somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ-ফেরা

০১ লা আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গল্পঃ-ফেরা প্রথম পর্ব

নিজাম চৌধুরীর মেঝ ছেলে ওয়ারেছ পিতার সবচেয়ে স্নেহভাজন সন্তান।নিজে একজন অভিজ্ঞ ডাকাত বিপরীতে ওয়ারেছ সংসার যজ্ঞে রীতিমত অন্তঃপ্রাণ। এই বিশ বছর বয়সেই কাজে-কর্মে,কথায়-কর্তব্যে, চিন্তায়-মস্তিস্কে সবটাতেই পৌঢ়ত্বের ছাপ। এসব গুণই তাকে পিতার প্রিয় পাত্র করে তুলেছে। সংসারের টুকিটাকি যাই হোক ওয়ারেছকে না জানিয়ে হয় না। এমনকি রাতের কর্মের পরিকল্পনাতেও অনেক সময় ওয়ারেছের বুদ্ধিদীপ্ত মতামত গ্রহণে পিতা লজ্জিতবোধ করেন না। একরাম চৌধুরীর দাফন-কাফন পর্বটিও তাহার মস্তিস্ক প্রসূত পরিকল্পনা থেকে এসেছিল। কিন্তু লাশ কবরস্থানের কাছাকছি হতেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়।একরাম চৌধুরী নিজ গ্রামে কতটা শ্রদ্ধার পাত্র তা সে জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখে আসছে। কিন্তু এই পারদের ঢেউটা একটি বিশাল মাঠ পেরিয়ে আরও উঁচু হয়ে আর পাঁচটি জনপদে আঁচড়ে পড়েছে তা সে ঠাহর করতে পারেনি।

কবরস্থান সংলগ্ন জমিটির প্রস্তাব জানাজায় দাঁড়ানো লোকগুলি নিজাম চৌধুরীর কাছে উন্থাপন করেছিল। এমন প্রস্তাবে হ্যাঁ-না বলাটা তার মুখ থেকেই বেরুবে এমনটিই ওয়ারেছ আশা করেছিল এবং এটাই স্বাভাবিক। এজন্য মৃতের বড় ছেলেকে দিয়ে কথা বলিয়ে সে সবার সাথে আলোচনা করার সময় চেয়ে বিষয়টিকে ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। আবশ্য মৃতের বড় ছেলের ব্যক্তিগত অনাপত্তির কথায় সে ক্ষণিক হতচকিত হয়ে পড়েছিল। বাড়ীতে ফিরে না হয় ওটা বোঝানো যেত। কিন্তু আপন পিতা কর্তৃক যা কিছু ঘটল এক্ষণে সে কিছুই মিলাতে পারছে না।

কবরস্থান থেকে ফিরে একান্তে কথা বলবে ভেবে ঘরে প্রবেশ করেই ওয়ারেছ শোনে পিতা গোছলে নেমেছে। আবার গিয়ে শোনে মসজিদে জোহরের নামাজ পড়তে গেছে। কিন্তু নগদ এক লক্ষ টাকা দান করার সংবাদ কানে আসতেই ওয়ারেছ সিন্দুকের সব টাকা সরিয়ে নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেয়।

নিজাম চৌধুরী মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে এসে বারান্দার চৌকিতে গা এলিয়ে দিয়েছেন। ঈদের মাঠ ও সাথে আপাতত একটি এবতেদায়ী মাদ্রাসার কাজ যাতে আজ থেকেই শুরু করা যায় তার জন্য নিজ উদ্যোগে গত রাতে এশার নামাজের আগে মসজিদে বসে একটি কমিটি করে দিয়েছেন। বিষয়টা ভাবতেই একটা শান্তির হাওয়া মনের মধ্যে দোল খেয়ে গেল।

ভোরের সূর্য্য তখনও গাবগাছের আড়ালে উঁকিঝুকি করছে। এমনি সময় বাড়ীর গেটে জনা তিনেক ভদ্র গোছের লোকের কথার গুঞ্জনে নিজাম চৌধুরী বিছানা থেকে উঠে বসলেন। ততক্ষণে ডান পাশের ঘর থেকে কানে মোবাইলে কথা বলতে বলতে ওয়ারেছও দরজা খুলে বের হয়েছে।
-ওয়ারেছ, গেটে কতকগুলো লোক মনে হচ্ছে আমাদের বাড়ীতেই এসেছে।
-হ্যাঁ বাবা, উনারা সারারাত জাহাজ চালিয়ে আইছে। বলতে বলতে ওয়ারেছ চৌকির সামনে এসে দাঁড়ায়।
-সারারাত জাহাজ চালিয়ে আইছে ? কোন্থেকে,কেন!
-বাবা, ভুলে গেছ? তুমি না জাহাজ কিনবা কইছিলা।
-হে তো কইছিলাম অনেক আগে। তারপর তো আর কিছু কইলি না।
-উনারা না জানালে আমি কি কমু?
-এখন কি অইব?
-অয়নের জন্যইতো আইছে।
-বলিস কি? যা, ভেতরে এনে বইতে দে। আদর আপ্যায়ন কর।

