এইসময় ছোটকাকার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু হল। নানান জায়গায় ঠাকুমা পিসিমা দিদি আর আমি মেয়ে দেখতে যেতাম। কোন মেয়েই পছন্দ হচ্ছিল না। একবার টালিগঞ্জে আমরা একই দিনে দুটো মেয়ে দেখতে গেলাম। প্রথম যে মেয়েটাকে আমরা দেখতে গেলাম তাকে আমাদের কারোরই পছন্দ হল না। মেয়েটা যেমনি মোটা তেমনি কালো।
সেইদিনই আর একটা মেয়ে দেখতে গেলাম ওই টালিগঞ্জেই। আমরা যখন গেলাম, মেয়ে তখন বাড়িতে ছিলনা। মাসতুতো ভাইকে কোলে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়ে ফিরে এল। মেয়ের গায়ের রং ভীষণ ফরসা। এত ফরসা যে মাথার চুলগুলো লালচে। মাথায় মস্ত বড় একটা বড় খোঁপা বাঁধা। পরণে একটা চেককাটা শান্তিপুরে শাড়ী। আমাদের সবার মেয়ে দেখে খুব পছন্দ হল। ঠাকুমা চুলটা খুলে দেখতে চাইলেন। ঠাকুমার এই স্বভাব আমার একদম পছন্দ হতনা । ঠাকুমার ওপর আমার খুব রাগ হচ্ছিল। মেয়ের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুল। ভালই দেখতে লম্বা দোহারা চেহারা। দেখে পছন্দতো হয়েই ছিল তারপর গান শুনে খবার দাবার খেয়ে আমরা মোহিত হয়ে চলে এলাম। মেয়ে দেখে ঠাকুমার খুব পছন্দ হল।
মেয়ের মা বাবা কেউ বেঁচে নেই । একটা মাত্র দাদা। মেয়ে কখনও মেসোর কাছে টালিগঞ্জে, কখনও ঈশ্বরদীতে মামার কাছে থাকত ওঁরাই ছিলেন অভিভাবক। মেয়ের মেসোর সাথে আমার বাবার আলাপ ছিল । তিনিই বাবাকে দেখে বিয়ের প্রস্তাব তোলেন। ওঁরা আর ছেলে দেখতেও চাইলেন না। বাবার পরিচয়ই ওঁদের কাছে যথেষ্ট ছিল।
এইবার আমাদের বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। আমাদের সকলেরই নতুন নতুন করে পোষাক তৈরী হল। বাবা কৃষ্ণচূড়া আমলেট দিয়ে আর্শীবাদ করে এলেন। ছোটকাকার ব্যবসায় তখন রমরমা অবস্হা । ছোটকাকা সুন্দর সু্ন্দর ডিজাইনের নানা ধরনের গহনা তৈরী করে বাড়ীর সব বড়দের হাত দিয়ে একটা করে উপহার দেওয়ালেন। তখন জ্যৈষ্ঠ মাস স্কুলগুলোতে গরমের ছুটি পড়ে গিয়েছিল। ছোটকাকা বিয়ে উপলক্ষ্যে নিবেদিতা স্কুল ভাড়া নিলেন।
বিয়ের চারদিন আগে আমরা স্কুল বাড়িতে চলে এলাম। গায়ে হলুদের তত্বে পাঠানো হয়েছিল একটা মস্ত বড় রুই মাছ। তারপর আরও কত বিয়ে দেখলাম, কিন্তু কোন তত্বে অতবড় মাছ দেখিনি। বেনারসী শাড়িই কেনা হয়েছিল তিনখানা। একটা ছিল নীল রংয়ের জমি তার ওপর বড়বড় জরির কাজ করা ফুল। এছাড়া ছিল ঢাকাই শাড়ি আর তাঁতের শাড়ি। কি সব নাম অনন্যা, মানে না মানা, দেখতে খুব সুন্দর ছিল শাড়িগুলো, তাই বোধহয় আমার আজও মনে আছে। বিয়ের জন্য কবিতা ছাপা হয়েছিল। কবিতার একটা লাইন এখনও মনে আছে, " টালিগঞ্জে আনতে কাকী
শহর থেকে দূরে--"
