***
“পারিপার্শ্বিকতা, সাফল্য কিংবা প্রাত্তহিক দ্বন্দ্ব যা-ই বলিস না কেন এগুলো কিন্তু আমাদের ফ্যান্টাসির সাথে সমান্তরালে বহে। আমরা ফ্যান্টাসি দ্বারা তাড়িত হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করি, কিন্তু সুখ খুঁজে পাই না। তবে আমি আমার ফ্যান্টাসি আর রিয়েলিটির মধ্যে একটা সেতুবন্ধন দাঁড় করেছি, শুক্লাকে দিয়ে। আমার এখনকার পেইন্টিংগুলোতে খেয়াল কর, জরাজীর্ণ বাস্তবতা আর রঙচঙে ফ্যান্টাসিকে আমি ক্যানভাসে এনেছি সারকাস্টিক রিয়েলিটি ডাইমেনশনে। আসলে শুক্লা মেয়েটাকে এ জীবনে না চিনলে অনেক কিছুই বোঝা হতো না।”
চায়ের কাপে ফের চুমুক দেয় শিশির। পর্দায় সকালের ঘুমভাঙা চুমুর মতো মিষ্টি রোদ আহ্লাদে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঘরের এক কোণায় দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা এক তরুণীর পোরট্রেট, হলদে শাড়ি, খোপায় বকুল ফুলের একটা মালা জড়ানো, বেশ সুন্দরী। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, “এই কি তোর শুক্লা? ওর কথাই বলেছিলি ফোনে? বেশ সুন্দরী তো, কোথায় সন্ধান পেলি?”
“বস্তিতে থাকে, স্বামী রিকশা চালায়, অভাবের সংসার। ফরমায়েশি আঁকাআঁকির মডেল হিসেবে ঘন্টা চুক্তিতে নিলাম। একসময় খেয়াল করলাম, শুক্লা মেয়েটার মধ্যে গভীরতা আছে। ওকে আমি তিলে তিলে তুলে আনবো আমার মতো করে আমার সব রঙ মিশিয়ে।”
“নতুন নতুন নারী মাংসের স্বাদ পেলে সব পুরুষেরই মাথা বিগড়ায়।”
“ছি শারমিন, এমন একটা নোংরা কথা এতো সহজে কিভাবে বলে ফেললি।”
“রসিকতা করলাম। কিন্তু তুই এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেন। আচ্ছা, প্রেম-টেম নাকি আবার কিছু, পরকিয়া?”
“দেখ, একজন অপরিচিত মানুষকে নিয়ে তোর এভাবে বাজে মন্তব্য করাটা ঠিক হচ্ছে না। একজন শিল্পীর চোখে তার মডেলের বিশেষত্ব থাকার সাথে প্রেম-ভালবাসা ব্যপারটার অনেক ফারাক।”
মুচকি হেসে বললাম, “তুই কেমন সেটা আমার চেয়ে তুই নিজেও ভালো জানিস না। তোকে কেবল একটু বাজিয়ে দেখলাম।”
“ফালতু অজুহাত বাদ দে।”
“একজন শিল্পীর শৈল্পিক চেতনার পেছনে শিল্পী আর মডেলের মধ্যকার কেমিস্ট্রি একটা গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করে। ভিঞ্চির মোনালিসা ছবিটার কথাই ধর।”
“জল ঘোলা করে তোর লাভ কি?”
“তোর ইদানিং আঁকা সিরিজটা আমার ভালো লেগেছে, আমি তোর আঁকা ছবির একটা এক্সিবিশন করতে চাই। যেহেতু আমি ইনভেস্ট করবো, সম্ভবনার হিসেবটাও তাই কষে নিলাম।”
স্বভাবতই বেশ চমকে গেছে, বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে বলল, “দেখ, আমাকে দিয়ে হবে নারে। আমি পচে গেছি, নষ্ট হয়ে গেছি। এখন আমি টাকার বিনিময়ে ফরমায়েশি ছবি এঁকে বেড়াই। স্বপ্ন দেখা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি।” একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। “আমি জানি কিভাবে প্রতি মুহূর্তে আমাদের পৃথিবীটা খুব ক্ষুদ্র কিছুর কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে- ভাতের কাছে স্বপ্ন, টাকার কাছে দেহ। আমি পারবো নারে।“
আমি ওকে উৎসাহমূলক অনেক কথা বললাম, বুঝালাম। তাতে কাজ হল। ফের খুব উৎফুল্লভাবে বলতে লাগল, “ইশ, দেশের প্রতিটা শিল্পীর যদি তোর মতো বিলাতফেরত বড়লোক স্বামীওয়ালা বান্ধবী থাকতো তাহলে জীবনানন্দ দাশ দেরকে এভাবে মরতে হতো না।”
“বড়লোক স্বামী এখন আর নেই। ডিভোর্স দিয়েই তো দেশে চলে এলাম।”
“ওহ সরি, বলিস নি তো আগে। সমস্যা চলছিল বলেছিলি, অনেক দিনের সংসার...”
