ইতিমধ্যে আমরা স্কুলে ভর্তি হয়েছি। দাদা বিদ্যাসাগর স্কুলে। আমি আর দিদি সরস্বতী স্কুলে , আমার দুভাই আর মেজকাকার দুই ছেলে ভর্তি হল টাউন স্কুলে।
আমরা সব জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাই বোনেরা সুর করে সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্য্যন্ত পড়াশুনা করতাম। প্রথম ঘরটা ছিল বেশ বড় । ঐ ঘরেই আমরা ছোটবড় মিলিয়ে অন্তত বারো তেরো জন ভাই বোন এক সঙ্গে বসে পড়াশুনো করতাম। অনেকে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ত। ছোটকাকা সিঁড়িতে পা টিপেটিপে উঠতেন কেউ টেরও পেতাম না। সেইজন্য আমরা সতর্ক থাকতাম। তবু ঘুমন্ত অবস্থায় যে ধরা পড়ত তার চুলের মুঠি ধরে ছোটকাকা জানলার শিকের সাথে ঝুলিয়ে দিতেন।
গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা দেশের বাড়িতে যেতাম। তখন আমাদের কি আনন্দই না হত। বাড়িতে গিয়েই ছুটে চলে যেতাম বাগানে। গাছে আম লিচু পেকে থাকত্। কদিন ধরে শুধু আম লিচু কুড়িয়ে বেড়াতাম। তারপর ছুটি যখন ফুরিয়ে যেত, তখন খুব মন খারাপ লাগত আবার ফিরে আসতাম শ্যামবাজারের বাসায়। আবার আমরা সুর করে সকালবেলা পড়াশুনা করতাম। মা রান্না করতেন। মেজপিসিমা সেলাই শিখতে যেতেন। পিসিমা এক একদিন আমাকে আর দিদিকে বিকেল বেলা বেড়াতে নিয়ে যেতেন।
আমার কাজ ছিল বাবাকে দেখাশুনা করা। বাবা তখন মিনার্ভায় নিয়মিত অভিনয় করতেন। মা সারাদিন সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতন সময় পেতেন না। আমি বাবার সমস্ত কাজ যত্ন সহকারে হাসিমুখে করতাম। বাবা অফিস করে অভিনয় সেরে একটু রাত করেই বাড়ি ফিরতেন। বাবার ডাস্টারে, রুমালে মেক-আপ এর রং লেগে থাকতো। আমি সেগুলো কেচে দিতাম। বাবার মোজা রোজ কেচে দিতাম।
অফিস যাবার সময় জুতো মোজা পরিয়ে দিতাম। জামার বোতাম না থাকলে সূচ সূতো দিয়ে বোতাম লাগিয়ে দিতাম। রাতে অফিস থেকে ফিরলে খড়ম গামছা গাড়ু সব গুছিয়ে এগিয়ে দিতাম। বাবা গড়গড়া টানতেন। আমি তামাক সেজে দিতাম। বাবা শৌখিন মানুষ ছিলেন। ফিটফাট থাকতে ভালবাসতেন । আমিও যথাসম্ভভব বাবাকে খুশী রাখার চেষ্টা করতাম।
।
আমাদের দুই বোনের কাজের ভাগ ছিল। কেউ বিছানা পাততাম, কেউ তুলতাম। একদিন আমি সন্ধ্যা দিতাম আর একদিন দিদি। আমাদের দুই বোনের বেশ ভাব ছিল। আমি খুব রোগা ছিলাম বলে দিদি আমাকে কোন ভারী কাজ করতে দিত না।
দোকানপাট দিদি করতে চাইতো না। আমার এসব কাজ করতে বেশ ভালই লাগত। আমি দোকান থেকে টুকটাক চিঁড়ে মুড়ি মশলাপাতি কিনে আনতাম, কোন কোন দিন দ্বারিক ঘোষের দোকান থেকে বড় ভাঁড়ে করে দু-আনা দিয়ে আলুর দম, কখনো চার আনা দিয়ে এক পোয়া দই কিনে আনতাম।
দাদার পড়ার দিকে খুব একটা মন ছিলনা। দেখতাম ফুল্লরার বারোমাস্যা শরৎচন্দ্রের মেজদা বেশ মন দিয়ে পড়ত। নিজের পড়াশুনা রেখে আমাদের উপর সর্বদা কড়া নজর রাখত। ছোট ছোট কাগজের টুকরোয় লিখে স্লিপ বানিয়ে রাখত। পড়তে বসে কেউ যদি বাইরে যেতে চাইতো তবে তাকে স্লিপ দিতে হত। বাথরুমে যেতে গেলে স্লিপ দিতে হত এবং তাকে এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসতে হত।একটু দেরি করলে দাদা তাকে কঠোর শাস্তি দিত।
