১.
রাতে ভাত খাওয়া শেষ করে খাটের উপর শুয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছিলো মালেকা বানু। জ্যৈষ্ঠের ভ্যাপসা গরমে বুদবুদ উঠছে মাটির চামড়া ভেদ করে। একটু বাতাস ও নেই যে গাছের পাতায় শিরশিরে শব্দ হবে খানিকটা, ভৌতিক নিস্তব্ধ রাত। হঠাৎ উঠোন থেকে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ শুরু করে। মালেকা বানু আর তার স্বামী বজলু কান খাড়া করে, হাতের চালানো পাখা থামিয়ে দেয় মালেকা বানু, এলাকার মাতবর করিম সাহেবের গলা শুনতে পাওয়া যায়, সাথে এলাকার কিছু মানুষ উত্তেজিত গলায় কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। মালেকা বানু তার স্বামীকে বলে, "কি হইছে? হেরা এতো রাইতে কই যায়? কিছু হইছে নি?" বজলু বিরক্ত গলায় বলে, "এতো কথা কও কেন? মেয়েলোকের এতোকিছু জানার দরকার নাই। চুপ কইরা থাকো।" মালেকা খানিকটা নিরাশ হয়ে চুপ করে যায়, আবার হাতের পাখা ঘুরাতে শুরু করে। বজলু বিড়বিড় করে বলতে থাকে, "পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার কালে। মাতবর, তোমার পাখা এইবার আমি বজলু টাইনা টাইনা ছিঁড়বো।" মালেকা স্পষ্ট কিছু শুনতে পায় না।
বজলু গত সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন শহর থেকে আসা সরকারি লোকের সাথে তাদের কাজ ও পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছে। সরকারি লোকেরা তলে তলে এলাকায় রাজাকার বাহিনি গঠন করছে, বজলুকে করেছে এলাকার রাজাকার বাহিনীর প্রধান। মাতবর নাকি স্বাধীনতার কথা বলে সবাইকে, পাকিস্তান সরকার মানে না, শেখ সাবের কথা মানে। সরকারি লোকেরা বলেছে, কিছুদিনের মধ্যেই এলাকায় পাকিস্তান মিলিটারি ঢুকে পড়বে। তখন রাজাকার বাহিনীর প্রথম কাজ হবে মাতবরকে খতম করা, মাতবর বেঁচে থাকলে এলাকার মানুষদের বশ করা যাবে না, তারা মাতবরের কথা শুনবে। মাতবর মানুষ ভালো। বজলু স্বাধীনতা বোঝে না, বিদ্রোহ বোঝে না, দেশ নিয়েও তার কোন মাথাব্যথা নেই। শান্তি কমিটিতে তার যোগ দেয়ার প্রধান কারণ সে নিজেও মাতবরকে খতম করতে চায়। বজলু গত শীতে পাশের গ্রামের এক বুড়ির ভিটা দখল দিতে চেয়েছিল। বুড়ির কেউ নেই, একলা ভিটায় ছোট্ট চালাটায় থাকতো আর ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করে খেত। বজলু ভেবেছিল ওই বুড়ির ভিটা দখল দিলে বুড়ি আর কি করবে, বজলু কিছু মানুষ ভাড়া করে বুড়ির জমি দখল দিয়ে দিলো। কিন্তু বুড়িটা এই গ্রামে ঢুকে মাতবর কে বিচার দিলো। মাতবর ভরা মজলিসে বজলুকে ধরে নিয়ে সেই ভয়ানক শীতের মধ্যে গালে জুতা দিয়ে পিটালো, মারের চোটে বজলুর গাল ফেটে রক্ত বেরোতে থাকলো। গ্রামের সব মানুষ চোখ ভরা ঘৃণা নিয়ে সেদিন বজলুর মার খাওয়া দেখছিল।
সেই ভয়ানক স্মৃতি মনে পড়ে আতঙ্কে বজলুর বুক হিম হয়ে আসল। বজলুর সামনে সব ঝাপসা কুয়াসায় ঢেকে যাচ্ছে, সেই শীতের রাত ফিরে এসেছে মনে হচ্ছে। বজলু গ্রামের মানুষদের সেই চোখগুলো দেখতে পাচ্ছে, বজলুর গালে প্রচণ্ড ব্যথা লাগছে, মনে হচ্ছে চামড়া ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। বজলুর নাক-চোখের কুঁচকানো চামড়া ভয়ে তিরতির করে কাঁপছে। প্রচণ্ড শীতে মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে মালেকা বানুকে কাঁপা গলায় বলে, "ও বউ, কাঁথা আনো তাড়াতাড়ি। শীতে মইরা গেলাম।" মালেকা বানু ভয় পেয়ে যায়, এই গরমের রাতে লোকটা কি বলছে!!
