টেবিলের এপাশে জনি, আর অন্যপাশে মাথাভর্তি সাদা চুল আর গায়ে সাদা আপ্রন চড়ানো ডাক্তার। আপ্রন আর চুলের মধ্যে কোনটা বেশি সাদা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে ডাক্তারকে দেখে একটা শুভ্রতার অনুভূতি আসে। ডাক্তারের নিস্তব্ধতা সময়কে অনেক লম্বা করে দিচ্ছে, টেনশন হচ্ছে। আলো ঝলমলে রুমটা ঝড়ের আগ মুহূর্তের মতো খুব চুপচাপ, কেবল মাথার উপরের ফ্যান ঘোরার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
"দেখুন, আমি একজন ডাক্তার। কাজেই আপনাকে আপনার অসুখ সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা দিতে আমি দায়বদ্ধ। দেখুন আপনার... আমি ঠিক কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।"
"ডাক্তার সাহেব, আপনি বলে ফেলুন।"
"আপনার... আপনার এইচআইভি পজেটিভ"
মাথার উপর বাজ পড়ে কানে তব্ধা লেগে গেছে মনে হচ্ছে, ঘরটা হঠাৎ অন্ধকার লাগছে। আলোগুলো সব কুণ্ডলী পাকিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এসবই হয়তো স্বপ্ন, তবে মৃত্যুর খবর কখনো স্বপ্ন হয় না। জনি শুকনা গলায় খুব কষ্টে একটা ঢোক গেলে।
"ডাক্তার, আমি আমার জীবনে কখনো ঐসব ধরনের খারাপ কাজ করিনি।"
"দেখুন, এইচআইভি পজেটিভ এর কারণ কেবলমাত্র একটা নয়। বিভিন্নভাবে ছড়াতে পারে। আপনি কি কখনো কারো কাছ থেকে রক্ত নিয়েছেন বা সিরিঞ্জে মাদক গ্রহন করেছেন?"
"একবার রক্ত নিয়েছিলাম।" নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলে ফেলে জনি।
"কোথা থেকে নিয়েছিলেন"
"___ ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে"
"আমাদের জন্য খুব ই লজ্জার এবং দুঃখের যে, বেশিরভাগ ব্লাড ব্যাঙ্কেই রক্ত নিয়ে ব্যবসা হয়। তারা কখনো রক্ত পরীক্ষা করে দেখে না। সেখানে অনেক মাদকাসক্তদের রক্ত ও সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়। আর আপনি হয়ত জানেন যে, মাদকাসক্তদের মধ্যে এইডস এর সংক্রমন খুব বেশি"
"কিন্তু ডাক্তার আমি কি দোষ করেছি"
"রোগ তো আর দোষী বা নির্দোষ দেখে হয় না"
জনি হতবিহবলের মতো ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে একটা রিকশা নেয়।
রিকশাওয়ালা কিছুক্ষন বাদেই ফিরে ফিরে দেখছে জনির দিকে। একসময় বলেই ফেলল, "মামা, আপনার কি শরীর খারাপ লাগতেছে?"
জনি উত্তর দেয় না, সে রিকশার প্যাডেলের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। জীবনের একেকটি মুহূর্ত রিকশার প্যাডেলে জড়িয়ে আসছে। খুব তাড়াতাড়ি ই শেষ হয়ে যাবে। জনি কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে থাকে, রিকশার উপর চোখ বন্ধ করে থাকলে মনে হয় রিকশা পিছন দিকে যাচ্ছে। ইশ, জীবনটাও যদি এভাবে পিছনে চলে যেত একবার।
"মামা, কি হইছে আপনের?"
"কিছুনা, তুমি যাও।"
কিছুক্ষন বাদে জনি জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা মামা, জীবনটা তোমার কেমন লাগে"
রিকশাওয়ালা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে, "জাহান্নামের মতো। এইখানে সব বাটপার ভরা, ভালো মানুষের কোন দাম নাই। মন চায় সবগুলারে মাইরা ফালাইয়া নিজেও মইরা যাই"
আসলেই পৃথিবীতে ভালো মানুষের কোন দাম নেই। জনি ছোটবেলা থেকে কখনো কোন খারাপ ছেলেদের সাথে মেশে নি, স্কুল কলেজে ভালো ফলাফল করে এখন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। জীবনে একটা সিগারেটে টান দেয় নি। তাদের পাশের বাসায় একবার এক লোক এইডস হয়ে মারা গেল, তাঁর খারাপ জায়গায় চলাফেরা ছিল। কিন্তু জনি নিজে জীবনে খারাপ জায়গায় যাওয়া তো দূরের কথা, ৩ বছরের প্রেমে নিজের প্রেমিকার একাধিকবার আহ্বান সত্ত্বেও কখনো সাড়া দেয়নি, তাঁর বিবেকে বেঁধেছে। কখনো কোন কারণে এই মেয়েটার সাথে তার বিয়ে না হলে সে সারাজীবন তার স্ত্রীর কাছে অপরাধবোধে পুড়বে। কিন্তু, আজ সেই বিবেক দিয়ে কি হবে। অমানুষরা তার বিবেককে গলা টিপে মেরে ফেলেছে। জনির চোখে পানি চলে আসে। এই পৃথিবীতে বিবেকের কোন দাম নেই, কোন দাম নেই। জয়ী হতে পারাটাই বড় কথা।
জনি হঠাৎ চোখ মোছে, ফোন দেয় তার বন্ধু সাবেত কে।
"দোস, একটু জরুরী। আমি তোকে পরে সব বুঝিয়ে বলবো। আমাকে কিছুক্ষন তোর মেসটা ছেড়ে দিতে হবে, ওকে নিয়ে আসবো একটু। যা তোকে চা-সিগারেট খাইয়ে দিবো নে"
সাবেত একটু হেসে বলে, "ওকে দোস, কোন সমস্যা নাই। তুই আয়"
জনি ফোন দেয় তার প্রেমিকাকে।
"কোথায় তুমি?"
"আমি ক্যাম্পাসে"
"আমি আসছি। আমার সাথে একজায়গায় যেতে হবে তোমাকে, আর্জেন্ট।"
"ওকে জান। আসো তুমি"
জনির ঠোঁটে ক্রুর হাসি ফুটে উঠে। পৃথিবীতে ভালো মানুষের কোন দাম নেই, কাজেই এই খারাপ পৃথিবীর উপর আজ থেকে শুরু হল তার প্রতিশোধ। জনি পাগলের মতো গলা ফাটিয়ে হেসে ওঠে- হাহা হাহা হাহা।
রিকশাওয়ালা ও আশেপাশের পথচারীরা অবাক চোখে তার দিকে তাকায়। মাথার উপরে একটা ঘুড়ি বৈদ্যুতিক তারে পেঁচিয়ে যতবার ই উড়ে যেতে চাচ্ছে ততবার ই নির্দয়ভাবে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে।