পরিচালনা,কাহিনী ,চিত্রনাট্য সংলাপঃ হূমায়ুন আহমেদ
অভিনয়েঃ রিয়াজ,শাওন,চ্যালেঞ্জার,হুমায়ুন ফরি্দি,এজাজ,ফারুক.........
এটা আমার মূদ্রা দোষ বলতে পারেন । কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে এর সাথে লেখার সাথে সম্পর্কিত আগডুম-বাগডুমও নিয়েও লিখি । মুভি রিভিওর ক্ষেত্রে এর ব্যাতিক্রম হয় না । তো শুরু করি আগডুম-বাগডুম । আসলে এই মুভি নিয়ে কোনো কিছু লিখার ইচ্ছা ছিল নাহ । কারন হূমায়ুন আহমেদের কোনো সৃষ্টি সম্পর্কে আমি কিছু লিখতে পারি নাহ,সেটা গল্প,উপন্যাস,মুভি যাই হোক না কেন । লিখতে পারি না কথাটা অবশ্য অর্ধ-সত্য । লিখি,তারপর রিভিশন দেওয়ার সময় মনে হয় আমার ফিলিংসটা আমি পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারি নি । ফলাফল,ব্যাকস্পেশ চেপে পুরো লেখাটা মুছে দেই । আজকে তার ব্যতিক্রম করছি । এর পেছনেও একটা কারন আছে । আজকে কয়েকজন বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম । এক সময় লুঙ্গি-প্যান্ট বিতর্ক শুরু হলো আমার এক বন্ধু লুঙ্গির পক্ষে বিশাল বক্তৃতা দিল ( ও লুঙ্গি পরে এসেছিল এজন্য সম্ভবত ) ওর বক্তৃতার সারমর্ম হল,”আমরা পশ্চিমা জিনিসের মধ্যে মর্ডানিজম খুজি এজন্য দেশি জিনিস পছন্দ করি নাহ । দেশি পোশাক পছন্দ করি না,বাংলা মুভি পছন্দ করি না,ব্যাগারা,ব্যাগারা
তার উত্তরে আমি বললাম,’’ লুঙ্গি আমাদের নিজস্ব পোশাক ,এটা সম্পুর্ন সঠিক নয় । তাছাড়া বাংলা মুভি দেখি না, এটাও সত্য নয় ।
বন্ধু ঘাড় নেড়ে বলল,’’ কেমন দেখিস জানা আছে । পচানোর জন্য দেখিস । “
আমি এবার হেঁসে বললাম,” পচানোর মত হলে পচাবো নাহ
.
এটুকু যদি পড়ে যদি ভেবে থাকেন যে , আমার কাছে বাংলা মুভি মাত্রই পচানোর মত মুভি তাহলে ভুল ভাববেন । বাংলা বেশির ভাগ মুভি যদিও এককথায় “আবর্জনা” তারপরও আপনি না জেনে থাকলে জেনে খুশি হবেন যে বাংলায়ও কিছু মুভি হয় যেগুলোকে এক কথায় প্রকাশ করতে গেলে “অসাধারন” শব্দটাকেও কম মনে হয় । একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি,আমি এখানে বাংলা মুভি বলতে বাংলাদেশের মুভিকেই বুঝাচ্ছি,বাংলা ভাষায় তৈরি হওয়া যে কোনো দেশের মুভিকে বুঝাচ্ছি নাহ । ও হ্যা ,যা বলছিলাম । বাংলায় তৈরি হওয়া অসাধারন মুভির বেশ কয়েকটা দেখার সৌভাগ্য ও হয়েছে । তার মধ্যে হূমায়ুন আহমেদের “শ্যামল ছায়া” অন্যতম ।
আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেখা অন্যতম সেরা মুভির একটা শ্যামল ছায়া একটা । হূমায়ুন আহমেদ এর গল্প ও পরিচালনায় অসাধারন একটা মুভি । আমি এ যাবৎকালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে কয়েকটা মুভি দেখেছি,সবগুলোতেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ কে ফোকাস করে গল্প এগিয়েছে । দর্শক চায় সরাসরি যুদ্ধ দেখতে ,তাই দর্শক চাহিদা পূরন করতে বেশিরভাগ মুভিতে যুদ্ধকেই ফোকাস করা হয় । যুদ্ধের সময় অনেক মানুষ পালিয়ে থেকেছে,লুকিয়ে থেকেছে – তাদেরকে কোনো সিনেমায় ফোকাস করা হই না । সে ক্ষেত্রে শ্যামল ছায়া ব্যতিক্রম । মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌকা করে পালিয়েছে এরকম কয়েকটি পরিবার এর গল্প নিয়ে মুভি এগিয়েছে । ঐ সময়ের বাকি সবার মত তারাও অনিশ্চিত যাত্রা করেছে । খুজে ফিরছে মুক্তাঞ্চল । সবার মধ্যে উদ্বেগ ,চাপা ভয় কিন্তু সবার চোখে আশ্চর্য এক ছায়া,শ্যামল ছায়া । পাঠক,আমি আর গল্প বলতে চাই না । হূমায়ুন আহমেদের অসাধারন গল্প বলার ভঙ্গি থেকে আমি শাদামাটা ভাবে বলে আপনাদের বঞ্চিত করতে চাই না । আপনারা বরং মুভিতে দেখে নিয়েন । হূমায়ুন আহমেদের একটা উপন্যাস আছে শ্যামল ছায়া,বলে রাখা ভাল-মুভিটা উপন্যাস অবলম্বনে নয় ।
.