“পাঁচ বছর সাত মাস তের দিন।”
“সমস্যা কি ছিল তোদের?”
“বাদ দে। এক্সিবিশনের টাইটেল কি দিবি?”
“যেহেতু এক্সিবিশনের পুরোটাই শুক্লাকে নিয়ে করবো, নাম দিলাম শুক্লপক্ষ।”
***
কাজিপাড়া থেকে মাইকওয়ালা মসজিদ ভাড়া ১৫ টাকা। আর লোকটা কিনা ১০ টাকা দিলো। কিসলু আরও ৫ টাকা চাইতেই কষে কয়েকটা চড় খেল। চড় খেয়ে চোখে পানি চলে আসে, কেবলমাত্র রিকশাওয়ালার হওয়ার কারণে কিসলু আজ কোন প্রতিবাদ করতে পারল না। এই অনাচারের দুনিয়ায় সে আর রিকশা চালাবে না সিদ্ধান্ত নেয়। বাসায় ফিরে ক্ষুধার্ত অবস্থায় পুরো ক্ষোভ ঝাড়ে স্ত্রী শুক্লার উপর। হ্যঙ্গার দিয়ে পিটাতে পিটাতে চামড়া ফাটিয়ে রক্ত বার করে দিলো। শুক্লা রাগে-দুঃখে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। বের হবার সময় কিসলু দৌড়ে এসে পিঠে আরেকটা কিল বসিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, “যা, বাইর হইয়া যা। তোর মতো নটি মাগির চেহারা আর দ্যাখতে চাই না।”
***
প্রথম দফায় ই প্ল্যানটা খেটে গেছে। শিশিরের নিভৃত জীবনে শুক্লা একটা চকচকে নতুন ভাবনা হিসেবে জুড়ে ছিল। সেখানে আমি শিশিরকে মেতে থাকার জন্য আরেকটা নতুন ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছি- এক্সিবিশন। শুক্লা এখন ফিকে হয়ে আসতে থাকবে, আমি শিশিরকে চিনি। অঞ্জন দত্তের গানটার কথা মনে পড়ে গেল-
আমি দেখে ফেলেছি তোমার মনের ভেতরটা
আমি চিনি আমি জানি তোমাকে, তোমাকে।
***
শিশিরের বাসায় গিয়ে জানতে পারলাম শুক্লা শিশিরের বাসায় উঠেছে। উঠুক, রাজা যেদিকে যাবে চেক ও সেদিকেই দিতে হবে। আমি শিশিরকে এক্সিবিশনের জন্য তাড়া দিলাম।
“দেখ, সময় কিন্তু বসে থাকছে না।”
শিশিরকে কিছুটা চিন্তিত মনে হল।
“সিরিজে কয়েকটা ন্যুড আঁকার বাকী আছে। কিন্তু শুক্লার শরীরজুড়ে ওর স্বামীর টর্চারের কারণে কেটে কেটে গেছে। আমি ঐদিকে তাকাতে পারছি না, কন্সেনট্রেশন নষ্ট হয়ে যায়।”
শীতল গলায় বলে ফেললাম, “সময় আমাদের জন্য থেমে থাকবে না। ডেডলাইন পেরিয়ে গেলে কিন্তু আর কিছুই করার থাকবে না। “শুক্লপক্ষ” হবে তখন শুধুই একটা দুঃস্বপ্ন।”
***
শুক্লার দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতিতে কিসলু পরিচিত সব জায়গায় খুঁজে ফেলেছে, কেউ কোন খবর বলতে পারল না। কিসলুর মাথায় চিন্তা জমে জমে পাহাড় হয়ে গেছে। কিসলু মনে মনে সারাক্ষন ই দোয়া করছে, “আল্লাহ, আর কোনদিন আমি অর গায়ে হাত তুলুম না। এইবারের মতো অরে ফিরাইয়া দাও।”
***
শিশিরের ঘরের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো মেঝেতে পড়েছে, সেখানে শুক্লা অভিমানি ভঙ্গীতে হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। নগ্ন দেহের বাঁকে বাঁকে জোছনা সাঁতার কাটছে।
শিশির ক্যানভাসে চোখ রেখে পার করে দিয়েছে সহস্রকাল। একসময় ধীরে ধীরে কল্পনার ক্যানভাসে আসতে শুরু করল রঙ, নিউরনে বাজছে অনুরণনের বাজনা। গলায় আরেক ঢোক মদ ফেলে দেয়ামাত্র রঙগুলো গাঢ় হয়ে উঠছে, শুক্লার শরীর বেয়ে বৃষ্টির মূর্ছনার মতো নামছে প্রেমের জোয়ার। কে বলেছে দেহে পাপ থাকে? এই দেহে ফুটেছে পৃথিবীর পবিত্রতম ফুল, কসম জাগতিক স্পন্দনের, এই তীর্থে আমি যজ্ঞ বাঁধবো, আবার নিয়ম ভাঙবো হরহামেশা। এই পৃথিবীর বুকে তুমি হবে ইউটোপিয়ান বাগান, দখিনা হাওয়া খেলে গেলে সুঘ্রান ছড়াবে তোমার সুদীর্ঘ কেশ, তোমার চলা হবে ঝরনার প্রবাহ, আঙ্গিনায় গাইবে বুলবুলি। তুমি নেচে বেড়াবে রঙধনুর আলোয়, মন্ত্রসাধকের মতো দুই হাত শুন্যে মেলে দিয়ে। শুক্লার প্রতিটি কোষের নাচন উঠিয়ে আনা হবে তুলিতে, এই শিল্পের চেয়ে শাশ্বত আর কি হতে পারে। এমন একটি শিল্পকর্ম একজন অন্তপ্রান শিল্পীর সারাজীবনের সাধনা। একজন ছবিটার নাম হবে ঝঙ্কার।
“তিলে তিলে বাঁচতে থাকা ব্যাধিবিদ্ধ বিলীন প্রান্তরে
কীসের আরাধনা বুকে করে তুমি জেগে আছো, হে অভিমানী রাতফুল?”