সারাদিন উঠতে বসতে পড়া ধরে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে দিত। শান্তিতে খেতে পর্যন্ত্ দিত না। দুপুরে খেতে বসে সবাইকে ব্যাকরণ ধরে অতীষ্ঠ করে দিত। আমরাও রীতিমত ভাল করে পড়াশুনা করে বসতাম যাতে দাদা আমাদের ঠকাতে না পারে।
সারা দুপুর ঘুমোত না। দোকান দোকান খেলত। ও হত দোকানদার আমাদের দোকান থেকে জিনিষ কিনতে হত। দুপুরে টিন বাজিয়ে শব্দ করত মা-রা যাতে ঘুমোতে না পারে। আমরা এঁটো পাড়তে গেলে তাড়াতাড়ি দেখতে আসতো ন্যাতার তলায় গোবর আছে কিনা। ওর কাজই ছিল আমাদের পেছনে লাগা। সুযোগ পেলেই ঠাকুমার কাছে নালিশ করে আমাদের বকা খাওয়াত । মা রেগে গিয়ে বলতেন এসব দিকে মন না দিয়ে নিজের পড়ার দিকে মন দে।
দাদার নিজের দিকে অত লক্ষ্য ছিলনা। কিন্তু ভাই বোনেরা যাতে সব দিক থেকে চৌখস হয়ে ওঠে সেই দিকে খুব লক্ষ্য ছিল্। দাদা ভাই বোনদের নিয়ে স্পোর্টসের ব্যবস্হা করত। স্পো্র্টস মানে বিস্কুট রেস অঙ্ক রেস ছুঁচে সূতো পরানো এইসব আর কি। দাদা আবার সফল প্রতিযোগীদের প্রাইজ দিত।
দাদা মাঝে মাঝে আমাদের ভাই বোনেদের নিয়ে নাটক করত। নিজেই নাটক লিখত। আমাদের নাটকে অংশগ্রহণ করা ছিল বাধ্যতামূলক। নাটক অভিনীত হত বড় ঘরটায় । দর্শক হিসাবে উপস্থিত থাকতেন মা কাকিমারা। এঁদের উপস্থিতিও ছিল বাধ্যতামূলক।
আমাকে দাদা একবার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করাবার জন্য বাছল। বেঁটে না মঙ্গল কি যেন নাম চরিত্রটার আজ আর ঠিক মনে নেই । যাই হোক, প্যান্ট শার্ট পরে রিহর্সাল দিতে গিয়ে আমি কিছুতেই সুবিধা করতে পারছিলাম না। ডায়লগ বলতে গিয়ে হেসে ফেলছিলাম । দাদা অনেক বকা ঝকা করেও বিশেষ কিছু হলনা । শেষে সেবারের মত আমায় নাটক থেকে বার করে দিল ।আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ।
এবার স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি পড়লে আমরা ঝিনেদার বাড়িতে বেড়াতে গেলাম । গিয়ে দেখি গাছে প্রচুর আম লিচু পেকে আছে। মা কাকিমা দেখতাম, এক থলো করে লিচু পেড়ে নিয়ে রান্নাঘরে লিচু খেতে খতে রান্না করত। আমরা ভাইবোনেরা আম লিচু পাড়তাম আর ইচছামত খেতাম। দাদা গাছে উঠে বসে থাকত, আর লিচু পাড়তে পাড়তে কেউ বেশি নিয়ে ফেলছে কিনা দেখত । নিজে একবার একগাদা লিচু মুখে পুরে আমরা বেশি লিচু ছিঁড়ছি বলে আমাদের সাথে ঝগড়া করতে গিয়ে হাত ফস্কে নিচে পড়ে গেল। আমি একটু দূরে ছিলাম । ভীষণ জোর শব্দ শুনে ভেবেছি বড় থোল লিচু পড়েছে । এসে দেখি দাদা মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
দাদাকে কলকাতায় এনে মেডিক্যালে ভর্তি করা হল। দাদকে হাসপাতলের ডাক্তার নার্সরা সবাই ভালবাসত। কিছুদিন বাদে পায়ে প্লাস্টার বাঁধা অবস্থায় দাদা বাড়ি ফিরে এল। কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই । পা ভাঙ্গা অবস্থাতেই একটা বড় লম্বা লাঠি নিয়ে খাটে বসে বসেই দাদা আমাদের শাসন করতে চেষ্টা করত। সেইবার দেশের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর আর দেশের বাড়িতে যাওয়া হয়নি।
বেশির ভাগ সময় আমরা শেয়ালদা স্টেশন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে শ্যামাজারের বাসায় ফিরতাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নাকে আসত পটল ভাজা আর মুগের ডালের সুন্দর গন্ধ । যা আজও আমার স্মৃতিতে সজীব হয়ে আছে।