তেল চিটচিটে মলিন মশারিটা টাঙ্গানো। তার ভিতরে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে কানে বাজছে সারাদিনের গার্মেন্টস এর সেলাই মেশিনের শব্দ, ঢুলুনির তালে তালে মশারিটাও ঘরশুদ্ধো ঢুলছে। তবুও ঘুমাচ্ছে না আসমা। বাবুলের পাশে বসে আছে। বাবুলের জ্ঞান এখনো ফেরে নি। বাবুল হল আসমার স্বামী। প্রতিদিন নেশায় বুঁদ হয়ে ঘাড় দুলিয়ে গান গাইতে গাইতে ঘরে ফেরে। কোন কোন দিন কাজ-টাজ করে। ঐ দুই-তিনদিন আসমা খুব শান্তিতে থাকে। নেশা করার টাকার জন্য ঘ্যানঘ্যান করে না। নেশার টাকার জন্য ঘরের টিন পর্যন্ত একটা খুলে বেচে দিয়েছিল; যার জরিমানা বস্তির মালিককে দিতে হয়েছে আসমার। আবার আজ চুরি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে, মার খেয়ে ফিরে এখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। কুলাঙ্গার স্বামী বলতে যা বোঝায়। অবশ্য আসমার মত মেয়েদের ভাগ্যে এমন ছেলেই জোটে। ভদ্রলোক জুটবে কোথা থেকে। ভদ্রলোকরা জোটে ভদ্র মেয়েদের ভাগ্যে। তবে ভদ্রলোক বা ভদ্রমেয়ে কেউ ই পুরোপুরি ভদ্র না। তারা সম্পদের স্বর্গে ডুবে ডুবে সুন্দর করে মিথ্যে কথা আওড়ায়- "ভাল মানুষ হতে পয়সা লাগে না। সুখের জন্য পয়সা লাগে না।" এই কথাগুলো আসমা ছোটবেলায় যখন স্কুলে যেত তখন সে ও আওড়াতো। ভদ্রলোক হবার সব ব্যর্থ চেষ্টা। এইসব ভাবতে ভাবতে আসমার ঢুলুনিও বেড়ে যায়।
হঠাৎ ঝিমুনি ভেঙ্গে যায়, জ্ঞান ফিরেছে বাবুলের। মার খেয়ে ফেটে-ফুলে যাওয়া গা কাঁপছে। খুব মৃদুস্বরে বলে ওঠে, "আছু, একটু পানি দে। তিয়াস লাগছে রে, কষ্ট লাগতাছে"
রাগ লাগছে আসমার। কোন কথা না বলে পানি এগিয়ে দেয়। কয়েকচুমুক পানি খেয়ে একটু নড়েচড়ে উঠে হাতের মুঠি খোলে বাবুল- সেখানে একটা ছোটো সোনার নোলক।
"আছু, পরতো এইটা। এইটাই আজকে চুরি করছি। করতাম না, বুঝলি। কিন্তু আজকে নেশায় পাইয়া বসছিলো। মাল টাইনা ঘরে ফিরার সময় দেখি তোর বয়সী একটা বড়লোকের মাইয়া। নীলা একটা শাড়ি পড়া, নাকে এইরকম একটা নোলক। মাইয়াটারে অনেক সুন্দর লাগতেছিল। তুই ঐ মাইয়ার চেয়েও বেশি সুন্দর। কিন্তু তোর একটা নোলক নাই, নীলা শাড়ি নাই। নেশার মধ্যে তোরে ঐরকম নোলক আর নীল শাড়ি পরা দেখতে অনেক ইচ্ছা করতেছিল। এর লাইগা পাগলা হইয়া চুরি করছি। ধরা পইরা মাইর খাইছি কিন্তু জিনিসটা অরা খুইজা পায় নাই। নোলক যোগাড় হইসে, এখন একটা নীল শাড়ি যোগাড় করতে হইব। তয় এইবার আর চুরি করুম না।"
বলতে বলতে আবার জ্ঞান হারায় বাবুল। আসমার চোখ দিয়ে গলগল করে পানি ঝরছে। বাবুল জানে না যে আসমার বিয়ের নীল শাড়িটা এখনো আছে। জং ধরা টিনের ট্রাঙ্ক থেকে বের করে ধীরে ধীরে সেটা গায়ে জড়ায় আসমা। চোখ মুছে সুন্দর করে চোখে কাজল টানে, কপালে একটা টিপ দেয়। বাবুল যে টিনটা খুলে বেচে দিয়েছিল ঐ খালি জায়গা দিয়ে ঘরে চাঁদের আলো ঢোকে। মশারির উপর চাঁদের আলো পড়ে দেখতে জোছনার জালের মত লাগছে। আসমা জানে না বাবুল আবার জাগবে কিনা। কিন্তু বাবুল জাগলে যেন মশারির ভিতর থেকে নিলাভ চাঁদের আলোয় নীল শাড়ি, নাকে নোলক পরা আসমাকে দেখতে পায়। সে ভদ্র মেয়ে সেজে দুরুদুরু বুক নিয়ে সারারাত খাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে বাবুলের জেগে ওঠার অপেক্ষায়। আসমা জানে, অপেক্ষার রাতগুলো কোনদিন শেষ হয় না