(এই গল্পের প্রতিটি চরিত্র, ঘটনা ও স্থান, সমস্ত কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়)
শরীর পুরোটা ভিজে গেছে,টপ টপ করে কপাল থেকে ঘাম পরছে বিছানায়। ঘামে 'কাকভেজা' হয়ে গেছেন আলহাজ্ব আবদুর রহমান বদি। ইদানীং ঘনঘন স্বপ্ন দেখছেন, স্বপ্ন না বলে দুঃস্বপ্ন বলাই ভালো হবে। স্বপ্নে দেখেন- তার চোখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা,হাত পেছনে বাঁধা। তিনি কিছু দেখতে পারছেন না। চারপাশে নিকশ কালো অন্ধকার। পাশে কেউ ফিস ফিস করে 'স্যার এই হানে?' একটা গম্ভীর কন্ঠ উত্তর দেয়,"না আরেকটু সামনে যাও। জঙ্গলের দিকটায়। " গাড়ির দুলনীতে বদি বুঝতে পারে গাড়ি ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে কোথাও যাচ্ছে। হঠাৎ গাড়ি থেমে যায়, তাকে টেনে নামানো হয় নিচে। চোখের বাধন খুলে দেওয়া হয়। বদি দেখতে পায়,সামনে কয়েকজন অস্ত্র হাতে নগ্ন হয়ে দাড়িয়ে আছে। বা দিকের সবচেয়ে বেটে জন অস্ত্র তাক করে বলে,স্যার শেষ কইরা দেই? এরপরই বদি ঘামতে থাকে। ঘামে ভিজে জেগে উঠে,দুঃস্বপ্নটা সম্পূর্ণ হয় না। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে তার প্রচন্ড পানির তেষ্টা পায়। ফ্রিজের কয়েক গ্লাস পানি খেলেও সে তেষ্টাটা কমে না। মনে হয় উপর্যুপরি বেড়ে যায়। আগে দুঃস্বপ্নটা অনেকদিন পর পর দেখতেন,এখন প্রায়ই দেখেন। দুঃস্বপ্নটা যেভাবেই শুরু হোক না কেন,শেষটা নগ্ন বেটে মানুষটার অস্ত্র উচিয়ে 'স্যার শেষ কইরা দেই? ' দিয়েই শেষ হয়। এর পরই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। বদির কখনো জানা হয় না বেটে মানুষটার প্রশ্নের উত্তরে 'স্যার' কী বলে। মাঝে মাঝেই বদি 'স্যার' কী উত্তর দিতে পারে অনুমান করার চেষ্টা করে। অনুমান বেশিদূর আগায় না। মানুষ ভীতু জীব। একেক মানুষ একেক জিনিসে ভয় পায়,কেউ মাকরসা,কেউ তেলাপোকা,কেউ কুকুর,কেউ অন্ধকার......। তবে সব মানুষের একটা কমন ভয় আছে। পাগল আর শিশু ছাড়া সবাই মৃত্যুকে ভয় পায়। সে কারনেই বদি স্যারের উত্তর কী হবে তা নিয়ে বেশি ভাবতে পারে না। মৃত্যু ভয়ে ভাবনাগুলো থেমে যায়। বদি চিন্তা করেছে আশেপাশের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করবে স্যারের উত্তরটা কী হতে পারে। বদি তার পিএস রতনকে জিজ্ঞেস করেছিল। রতন সবকিছু শুনে দাত বের করে বলেছিল
-জ্বে স্যার। মেশিন চালানোর অর্ডার দিয়া দিবো। আপনি স্যার যাদের দেখছেন,এরা মানুষ না। এরা র্যাব। এদের কাছে এমপি-মন্ত্রী যেই, রাস্তার ভিক্ষুকও সেই।
স্যার মেশিন চালানোর অর্ডার দিয়ে দিবে,এতে রতনকে মনে হচ্ছে খুবই আনন্দিত। এখনো দাত বের হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে। চড় দিয়ে দাত খসিয়ে দিতে পারলে ভালো লাগতো। অবশ্য রতনের কথার দাম দেওয়ার কিছু নেই। রতনকে যদি এখন বলা হয়,
-রতন,সূর্য পূর্ব দিক থেকে উঠে সেটা আসলে চিরন্তন সত্য না।
রতন সাথে দাত বের করে হাসি দিয়ে বলবে,
-জ্বে স্যার। কথা সত্য। কেয়ামতের আগে সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উঠবে।
বদি ইচ্ছে করলে আশেপাশের আরো কয়েকজনকে তার দুঃস্বপ্নের ব্যাপারটা বলে স্যার কী উত্তর দিবে সেটা সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে পারতো। মৃত্যু ভয় মনে হচ্ছে তার উপর ঝাকিয়ে বসেছে,কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। অথচ পরিস্থিতি এমন হওয়ার কথা ছিল না। তার দল ক্ষমতায়, মমতাময়ী মা ক্ষমতায়। নির্বিগ্নে চলছিল বদির ব্যবসা। ব্যবসার ক্ষেত্রে বদি যেন উড়ছিল। পৌছে গিয়েছিল তার ব্যবসায় কিংবদন্তি পর্যায়ে। নামের সাথে যোগ হতে শুরু হয়েছিল নানা বিশেষণ। এই অতি উন্নতিই মনে হয় কাল হল। পুরো দেশ তার ব্যবসার পন্য দিয়ে লাল হয়ে গেল! চারদিক থেকে ভেসে আসতে লাগলো সমালোচনা। বদির এলাকায় সাংবাদিক