আমি মোহাম্মদপুর মডেল কলেজ এর পদার্থবিজ্ঞান এর শিক্ষক, সালমান রহমান। বয়স ৪০। আজ কলেজ এ যেতে ইচ্ছে করছে না। বৃষ্টির দিনগুলোতে কোন কাজ করতে ভালো লাগে না, অলসভাবে বৃষ্টি দেখতেই সুখ। বৃষ্টির ঝাপটাগুলো বড় নস্টালজিক করে দেয়। বৃষ্টির ফোটাগুলো মেঘের ওপার থেকে বয়ে নিয়ে আসে কিছু অভিজ্ঞ করুন স্মৃতি। এজন্যই বোধ হয় ধুঁকে ধুঁকে জন্মানো মুক্তার মতই বৃষ্টির ফোটার আকৃতি ও গোল হয়। অবশ্য, পদার্থবিজ্ঞান বলে এর পিছনে কাজ করে পানির সারফেস টেনশন।
বর্ষার দিনে বেশি মনে পড়ে যায় কলেজ জীবনের সেই দিনগুলোর কথা। আমার এখনকার এই জীবনের পিছনে সেই দিনগুলোই বেশি দায়ী। একদিন এমন বর্ষাভেজা দিনে এক স্যার এর কাছে প্রাইভেট পড়তে গেলাম, স্যার ধরেই বসিয়ে দিলেন পরীক্ষায়। একদম আচমকা, আর পদার্থবিজ্ঞান বিষয়টা খুব একটা ভালো পারতাম ও না। কাজেই পরীক্ষায় পেলাম গোল্লা। কিন্তু গোল্লা শুধু আমি একা পাই নি, আরও একটা মেয়ে পেয়েছিল। সেই মেয়েটার চেহারায় একটা স্নিগ্ধতা ছিল- পরীদের মতো, আর চুলগুলো ছিল অনেক লম্বা। মেয়েটার নাম ও ছিল পরী। ক্লাস থেকে বের হতেই পরী খুব চেনা মানুষের মতই বলল, পরীক্ষায় গোল্লা পেয়েছ কেন? আমি হতচকিত হয়ে বলে ফেলেছিলাম, ইয়ে মানে, কিভাবে যেন সব শূন্য হয়ে গেল। ই হিহি হিহি করে হেসে হাতের পদার্থবিজ্ঞান বইটা দিয়ে আলতো করে খুনসুটির আঘাত করে পরী বলেছিল, তোমাকে কি পরী আছর করেছে নাকি? উল্টাপাল্টা কথা বল কেন...। আমি ওই আলতো আঘাতেই আমার হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়া হজম করছিলাম বলে ওর প্রশ্নের নিদারুন সত্যতা উপলব্ধি করেও উত্তর দিতে পারলাম না। ও ই আরও অনেক কথা বলতে বলতে ছিটে ছিটে বৃষ্টির মধ্যে আমার পাশে হেঁটে হেঁটে ওর বাসা পর্যন্ত এলো।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেবারের বর্ষায় প্রতিটা দিন ই আমি আর পরী মেঘলা বিকেলে বৃষ্টি তে ভিজে ভিজে হাঁটতাম। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা আমাদের আপন করে নিত। এভাবে বৃষ্টি, কাঁদা আর কিছু অনর্থক, কিন্তু অসম্ভব ভালোলাগা কথোপকথন গায়ে মেখে যখন রোজ বাসায় ফিরতাম, মা সত্যি ই ভাবত কোন পরী আছর করেছে বোধ হয় আমাকে।
আর একটা কথা বলা হয় নি, এরপর থেকে সারাদিন ই আমি পদার্থবিজ্ঞান বইটাই পড়তাম। ওই বইতেই যে আছে পরীর হাতের ছোঁয়া। বইটা খুললেই পরী ভেসে উঠত সামনে, বইয়ের পাতা থেকে ভেসে আসা গন্ধ কে ওর গন্ধ ভেবে আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম।রিমঝিম বর্ষার দিনগুলোর মাঝে আচমকাই ঝড় হয়ে এলো একটা চিঠি। বান্ধবীর মাধ্যমে পৌঁছান আমাকে লেখা পরীর চিঠি। হঠাৎ করেই ওরা পুরো পরিবার আমেরিকায় চলে যাচ্ছে, আমার সাথে শেষ দেখা করার ও সুযোগ হল না। তাই এই চিঠি। কোন যোগাযোগ করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এভাবেই খুব সহজে পরী উড়ে চলে গেল আমার জীবন থেকে।
পরী চলে গেলেও ওর আছর কাটে নি আমার উপর থেকে। এখনো চিরকুমার ই রয়ে গেলাম। এই আশায়, ইলেকট্রন জোড় থেকে খসে পড়া ইলেকট্রন যেমন ছুটে আসতে চায় তেমনি ও আবার খুঁজে পাবে আমাকে। কিন্তু... পরীরা যে পদার্থবিজ্ঞান মেনে চলে না।
জীবন অবশ্য কেটে যাচ্ছে একভাবে। এখনো বৃষ্টির দিনে জানালা দিয়ে চাতক পাখির মতো ঝাপসা দিগন্তে চেয়ে থাকি। বৃষ্টি থেকে গা বাঁচাতে নীড়ে ফেরা পাখিদের দেখি, আঙিনায় কদম ফুলে ছেয়ে থাকা কদম গাছটাকে দেখি। চোখ দুটো যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিতে নিতে বলি, পরী, তোমার রঙ্গিন কাগজের ডানাগুলো বৃষ্টিতে ভিজে যাক। পাখিদের মতো তুমিও নেমে আসো, নেমে আসো এই কদম গাছের নিচে। বর্ষার প্রথম কদম ফুলটা খোঁপায় গেঁথে আলিঙ্গন করো আমাকে, ভর করো এই বুকে। আজীবন আচ্ছন্ন করে রাখ তোমার জাদুর কাঠির ছোঁয়াতে।