এই অংশে মুভি সম্পর্কে ব্যক্তিগত মতামত ,চাইলে এড়িয়ে যেতে পারেন
কিছু খুটিনাটি বিষয় থাকে ,যে গুলো কাহিনীর জন্য খুবই দরকারি না তবে গল্পকে আরো রিইয়েলেস্টিক করার ক্ষেত্রে কাজে লাগে । যেমনঃ মুভিতে নৌকায় একটা পরিবারের সাথে একটা ছাগলও থাকে । ঘটি-বাটি নিয়ে মানুষ পালাচ্ছে ,সঙ্গে ছাগল থাকাটা স্বাভাবিক । অন্য কেউ হলে হয়তো ছাগলের ভূমিকা এখানেই শেষ করতো কিন্তু হূমায়ুন আহমেদ বলে কথা মুভির দৃশ্যে যখন দেখা যাবে , ছাগলকে খাবার প্লেট দিয়ে নদী থেকে পানি তুলে খাওয়ানো হচ্ছে তখন আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন আসলেই তো ,ছাগলেরও তো খাওয়া প্রয়োজন ।
আর একটা দৃশ্যে দেখা যায় নৌকা চরে আটকে যাওয়ার কারনে সব যাত্রীরা নেমে যায় নৌকা ছোটানোর জন্য । রিয়াজ (মুভির চরিত্রের নাম না বলে অভিনেতাদের নামই উল্লেখ্য করছি ) পানিতে নেমে নৌকা ঠেলছে ,রিয়াজের স্ত্রী তার হাত ধরে আছে । তা দেখে শাওন ও তার স্বামী খসরুর হাত ধরে । হাত ধরার দৃশ্য ও যে এত রোমান্টিক ভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় এই দৃশ্য দেখলে বুঝতে পারবেন ।
অভিনয়ের কথা না বললে পাপ হবে বিশেষ করে অতি সম্প্রতি বাংলা সিনেমার অভিনেতাদের অভিনয় দেখার পর যদি দেখেন তাহলে মনে হবে অভিনয়ের জন্য এই মুভির প্রত্যেকেই অস্কার ডিসার্ব করে বিশেষ করে হুমায়ুন ফরিদি । এক হূমায়ুন এর গল্প-পরিচালনায় আরেক হুমায়ুন ‘চরম’ দেখিয়েছেন । এই মুভিতে ক্যারিয়ার সেরা অভিনয় করেছেন বললেও আমি আশা করি বেশি বলা হবে না । আমার কাছে একবারও মনে হয়নি হুমায়ুন ফরিদি অভিনয় করছেন,যতটা রিয়েলিস্টিক ভাবে চরিত্রটা উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশের অন্য কোনো অভিনেতা পারতো বলে মনে হয় না । রিয়াজ আর শাওনের কথাও বলতে হয় । একটা দৃশ্যের কথা বলি,চ্যালেঞ্জার রিয়াজকে জিজ্ঞেস করে ,” মাওলানা,আপনি কী চান ,স্বাধীন বাংলা না পাকিস্থান ? রিয়াজ ,জ্বী ,পাকিস্তান বলার আগে যে এক্সপ্রেশনটা দেয় ,তা সত্যিই দেখার মত উপভোগ্য একটা দৃশ্য ছিল ।
হূমায়ুন আহমেদ যারা নিয়মিত পড়েন ,তারা জানেন হূমায়ুন আহমেদের সেন্স অফ হিউমার কত উচ্চ লেবেলের ছিল এবং তার প্রতিটা চরিত্রের মধ্যে তা ভালোভাবেই প্রকাশ । হূমায়ুন আহমেদের সব গল্পের মধ্যেই ‘হিমু’ টাইপের চরিত্র থাকে । বলতে গেলে,সব চরিত্রের মধ্যেই হিমু চরিত্রের কিছু না কিছু না থাকে । এ সম্পর্কে হূমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন,’’ প্রত্যেক লেখকের নিজস্ব কিছু চরিত্র থাকে যার থেকে লেখক বের হতে পারে না । যেমন ঃ বিভূতিভূষনও কিন্তু অপু-দূর্গা টাইপ চরিত্র থেকে বের হতে পারেন নি ‘’ ( হূমায়ুন আহমেদের বক্তব্য টা এরকমই ছিল তবে হুবহু এরকম না । আমি শুধু সারমর্মটা তুলে দিয়েছি ) এবং এই মুভিও ব্যতিক্রম নাহ । মাওলানা (রিয়াজ),আশালতা (শাওন) এর মধ্যে ‘হিমু’ টাইপ চরিত্র বেশি ফুটে উঠেছে ।
.