বিচ্ছু গুলো ডুকে গিয়ে করতে লাগলো একের পর এক রিপোর্ট। বদির ছেলে-পেলেরা ক্যামেরা ভেঙ্গে দিয়েও এলাকায় সাংবাদিক আসা কমাতে পারলো নাহ। তারা দ্বিগুন উৎসাহে রিপোর্টের সংখ্যা বাড়াতে লাগলো। তিলকে তরমুজ বানিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাংবাদিকরা রিপোর্ট লিখতে লাগলো। রিপোর্ট দেখে দেশবাসীর মাথা খারাপ হয়ে গেল। ফেসবুকে না কোন বাল-বুকে শুরু হয়ে গেল বিস্তর আলাপ-আলোচনা। এদিকে হঠাৎ মমতাময়ী মা দিয়ে বসলেন এক ঘোষনা। ঘোষনাই কাল হলো বদির জন্য। বদি প্রথমে ভাবলো,বদি হল রাঘব-বোয়াল,এসব অভিযানে সাধারনত চুনোপুঁটি ধরা পরে। তার কিছু হবেনাহ। বদির এগুলো নিয়ে টেনশন না করলেও চলতো। কিন্তু বিপত্তি বাধালো বিচ্ছু পোলাপান আর সাংবাদিকগুলো। রাত দিন আলোচনা-সমালোচনা চলতে লাগলো তাকে নিয়ে। এদিকে প্রতিদিনি খবর কাগজ খুলে বদি দেখতে পায় অভিযানে প্রতিদিন দশ-বারো জন করে মারা যাচ্ছে। পত্রিকাতে সেটা নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি তার নাম উঠে আসছে বারবার। তার কেন কিছু হচ্ছে না। টেলিভিশনের টকশো গুলো তাকে ছাড়া জমছেই না। রাতদিন ফোন দিয়ে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে। একদিন এমনি একফোনে এক ছাগল জিজ্ঞেস করলো,আপনার নামে তো প্রায় চারশোর মত মামলা। কেন?
মনে হচ্ছে হারামজাদাকে ধরে উনি জুতিয়ে দাত ভেঙ্গে দিতে। চারশো না পাঁচশো মামলা তারে বলতে হবে কেন। সময়টা খারাপ। তাই প্রশ্নের উত্তরে বদি মাথা ঠান্ডা করে বিরুধী দলের উপর দোষ চাপিয়ে দিলেন।
এদিকে একদিন শুনলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সাংবাদিকদের কথায় গলা মিলিয়েছে। বদি ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপলোড করে অভিযানকে সমর্থন করেও লিখলো। কোনো লাভ হলো না। বরং উল্টো বিচ্ছু ছোকরাদের ট্রলের শিকার হলো। বদি বুঝলো,চারদিক থেকে তার পৃথিবী সংকোচিত হয়ে আসছে। মাথার উপর থেকে মমতাময়ী মা'র হাত সড়ে গেলেই এখন বদি শেষ। শেষমেশ যোগাযোগ করলেন মমতাময়ী মায়ের সাথে। কেঁদেকেটে পরলেন তার পায়ের কাছে। মমতাময়ী মা বলল,
-দেখেন কান্নাকাটি করলে কিছু হবে নাহ। আমার দলে থাকবে সব নিষ্পাপ মানুষ। কোনো অপরাধী থাকবে না।
বদি এটা শুনে আরো জোরে পা জড়িয়ে কান্না শুরু করলো। ডুকরে কেঁদে উঠে শুধু বললো,মা,মাগো....
মমতাময়ী মা এবার ধমক দিয়ে বলল,
-পা ছেড়ে সোফায় বসুন।
বদি সোফায় বসার পর জিজ্ঞেস করলো,
-আপনি হজ্ব করেছেন?
বদি হজ্ব করেছে এটা সবাই জানে। নামের আগে আলহাজ্বও লাগিয়েছে। তাই প্রশ্নে একটু বিব্রত বোধ করলো। তারপরও উত্তর দিল,জ্বী,করেছি।
-করে থাকলে আবার করবেন। হজ্ব করলে মানুষ ভূমিষ্ঠ শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায়। আমার দলে সব নিষ্পাপ লোক থাকবে,বুঝলেন?
বদি বুঝতে পারলো মমতাময়ী তাকে গা ঢাকা দিতে বলছে। বুঝে সাথে সাথেই সায় দিয়ে বলল
-জ্বী, আমি কালকের.....
কথাটা শেষ করতে পারলো না। এরমধ্যেই মমতাময়ী বলে উঠলো
- কাল পর্যন্ত সময় পাবেন না। এখনি আপনি কাপড়চোপড় গুছিয়ে বিমানে উঠে যাবেন। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
বদিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মমতাময়ী উঠে গেল।
************************************
বদি বিমানে বসে আছে। বিমান টেকঅফ করার জন্য প্রস্তুত, সবাইকে সিট বেল্ট বেধে নিতে বলা হচ্ছে। বিমান আস্তে আস্তে উপরে উঠে যাচ্ছে,বদি জানালা দিয়ে নিচে তাকালো। সবকিছু ছোট হয়ে যাচ্ছে,শুধু রতন ছোট হচ্ছে নাহ। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য নাহ। বদি স্পষ্ট দেখতে ও শুনতে পেলেন রতন দাত বের করে হেসে বলছে,
- স্যার, ওরা মানুষ না,র্যাব। মেশিন চালানোর অর্ডার দিয়া দিব.......
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৩