃতভাগিদারও এই সাধারণ মানুষগুলো নয়।