আমি মৃত নগরীর মাঝে আমার রাজ্যপাট সাজাই। অন্ধকার নামতে নামতে শহর মৃত্যুতে তলিয়ে যেতে থাকে। মুমূর্ষু মানুষেরা আসে, হাঁসফাঁস করে, হইচই বাঁধায়, যাঁতার মতো পা পিষে দূরে অসুস্থতার দিকে হেঁটে যায়, ঘরফেরা দানবেরা ধ্বংস নামিয়ে দেয় জমজমাট শহরে।। রাশি রাশি অসুস্থতার জীবাণু ছড়িয়ে যায় সুস্থ মানুষদেরও রক্তের কণায় কণায়। তারপর আমি নামি, আমার একজোড়া ইকারাসের ডানা আছে। আমি উড়ে বেড়াই রাতের সেই বিধ্বস্ত শহরের পতিত রানওয়ে ধরে, বেওয়ারিশ বিছিয়ে দেয়া পূর্ণিমায় খুঁজে ফিরি গোপনে ফুটে থাকা একটা রাতফুল জঞ্জালের ফোঁকরে। কাঁচপোকারা হাতে লাল রুমাল উড়িয়ে নিয়ে আসে বিষাক্ত ফুটপাথে হোলি খেলতে। যাবতীয় জয়-পরাজয়ের হুল্লোড় সব বুকপকেটে পুরে আমিও খেলতে নামি। অট্টালিকা বেয়ে নেমে আসা দোলনায় দুলি, গাড়ি পোঁ পোঁ খেলতে খেলতে চলে যাই ছায়াপথে। মমিঘুমের শহরের কেন্দ্রে আকাশের কাছাকছি একলা দাঁড়িয়ে বুক ভরে বাতাস টেনে নেই, আমি নটরাজ। এই রাজ্যের একেকটা জানালা একেকটা বায়োস্কোপ, সংসার, চিত্রকল্প। গভীর রাতে নাগরিকদের খুলে রাখা জানালা দিয়ে খামে উড়িয়ে পাঠাই আমি পিপাসার্ত ঝিঝিদের গান, ঘুমন্ত মানুষেরা সেই গান শোনে না। প্রেয়সীর বাম হাতখানা আগলে রাখে ঘুমন্ত ভালুকটাকে। বায়োস্কোপের কোন কোন জানালার ওপারে রাতের গোপনীয়তায় বালিকার ওড়না মাটিতে লুটায় আনমনা ভাবনায়, রান্না-বাটি খেলার স্মৃতিঅভিজ্ঞান থেকে জীবনের পাজল মিলাতে চেষ্টা করে। চরমপন্থিরা পুষে রাখে মৃগনাভ স্বপ্নমর্গের ভাঁজে ভাঁজে। রাত কাউকে পথ দেখায়, কেউ ফানুশ উড়িয়ে পথ খোঁজে। আর আমি অসহায় বেপরোয়া ঘাতক। আমার আমি নিজেই একটা পথ, তবু বিড়বিড় করে সবাই বলে, "তুমি মাতাল, বাড়ি যাও।"
বাড়িফেরার উদ্দেশে আমি রাতদুপুরে মাতাল পা টেনে টেনে দাঁড়াই, আমার ছায়া দিনপুঁজি শুয়ে থাকে রাস্তার বুকে। আমি আমার ছায়ার মতো হতে চেয়েও পারি না, সভ্যতার ত্রাণকর্তারা নিন্দে করে। বিচ্ছেদ বিগত প্রেমিকের মতো ফুটপাথে মাথা নুইয়ে থাকা রোডল্যাম্প এর নিচে খানিক দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালাই, নিয়ন হলদে আলোতে চামড়া মৃতদের মতো ফ্যাকাশে লাগে, কিন্তু আমি মৃত না। মরে গেছে