আমরা সাজগোজ করেছিলাম খুব। ছোটকাকা আমাকে আর দিদিকে দুটো করে জামা বানিয়ে দিয়ে ছিলেন। নীলনেটের উপর সাদা ফুল কাটা জামা আর খয়েরী রং এর সিল্কের শালোয়ার কামিজ। কানে বরফি প্যাটার্নের ঝোলা মিনে করা সোনার দুল। দু বোনের একই রকম । বিয়েতে আমরা বরযাত্রী গিয়ে ছিলাম।
বর যখন বিয়ের আসরে পৌঁছল, তখন খুব চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। আমরা খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ঘুম ভাল করে নাহলে ছোটকাকার চোখ লাল হয়ে যেত। বিয়ের আগে ছোট কাকিমার দাদা ছেলে দেখেননি। ছেলের গায়ের রং কুচকুচে কালো, চোখ টুক টুকে লাল । স্বাভাবিক ভাবেই তিনি মনে করলেন ছেলে নিশ্চয় নেশা করে।সেইজন্য তিনি বিয়ে দেবেন না বলে বেঁকে বসলেন।সবাই তাঁকে বোঝাতে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়ে গেল। বৌ নিয়ে ফেরার সময় গাড়ীতে দিদি বসল কাকিমার কোলে। আমি ছোটকাকার কোলে বসলাম।আমার সমস্ত আনন্দই মাটি হয়ে গেল। আমি কোনমতে আড়ষ্ট হয়ে ছোটকাকার কোলে বসে রইলাম।
বাড়ি ফেরার পর সবাই বউ কে নানা রকমের গহনা দিয়ে আশীর্বাদ করতে লাগলো। বৌকে বলা হল সবার কানে মধু দিতে। ছোটকাকা মাকে দেখিয়ে বলতে লাগলেন, এঁর কানে বেশি করে মধু দাও। মাও বললেন তোমার কথা আমি মধুর মত মিষ্টি না শুনলেও তোমার কিছু যায় আসে না, বরং তোমার কথা যাদের কাছে মধুর মত না লাগলে তোমার ক্ষতি, তাদের কানে বেশি করে মধু দাও।
তখন বিয়েতে লোক নিমন্ত্রণ নিয়ন্ত্রন করা হয়েছিল অর্থাৎ বেশি লোক খাওয়ানোর নিয়ম ছিল না। কিন্তু ছোটো কাকা যথারীতি বেশি লোক নিমন্ত্রণ করেছিল যা ছিল আইন বিরুদ্ধ। নেমন্তন্য খাওয়ানোর জন্য ছোটকাকা ফুলকাটা ডিশ এনেছিলেন। নিমন্ত্রিত অতিথিরা চলে গেলে ছোটকাকা অনেক রাতে চুপিচুপি এঁটো ডিশগুলো বাইরে ফেলতে গেলে ছোটকাকাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে বাড়ির চেহারা বদলে গেল। ছো্টকাকিমা কাঁদতে লাগলেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই ছোটোকাকা ফিরে এলেন। থানার বড় অফিসার নাকি ছোটোকাকাকে দেখে চিনতে পেরেছেন, বলেছেন, এ কাকে ধরে এনেছিস, এ তো আমাদের নতুন জামাই। পরে শুনেছিলাম ওই অফিসার ছোটকাকিমার সম্পর্কে মামা হন।
বিয়ের পরদিন থেকে দেখলাম, ছোটকাকার ঘরটা একেবারেই দখল হয়ে গেল। যখন তখন ও ঘরে ঢোকা নিষেধ হয়ে গেল। ছোটকাকিমা বেশিরভাগ সময় ঘরেই থাকতেন। বাড়িতে মাত্র তিনটে ঘর । ছোটোকাকার ঘরটা ছিল আমাদের পড়ার ঘর, সন্ধ্যেবেলা ওখানেই পড়তাম। কিন্তু ছোটকাকার বিয়ের পর দেখতাম ছোটকাকা দুপুরবেলাতে দরজা বন্ধ করে ঘুমতে লাগলেন আর রাতেও। যে ছোটকাকা দুপুরে বাড়িতেই ঢুকত না, সে একেবারে ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে গেল। এর রহস্য কি তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতাম না। রহস্য ভেদ করতে পেরেছি অনেক পরে, বড় হয়ে।