এখনি হাতের তুলি লাফিয়ে বেড়াবে ক্যানভাসের পাতায়, প্রচন্ড ঘোর নিয়ে চোখ খোলে শিশির। মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বেয়ে যায়, শুক্লার শরীরের দাগগুলো আলো-আঁধারিতে ভয়ানকভাবে ফুটে আছে। মুহূর্তেই উবে যায় মুগ্ধতার সকল নির্বচন। সেখানে দপ করে জ্বলে ওঠে অমানুষিক ক্রোধ। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে হাতে তুলে নেয় পেন্সিল কাঁটার ছোট ধারালো ছুরিটা। ছুরির ফলাটা ঝিক করে উঠলে সেদিকে কিছুক্ষন অপলক তাকিয়ে থাকে শিশির। ঠিক ঠিক লক্ষ্য করে কণ্ঠার নিচের নালীটায় চালিয়ে দেয়। এরপর এলপাতাড়ি কিছুক্ষন পুরো শরীর জুড়ে চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে যখন থেমে যায় তখন দেখে, শুক্লা একটা মাংসপিন্ড ছাড়া কিছুই না। হঠাৎ স্থবিরতা গ্রাস করে নেয় শিশিরের দেহ। কোনরকমে ফোনে বলে, “শারমিন, আমি শুক্লাকে মেরে ফেলেছি।” এরপর হড়হড় করে বমি করে অজ্ঞান হয়ে যায়।
***
টাকা খরচ করলে বাঘের চোখ পাওয়া যায়। আমি খুব বিশ্বস্ত কিছু লোক দিয়ে লাশটা গায়েব করে ফেললাম। কেউ কিছুই জানল না। এতো বড় একটা ধকল যাওয়ায় শিশির এখন মানসিকভাবে কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েছে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, জীবনের কোন দিশা নেই। আরও একজনের অবস্থাও প্রায় একি রকম, কিসলু। রাত বিরাত শহরের পথে পথে রিকশা চালিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় শুক্লাকে।
“কুত্তার বাচ্চা, এতো রাইতে আবাসিক এলাকায় রিকশা নিয়া ঢুকছস!” বলে ডান্ডা দিয়ে কষে কিসলুর রানে বাড়ি মারে পাহারাদার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি রিকশা নিয়ে বেরিয়ে আসে এলাকা থেকে। ব্যথায় ফুটপাথে বসে পড়তে হয়, পা টা অবশ হয়ে গেছে, নড়তে চাইছে না। কিসলু আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যথায় হাউমাউ করে কেঁদে বলতে থাকে, “তুমি কই আছো বউ? তোমারে যত কষ্ট দিছি তার বেশি কষ্ট আমারে দিও। তবু তুমি ঘরে ফিরা আসো... ঘরে ফিরা আসো।”
***
আমাকে তুলে নাও জিকিরে তোমার
পাপ হয়? হবে হোক, কী ক্ষতি সোনার
বাজারে চলেই যদি পয়সা তামার?
খেলা শেষ, শিশির এখন কেবল আমার। শিশির আর কিসলু সবাই একটা সময় পর ঘরে ফিরে আসবে, ফার্মগেটের লাখ লাখ অসুখী মানুষ যেভাবে একসময় যার যার ঘরে ফিরে যায়। যেভাবে আমি ফিরে এসেছি পাঁচ বছর সাত মাস তের দিন পরেও।
(বিঃদ্রঃ শেষ অনুচ্ছেদে উদ্ধৃত কবিতাংশ আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শরীফ সিরাজ রচিত।)
(গল্পটি পূর্বে সাহিত্য পত্রিকা "ক্যামেলিয়ার চিঠি" তে প্রকাশিত।)