শহরবাসীরা। আমার রোডল্যাম্প এর মতো সোফিয়ারও একটা মাথা নুয়ে থাকা ঝরনা আছে। ওটার নিচে যখন গোসল করে, ওর শরীরের বাঁকগুলো ভিজে নাঙ্গা তলোয়ারের মতো ধারালো হয়ে ওঠে, চাবুকের মতো শাসন করে যায় জড়িয়ে থাকা ভিজে চুল। রোডল্যাম্পের নিচে আলো-আধারির খেলার মাঝে সিগারেটে টান দিয়ে দমকা ধোঁয়া ছাড়ি আমি, ধোঁয়াশার নাচন দেখি, অপার্থিব দৃশ্য। সোফিয়া ভালো নাচতে পারে, কিন্তু ও এই নাচের খবর জানে না। আমরা সবাই হাতড়ে ফিরি এপিটাফের উপর, স্টেশন থেকে অনেক দূরে। আমাকেও বাড়ি ফিরতে হবে, আমি অবাধ্য পায়ে বাড়ির দিকে যাই। নর্তকী রাত ঘোমটা তুলে পথ আগলে দাঁড়ায়। প্রতিটা রাতই বেশ্যাদের মতো আমায় আহবান করে, কুমারিত্বের ভান করে। আমি ওদের পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে যাই, এখন উড়ছি না। মন খারাপ। বাড়ির দরজা ভেদ করলেই সোফিয়া হুলস্থুল বাঁধাবে। বড়লোকের একমাত্র সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার অনেক ফ্যাঁকড়া। আপেক্ষিকতার দেড়পাকে ফ্যাঁকড়াগুলোকে পকেটে পুরে আমি দরজায় নক করি। আচ্ছা, সভ্য মানুষেরা দরজা বন্ধ করে রাখে কেন?
সোফিয়া দরজা খুলতেই আমি বেদম আছড়ে পড়ি, একদম মেঝেতে। সোফিয়ার রাগ গলে যায়, অভিমানগুলো মমতায় রুপ নেয়, নারী তো। আমাকে ধরে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়। "লেগেছে কোথাও?" সোফিয়ার কথায় কাতরতা মিশে আছে। "তোমাকে আমি কতবার বলেছি এইসব ছাইপাশের দিকে মুখ তুলেও তাকাবে না।......।। দেখো প্লিজ, তুমি একটা ট্যালেন্ট ছেলে। তুমি চাইলেই একটা ব্রাইট ক্যারিয়ার নিজের হাতে গড়ে নিতে পারো। মেধাকে এভাবে মেরে ফেলছ কেন? তুমি একটা জিনিয়াস ছেলে বলেই আমার বাবা তোমাকে বেছে নিয়েছে। এরকম ভবঘুরের মতো বুলশিট একটা আইডিয়া তুমি কিভাবে বেছে নিলে।? আমার পরিচিত কারো কাছে পর্যন্ত তোমার কথা আমি মুখ ফুটে বলতে পারি না।"
"আমার বাবা তো আমার জন্য যথেষ্টই রেখে গেছেন, খুব ভালোভাবেই তো চলে যাচ্ছে, আমার কাজ করার তো কোন দরকার নেই, কোন না। আমি ভাবতেই পছন্দ করি।" কথাগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। "আচ্ছা সোফিয়া, তুমি কি আলোয় ধোঁয়াশার নাচন দেখেছ কখনো?"
