আমি শ্যামবাজারের সরস্বতী স্কুলে তখন ক্লাস থ্রি তে পড়ি। বয়স সাত কি আট। ফুরফুরে পাতলা চেহারা ছিল। প্রজাপতির মতন এখানে ওখানে ছুটে বেড়াতাম। রান্নাঘরের হঠাৎ দরকারে লাগা মশলাপাতি আনতে বা টুকটাক দোকান বাজার করতে আমারই ডাক পড়তো। আর আমি মনের আনন্দে হাসিমুখে দোকান করে দিতাম।
তখনকার শ্যামবাজারের সাথে এখনকার শ্যামবাজারের পার্থক্য অনেক। তখন গাড়িঘোড়া মানুষজন দোকানপত্র সবই ছিল, তবে অনেক কম কম। রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা। বাড়ীর লোক নিশ্চিন্তে আমাকে ছেড়ে দিত। এমনি একদিন মা আমায় বললেন, যাতো এক ছুট্টে শুকনো লংকা কিনে আন।আমি চললাম লংকা কিনতে।
নিচে দেখি রাস্তার দু ধারে কত লোক সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমিও কিছু না বুঝেই মানুষের সারিতে মিশে দাঁড়িয়ে পড়লম কিন্তু কিছু দেখতে পেলাম না । সামনে বড়রা দাঁড়িয়ে, ডিঙি পেড়ে ঠেলে ঠুলে কোনভাবেই সামনে দাঁড়ানোর জায়গা করে নিলাম। দেখলাম হুড খোলা গাড়ীতে গোলাপফুল হাতে নিয়ে বাচ্চাদের দিকে হাত নাড়তে নাড়তে একজন আসছেন গায়ের রং দুধে আলতায় গোলা, পরণে গলাবন্ধ কোট, মাথায় সাদা টুপি। কাছে আসতে চিনলাম। এঁর ছবি আমি অনেক দেখেছি জওহর লাল নেহেরু।
এরকমই আর একদিন কি কারণে যেন নীচে রাস্তায় গেছি, দেখি রাস্তার দুপাশে মানুষ সার দিয়ে দাঁড়ানো ।।পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝে ফেললাম আবার নিশ্চয়ই কোন বিখ্যাত মানুষ এখান দিয়ে যাবেন।দেখবার জন্য ভীড় ঠেলে এগোতে গেলাম কিন্তু কেউ জায়গা দিলনা।হঠাৎ দেখি আমার মত কয়েকটা ছেলেমেয়ে একটা বেঞ্চিতে উঠে দাঁড়িয়ে আছে । আমিও ওইখানে উঠে পড়লাম দেখলাম ফুলে ঢাকা মৃতদেহ শোকযাত্রা চলেছে।শুনলাম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।এঁর ছবি আমি আমার পাঠ্য বইয়ে দেখেছি।আর একদিন ইস্কুলে গেছি হঠায় আমাদের ছুটি দিয়ে দিল সরোজিনী নাইডু মারা গিয়েছেন তাই।
আর একবার আমি তখন খুবই ছোট বোধহয় পাঁচ কি ছয় বছরের, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে শুনি বাড়ীতে খুব আলোচনা চলছে সুভাষ বোস না কি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ী থেকে পালিয়েছেন। সুভাষ বোস কে, তার কাজ কি, কেনই বা তিনি নিজের বাড়ীতে অন্তরীন ছিলেন এসব কিছুই আমি ভাল করে জানতাম না পরে সুভাষ বোস সম্পর্কে জেনেছি । কিন্তু সেদিনের কথা আমার আবছা মনে আছে বাড়ীতে খালি সুভাষ বোসের আলোচনা বড়রা করছিলেন আর সেদিনের সমস্ত কাগজে শুধু ঐ খবরই ছিল শিরোণামে।
আমিএকবার গান্ধীজীকেও দেখেছিলাম খুব কাছ থেকে।আমার তখন ঐ পাঁচ ছয় বছরই বয়েস। দেশভাগ তখনও হয়নি। আমরা শ্যামবাজারের বাসাবাড়ীতে তখন থাকতাম কিন্তু দেশের বাড়ীতে মাঝে মধ্যেই যাওয়া হত। ওখানে ঝিনেদার বাড়ীতে কাকাকাকিমা আর তাঁর ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকতেন কাকাবাবুর বড় দুইছেলে আমাদের সাথে কোলকাতাতেই থাকতো।
এরকমই একদিন আমরা ঝিনেদায় যাচ্ছি শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে চাপবো শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়ে দেখি সেখানে বিরাট মিছিল করে আসছেন গান্ধীজী। মিছিলের একেবারে সামনে তিনি। এতদিন ছবিতে দেখেছি কিন্তু সেদিন চাক্ষুষ দেখলাম।সেই খাটো ধুতিপরা হাতে লাঠি আর চোখে গোল গোল চশমা।সেটা ১৯৪৬ সাল গান্ধীজী যাচ্ছিলেন নোয়াখালি সেখানে তখন ভয়াবহ দাঙ্গা চলছে।
শ্যামবাজারের ওখানে থাকার জন্যই আমি ঐ বয়সেই বিখ্যাত সব মানুষদের দেখতে পেয়েছিলাম। মনে আছে আমার বিয়ের পরপরই আমার জায়েরা সব দল বেঁধে শ্যামবাজারে এক পারিবারিক বন্ধুর বাড়ীতে গেল । আমাকেও নিয়ে চলল ভদ্রলোকের বাড়ীটা আমাদের শ্যামবাজারের বাড়ীর কাছেই তবে বড় রাস্তা থেকে একটু দূরে। কলকাতায় সেদিন রাণী এলিজাবেথ এসেছিলেন তাঁকে চাক্ষুষ দেখার জন্যই এই আয়োজন আর সবাইয়ের সঙ্গে আমিও দূর থেকে দেখলাম রাণীকে আর মনে মনে ভাবলাম আহা রে আমাদের শ্যামবাজারের বাসায় থাকলে এর থেকে অনেক ভালো করে দেখতে পেতাম ।
আর একবার কলকাতায় এসেছিলেন বুলগানিন আর ক্রুশ্চেভ এঁদেরকেও দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। স্মৃতির পাতা উল্টে ফিরে দেখতে গিয়ে দেখছি এসব এখনও আমার স্মৃতিতে জীবন্ত।আর অনুভব করছি সত্যিই স্মৃতি সুখের।