২. (কিছুদিন বাদের একটা রাত)
আজ খুব বাতাস আছে, করিম মাতবরের বাড়ির উঠোন ভরা জোছনা। করিম মাতবর আর তার বউ ভাত খেয়ে উঠোনে পাটি পেতে বসে পান খাচ্ছে। তাদের দশ বছর বয়সী ছেলে কিসলু এক মুঠো ভাত এনে তার পোষা শালিকের বাচ্চার খাঁচায় দিলো। তারপর এসে বলল, "আব্বা, শামিমগো লগে মাছ ধরতে যামু। আজকে ভরা পূর্ণিমায় অনেক মাছ পাওয়া যাইব।" করিম মাতবরের বউ বারণ করে, "অনেক রাত। যাওয়ার দরকার নাই।" করিম মাতবর বলে ওঠে, "আহারে, যাইতে দেও না। তাড়াতাড়ি চইলা আসবো নে।"। ছেলেটা হাতে মাছ রাখার আগলটা দুলাতে দুলাতে দৌড়ে চলে যায়।
করিম মাতবর তার রেডিওটা নিয়ে খবরটা ধরানোর চেষ্টা করে। মাতবরের বউ বলে, আজকে কি কিছু হইছে নাকি শহরে, শেখ সাব কিছু কইছে?" মাতবর বলতে শুরু করে, "বুঝলা বউ, দেশ স্বাধীন হইতে আর বেশি দেরি নাই।" আরও অনেক কিছু অনবরত বলতেই থাকে, সেগুলো ঠিকমতো বুঝতে পারে না সরল-সোজা গৃহবধু। তবুও সে প্রতিদিন ই জিজ্ঞেস করে কারণ স্বাধীনতার কথা বলার সময় তার স্বামীর চোখ খুশিতে ভাসতে থাকে, আবেগে কোনকোনদিন এই পুরুষ মানুষটা শিশুর মতো আচরণ করে। এটা দেখতে খুব ভালো লাগে মাতবরের স্ত্রীর। সেও আজকাল স্বাধীনতার কথা ভালবাসতে শুরু করেছে।
কিসলু মাছধরা শেষে বাড়ি ফিরছে আগলে গোটা কয়েক কই মাছ নিয়ে। খুব খুশি লাগছে, মা কই মাছের ঝোল খুব পছন্দ করে।
৪.
বজলু রাজাকার বাহিনি সাথে করে মিলিটারির গাড়িতে করে মাতবরের বাড়ির দিকে আসছে। উত্তেজনায় বজলুর কপাল ঘামছে, আজকে মাতবরের শেষ দিন। বজলু গালে হাত বুলায়, "এই গালে তুই জুতা মারছিলি মাতবর"।
৫.
কিসলু বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে, ওইতো উঠোনে হারিকেনের মৃদু আলোটা দেখা যাচ্ছে। এমন সময় দেখলো উঠোনে ঢুকে পড়েছে একটা গাড়ি। গাড়ি থামিয়েই কতগুলো মিলিটারি খটাখট বুটের শব্দ করে লাফিয়ে নেমে পড়ে গাড়ি থেকে, ওদের সাথে বজলু ও আছে। কিসলুর আব্বা ওদের দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। একজন মিলিটারি বন্দুক উচিয়ে গুলি করলো, গুলিটা বুকের পাশে লাগলো, আছড়ে পড়লেন মাটিতে করিম মাতবর। কিসলু ছুটে যেতে চাইছে আব্বার কাছে। কিন্তু তার পা আটকে গেছে মাটিতে। এরপর বজলু তার মার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, মায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছে। মা চিৎকার করছে আকাশ ফাটিয়ে। কিসলু ভয়ে জমে গেলো, চিৎকার ও করতে পারছে না, বোবা-কালা হয়ে গেছে। চারপাশের সব যেন শুন্য হয়ে গেছে, থেমে গেছে। শুধু বুকের ভিতরে ভয়ে ঢিপঢিপ করছে। কিসলু অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকলো। আর বজলু মিলিটারিদের সাথে নিয়ে পৈশাচিক উল্লাস করলো, করিম মাতবরের লাশ আর তার স্ত্রীর নিথর দেহ গাড়িতে তুলল, ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলো। বজলু উঠানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন পাগলের মতো হাহা করে গোলা ফাটিয়ে হাসল। খাঁচায় বাঁধা শালিকের বাচ্চাটা ভয়ে খাচার মধ্যে ছোটাছুটি করতে করতে একসময় ঘরের সাথে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।
৬.
এরপর একদিন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, কিসলুর জ্ঞানও ফিরে এসেছে এক সময়। কিন্তু তার বুকের সেই ঢিপঢিপ শব্দ আজো থামেনি। থামেনি বজলুর সেই হাসিও। আজো কিসলুর মতো বাংলাদেশের বুক ভয়ে ঢিপঢিপ করে। আর বজলুরা আজো সেই পাগলের মতো হাসি হেসে চলে দেশের বুকে দাঁড়িয়ে। দেশ স্বাধীন হলেও খাঁচার শালিক পাখিটা স্বাধীন হয়নি, তারা বজলুদের হাতে এখনো প্রতিনিয়ত পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে। বাংলাদেশ এখনো খাঁচায় বন্দী শালিক হয়েই রইলো।