সোফিয়া ঝরঝর করে কেঁদে দিলো, বাপের টাকাওয়ালা মেয়েদের আবেগ থাকে না। কিন্তু এই মেয়েটা অন্যরকম। এখানেই সমস্যা, এই একটা পিছুটানেই আটকে যাই। কান্না দেখতে ভালো লাগে না, তাই আরেকটা সিগারেট ধরালাম। "প্লিজ ফালাও ওটা। আমার দিকে তাকাও, তোমার কি একটুও ভালবাসা নেই আমার প্রতি? তুমি ভালো করে আমার দিকে তাকাও। আমার কাছে আসো।" সোফিয়া এগিয়ে আসে বুকের খুব কাছে। কখন যেন সিগারেটটা ঠোঁট থেকে পড়ে গেলো, আর ওখানে সোফিয়া ওর একনায়কতন্ত্র কায়েম করে ফেলেছে। আমি হারিয়ে গেছি। সোফিয়ার খোলাপিঠে জানালা দিয়ে ঢোকা আলো পড়েছে। আমি ওর পিঠ বেয়ে নেমে আসা কোমরের বাঁকে হাত রাখলাম। তারপর পৃথিবী থেমে গেছে, বাকি সব মিথ্যা, সব। কবিতারা সব মিথ্যা, আমার কোন কবিতা চাই না। এর চেয়ে কবিতাময় কোন জগত নেই। জন্ম-জন্মান্তর সব মিশে গেছে এই দুই দেহের সঙ্গমে। বাকি সব ই মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা।
তারপর, নেশার ক্লান্তির ঘুমে আমি তলিয়ে। স্বপ্নের রাজ্যে ধীর পদচারনায় কেউ কেউ আসে, কেউ চলে যায়। নাম ধরেও বা ডাকে, আমি চিনতে পারছি না। আমি ধীরে হেঁটে যাচ্ছি, কোন গন্তব্য নেই। পুবাকাশে একটা চাঁদ উঠেছে পূর্ণিমার, চাঁদ থেকে একটা চিঠি উড়ে আসছে- চাঁদের যাবতীয় কলঙ্কের স্বীকারোক্তির অপার্থিব কবিতা। আমি চিঠি ধরার জন্য ছুটছি, খুব কাছাকাছি ই- কিন্তু ধরতে পারছি না। রাস্তার মোড়ে আলোচনারত সম্ভ্রান্ত ভদ্রপোশাকের একদল লোক চিঠিটা পেয়ে গেলো। হাত বাড়ালাম, "ভাই, আমাকে চিঠিটা দিয়ে দিন, ওটা আমার জন্য"। কথাটা শোনার পরই দলটার সুন্দর পোশাকের আড়াল থেকে ভয়ংকর কতগুলো থাবা বেরিয়ে এল। তারা ধারালো নখ দিয়ে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলল সেই কবিতাখানি। মৃত কবিতাটা তখন আমায় বলতে শুরু করেছে, "তুমি ই আমাকে হত্যা করেছো, তুমি, তুমি। আমি বেঁচে উঠতে চেয়েছিলাম। আমি তোমার মাঝে সুপ্ত ছিলাম ভ্রুন হয়ে, তুমি কাল রাতে আমাকে কবর দিয়ে দিয়েছ। তুমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছ। তোমার রক্তে বিষ মিশে গেছে। তোমার লক্ষ্যই এখন ঘর। তুমি পিছুটানে ফেঁসে গেছো। তুমি আমাকে আর পাবেনা। তুমি মরে যাচ্ছ, মরে যাবে।"
ঘুমের মাঝে রাত পার হয়ে গেছে। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আমার হৃদস্পন্দন ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখছি, বীভৎস খুনির মতো, ভয়ংকর জীবানুতে আক্রান্ত রোগীর মতো, বিকৃত। আমি ভয় পেলাম, আয়না থেকে পালিয়ে কেবিনেটের মদের বোতল বের করে আকণ্ঠ তৃষ্ণা মিটিয়ে নিলাম। এবার আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে। সময় খুব কম। একটা চাদরে মুখ ঢেকে রাস্তায় নেমে এলাম। আজকে সত্যি ই পূর্ণিমা, পুবাকাশে গোল চাঁদ উঠেছে। আমি সেইদিকেই লক্ষ্য করে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদুর সামনে কতগুলো মানুষ একটা চায়ের দোকানে জটলা পাকিয়েছে। চাদরটাকে আরেকবার মুখে ভালোমতো পেঁচিয়ে নেই, সভ্য মানুষেরা দেখলেই পথ আগলাবে। লম্বা পা ফেলে তাড়াতাড়ি পেরিয়ে গেলাম। খুব দ্রুত হাঁটছি, হাঁপিয়ে যাচ্ছি তারপরেও। ভোর হবার আগেই পৌঁছুতে হবে আমার দিগন্তে।
