রেললাইনের পাশ ধরে খানিকটা এগিয়ে যেতেই সেই নদীটা। নদী বললে এখন অবশ্য ভুল হবে, দুর্গন্ধময় নোংরা পানির খাল। তার উপরে গড়ে উঠেছে ঝুলন্ত বস্তিটা, খলিলের বস্তি। বস্তির বাসিন্দা একদল কিশোর বয়সী টোকাই আছে। যাদের শরীরে ময়লা, চুল রুক্ষ, চেহারা করুণাহীন। টোকাই দলা আজ খুব উত্তেজিত, বেশি উত্তেজিত দলনেতা কিসলু। আজ রাতে তাদের বিনোদন উৎসব। কিসলু সবাইকে বলছে, "আজকে সিরাজ কাকার ঘরে রাইতে "লাল ছবি" চালাইবো। রাইতে থাকিস, বহুত মজা হইবো। বহুতদিন পর সিরাজ হালায় আবার চালানো শুরু করছে। আগে এক পোটলা গাঁজা খাইয়া ঢুকুম, খাইয়া দেখতে সেইরকম মজা লাগবো। খালি ফিলিমস আর ফিলিমস"। এই কথা ভেবেই ফিলিমসে কিসলুর সাথে বাকী সবাই ও ভেসে যায়।
বাবুল এই দলের মধ্যে খানিকটা বোকাসোকা, সবার মজার পাত্র। ঠোঁট বাঁকিয়ে বাবুল বলে, "নারে দোস, লাল ছবি দেখতে ইচ্ছা করতেছে না। এর চেয়ে চল একটা প্রশেনজিতের ছবি আনি, কঠিন প্রেমের কাহিনী, ফাটাফাটি অ্যাকশন।..."
-"ধুর হালা মগা চোদা, এইসব শুকনা কাহিনী দেইখা মজা আছে! মাংশ চামড়া না দেখলে মজা লাগে না।"
-"দোস, আমার এইগুলার চেয়ে সিনেমা দেখতে ভালো লাগে।"
কিসলু এবার খেপে ওঠে, "তোর তো হালা খাঁড়ায় ই না, তোর ভালো লাগবো কেমনে?"
দলের সবাই হো হো করে হেসে উঠে।
বাবুল বিরক্ত স্বরে বলে, "দেখ দোস, মজা লইস না। তোরা দেখলে দেখিস, আমি দেখমু না"।
আবার হো হো করে হাসতে শুরু করে সবাই। তারা হঠাৎ ই একটা নোংরা তামাশার সুর ধরে ফেললো। ক্রমশ সেই তামাশায় মেতে উঠে একজন বলে, "দেখিতো হালার আসলে আছে না নাই।" বলে বাবুলের লুঙ্গির গিট্টুর নিচে ফস করে হাত দিয়ে দেয়। দলের বাকী সবাই উল্লাসে আরও বেপরোয়া হয়ে যায়, আদিম ঝোঁকে তারা সবাই ঝাপিয়ে পড়ে বাবুলের উপর। বাবুলের লুঙ্গি খুলে নিয়ে নোংরা দাঁত বের করে ফেক ফেক করে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে সবাই। বাবুল সদ্যজাত শিশুর মতো বিহবল হয়ে পড়ে, বিস্ফোরিত চোখের করুন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ওর সাথীদের দিকেই। ওরা বাবুলের লুঙ্গি হাতে নিয়ে উড়াচ্ছে, কেউ কেউ বাবুলের লুঙ্গির নিচে ঢেকে থাকা জায়গাগুলোতেও হাত দিচ্ছে। এক ছেলে হাতের লাঠি দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে বাবুলের পাছায়। যে যেভাবে পারছে মজা নিয়ে নিচ্ছে। এমন কিছুক্ষন উল্লাস করে লুঙ্গিটা সাথে নিয়েই চলে যায় কিসলু আর বাকী দলটাও। বোকারা সহজে দল থেকে একা হয়ে পড়ে, আর হেরে যায়। বোকাসোকা বাবুল শুধু পড়েই রইলো নিথর, ওর আত্মা এখন লুঙ্গির সাথে বেঁধে চলে গেছে।
বাবুল বহুক্ষন বাদে নগ্ন অবস্থাতেই উঠে দাঁড়ায়, রেললাইনটার পাশ ধরে ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে, ঘর বলতে একটা ড্রেনের পাইপ যার তলে রাতে মাথা গোঁজা যায়। একটা ছেলেমানুষ টোকাই রাস্তায় নগ্ন হাঁটছে এটা ভদ্রসমাজের কারো কাছে খুব একটা গুরুত্ববহ না। সভ্য চোখের অনেকটা আড়ালেই হেঁটে চলে যায় একটা ল্যাংটা টোকাই, বাবুল।
তারপর সময় গড়িয়ে সেই রাতটা নামে, গভীর হয়। কিসলু আর অন্য টোকাইরা খলিলের ঘরে "লাল ছবি" দেখছে মৃতের মতো হাঁ করে। আর বাবুল নোংরা বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছে, "কিসলুদের সাথে আর কোনদিন কথা বলবো না। আমি নিজের টাকা জমিয়ে একটা টিভি আর ভিসিডি কিনবো, তারপর রাতভর প্রশেনজিতের প্রেমের ছবি দেখবো। আহা।" ভাবতে ভাবতে বাবুল ওর টাকা জমানোর পুঁটলি ব্যাগটা ধরে টাকার ওজনটা আরেকবার মেপে নেয়। আরও অনেক টাকা লাগবে কিন্তু সমস্যা নেই, মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে একদিন হয়ে যাবে। তারপর ব্যাগটাকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পড়ে বাবুল।
পরদিন সকালটা খলিলের বস্তিতে চিরায়ত আর দশটা কোলাহলমুখর দিনের মতই শুরু হয়। বাবুল ওর বস্তাটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, অনেক টাকা রোজগার করতে হবে, অনেক টাকা ব্যাগটায় জমাতে হবে। ভাবতে ভাবতে বাবুল রেললাইনের পাশ ধরে হেঁটে চলে বস্তাটা দুলিয়ে দুলিয়ে। স্টেশনের আশেপাশে কতো মানুষ, কতো ঘটনা বয়ে যাচ্ছে অবিরাম ব্যস্ততায়! কত গল্প বয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে!
গতকালকে বাবুল ল্যাংটা হয়ে এই রেললাইনের পাশ দিয়েই হেঁটে গেছে, তখনো সবাই ছিল কিন্তু কেউ খেয়াল করে দেখে নি। আজ বাবুল একটা টিভি আর ভিসিডির রঙ্গিন স্বপ্ন গায়ে চড়িয়ে হেঁটে চলছে, আজও সবাই আছে কিন্তু কেউ খেয়াল করে দেখছে না। সবাই শুধু ক্ষণিকের একটা পলকে দেখতে পায়, -- "হেঁটে চলছে একটা বাতিল মাল, টোকাই বাবুল।"
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৩:৪৩