এই অংশ ঠিক নেগেটিভ না তবে কিঞ্চিত সমালোচনা থাকবে আরকি
আরও একবার ছাগল প্রসঙ্গ মুভির ছাগলটা অতীব ভদ্র ছিল । আশে পাশে গুলাগুলি হচ্ছে,নৌকায় হইচই হচ্ছে বাট ছাগল ব্যাচারা একবার ও মুখ খুলেনি ☺ আমি ভাবলাম পুরো মুভিতেই হয়তো সাইলেন্ট থাকবে বাট আমারে ভুল প্রমানিত করতেই কি না জানি না রাজাকাররা ধরে নেওয়ার সময় মাতৃভাষায় ম্যা ম্যা করে উঠছে
এক জায়গায় দেখা যায় ,নৌকা মিলিটারি নৌকার মুখোমুখি হয় । সে সময় নৌকা লুকানোর জন্য এজাজ আর ফারুক গাছের ডাল কেটে নিয়ে নৌকা আড়াল করে ফেলে যার ফলে মিলিটারি নৌকা তাদের দেখতে পায় না । দুইটা গাছের ডালে এত বড় নৌকা আড়াল হল কীভাবে ( ) এই প্রশ্ন যদি নাও করি তারপরও জানতে চাইবো এত তাড়াতাড়ি ডালগুলো কেটে নিয়ে আসলো কীভাবে
হূমায়ুন আহমেদের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে তার উপন্যাসে শক্তিশালী রাজাকার চরিত্র থাকে না । ১৯৭১,জোছনা ও জননীর গল্প এবং এই মুভির মধ্যেও সেটা দেখা যায় । প্রথমে রাজাকার চরিত্র বা পাকিস্তানপন্থী চরিত্র হিসেবে যেটা দেখা যায়,সেটা গল্পের মধ্যে চেঞ্জ হয়ে যায় মানে সেটা আর নেতিবাচক থাকে না এই মুভির মধ্যে যেরকম মাওলানা ও রাজাকার কমান্ডার। মাওলানা প্রথমে পাকিস্তানপন্থী থাকলেও শেষে মুক্তিযোদ্ধে যোগ দেয় আর রাজাকার কমান্ডার ছাড়া পেয়ে ইতিবাচক হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এরকম চরিত্র দু-ইয়েকটা ছিল,সে ব্যাপারে কেউ অস্বীকার করবে না । তাদের নিয়ে গল্পও লেখা হয়েছে যেমন কলিমুদ্দি দফেদার , তবে হূমায়ুন আহমেদের উপন্যাসেই এরকম চরিত্রের দেখা বেশি পাওয়া যায় । আমার মনে হয় এর কারন হূমায়ুন আহমেদের নানা । যুদ্ধের সময় হূমায়ুন আহমেদ উনার রাজাকার নানার আশ্রয়ে ছিলেন দীর্ঘ সময় । হূমায়ুন আহমেদ উনার নানার সম্পর্কে বলেছেন,” উনার নানা বাধ্য হয়ে রাজাকার হয়েছিল এবং রাজাকার হলেও উনি পাকিস্তানিদের হাত থেকে অনেক লোককে বাচিয়ে ছিলেন যাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাও ছিল । যুদ্ধের শেষে সেসব মুক্তিযোদ্ধারাই তাকে গুলি করে হত্যা করে । “ উনার নানার মত মানুষের প্রতি যাতে সাধারন মানুষের ক্ষোভ না থাকে বরং পজিটিভ ধারনা জন্মে সে কারনেই হয়তো কন্টিনিয়াসলি এ ধরনের চরিত্র নিয়ে লিখেছেন ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:২৪