অতঃপর পথচলা অবিরাম। এখন চাঁদটা একটু লালচে হয়ে এসেছে। এক পশলা বাতাস ও বয়ে গেলো আমার চাদরের ঝুল উড়িয়ে। আমার পকেটে মোবাইল বাজছে। এই জঞ্জালটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া উচিত ছিল আগেই। সোফিয়া ফোন দিয়েছে, "অ্যাই, তুমি কোথায়? তোমার জয় নামের একটা বন্ধু আছে না, ও এসেছে, তুমি তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরো। ও অনেক মজার মজার জোকস বলছে"।
হেঁটে হেঁটে পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে, আমি একটু বিশ্রাম নিতে বসলাম। এখানে কোন মানুষ নেই। ক্ষণিক বাদে ফের হাঁটা শুরু, এখনো অনেক দূর। আমি হাঁটছি খুব তাড়াতাড়ি, কখনো একটু ধীরে, একটা পা একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। ফোনটা আবার বাজছে। তখন ফেলে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। কোন পিছুটান নিয়ে ঐ চাঁদ ছুঁয়ে দেয়া সম্ভব না। সোফিয়া ফোনে বলছে, "তুমি এখনো তো আসলে না। আমি আর জয় এখন ঘুরতে যাব। ও খুব মজার মানুষ। তুমি কখন আসবে? তুমি থাকলে তুমিও খুব মজা পেতে।"
আমি মৃদু হেসে ফোনটা অনেক দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। উপলব্ধিতে মানুষের পিছুটান বলেও কিছু নেই, কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। আমার জন্য গত রাতে যে সোফিয়া কেঁদেছিল, যার মনে অনেক ভালবাসা ছিল; যে আলতো গল্পমাখা চায়ের কাপ ও আমাকে বাড়িয়ে দিতো, আমার অনুপস্থিতিতে খানিক শুন্যপ্রহর কাটিয়ে সেই চায়ের কাপ ই জয়কে বাড়িয়ে দিতে সে দ্বিধা করবে না।
চাদরটা খুলে পড়ছিল, আবার পেঁচিয়ে নিলাম। আমি অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি, জনসীমার বাইরে। আরও অনেক পথ বাকি। পা থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এখন সম্পূর্ণই খুঁড়িয়ে চলছি। ব্যাপার না, কবিতাটা পেলেই সব কষ্ট ভুলে যাব, আবার সুস্থ হয়ে উঠবো। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে। আমাকে হাঁটতেই হবে, আমি হাঁটবো। চাঁদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি, চাঁদ এখানে নগ্ন নীল। যদিও আমি খুব ক্লান্ত হয়ে এসেছি, মুখ থুবড়ে পড়ে গেছি রাস্তায়, আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে, সব ঝাপসা নীলের দেয়ালে আটকে গেছে। তবু চাঁদটাকে আমার ধরতেই হবে, চিঠিটা আনতে হবে- সেখানেই কবিতাটা আছে। কলঙ্কিত সেই কবিতাটা কেউ খুঁজে পায় নি, আমাকে জানতেই হবে সেই কবিতা। শহরবাসী মানুষদের জন্য সেখানে বার্তা আছে। তারপর আমি আবার শহরের কেন্দ্রে আকাশের খুব কাছাকছি দাঁড়িয়ে বুক ভরে বাতাস টেনে নিবো। সেই কবিতা পড়ে শুনাবো সমগ্র শহরবাসীর উদ্দেশে, সেখানেই আছে তাদের রোগমুক্তির বার্তা।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৩ রাত ১২:৫১