আগত অতিথিদের নাস্তা পর্ব শেষে সকাল দশটা অবধি ছিল ঘূম ও বিশ্রাম।ঘূম থেকে উঠলে আবার চা পাতি শেষে নিজাম চৌধুরীকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া হ’ল জাহাজ দর্শনে। প্রায় দু,শ ফুট লম্বা বিশাল জাহাজ।সামনের দিকটা পানির উপরে বিশাল ডেক।পিছনের দিকটা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও ওয়াচ টাওয়ারসমেত পানির উপরেই তিন-তলা।রঙের আচ্ছাদনে জাহাজটি নতুনের মত ঝকঝকে তকতকে।এতবড় জাহাজ এই প্রথম রামচন্দ্রপুর ঘাটে নোঙ্গর করল।গ্রামের লোকজন উৎসাহ নিয়ে দেখছে। একে অন্যকে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছে।নিজাম চৌধুরী ঘাটে পৌছলে জমে থাকা লোকগুলির উচ্চ বাক্য অনুচ্চ জটে নিরব হয়ে মহুর্তেই বাতাসে মিলিয়ে গেল।কেবল বিকট শব্দে হর্ণ বেজে জাহাজটি যখন যাত্রা করে পাড়ের ছেলেগুলি কয়েকবার হর্ষ ধ্বনি দিয়ে ওঠে।রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার ফেঁড়ে একরাশ আলো বিছিয়ে জাহাজটি আবার যখন ঘাটে নোঙ্গর করে তখন ঘড়ির কাটায় রাত বারটা।

সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত পদ্মা-যমুনার চেনা জায়গাগুলিতে চলে জাহাজ ভ্রমণ। ওয়ারেছের কাঁচা হাতটাকে পাকা করাও উদ্দেশ্য। সঙ্গে পোলাও মাংশেরও আয়োজন।বনভোজন শব্দটা নিজাম চৌধুরী গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের বইয়ের পাতায় পেয়েছিল।সন্ধা পেরুলেই এই নদীর সাথে সখ্যতা।চলে শেষ রাত অবধি।নিত্যকার দৃশ্য।আজ সেই নদীর বুকে জানালা খোলা রুমে মুক্ত বাতাসে তৃপ্তিসহ ভোজন নিজাম চৌধুরীকে যৌবনের দিনগুলি স্বরণ করে দেয়।“সম্পদেই সুখ”-পিতার সেই পুরনো কথায় শরীরের অস্থিমজ্জাগুলি আবার মড়মড় করে জেগে ওঠে।

সন্ধার কালো অন্ধকারটা আরেকটু গাঢ় হতেই কোন্থেকে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা এসে জাহাজের সাথে মিলিয়ে দাঁড়ায়।ঝুল মই বেয়ে তরতর করে জাহাজের ডেকে উঠে আসে কয়েকজন পুলিশসহ থানার সেকেন্ড অফিসার। একটু পর আরেকটি নৌকায় আসে উকিলসহ বিধান বাবু।জাহাজ কারবারে অভিজ্ঞ হওয়ায় আরিচার ওপাড় থেকে বিধান বাবুকে আনা হয়েছে। সবই হয়েছে ওয়ারেছের বিজ্ঞ ব্যবস্থাপনায়। শেষে আগত অতিথিদের সন্মানে আরেকবার চলে ভোজন পর্ব। মালিকানা চুক্তি শেষে আগত লোকগুলিকে দেনাপাওনা চুকিয়ে আরিচার নিকটবর্তী স্থানে নোঙ্গর করা আরেকটি জাহাজে নামিয়ে দিতে হয়েছে।রাত বারটা হবার এটাই কারণ। ভদ্রকলিতে পর্বটা বাড়ী অথবা কোন অফিসে হ’ত। কিন্তু কালো টাকার কারবার কালো গলিতেই বৈধ হয়ে স্বছন্দে চলাচলে অভ্যস্ত কিনা, তাই!

শান্ত পাড়ার শান্ত বাড়ীটিতে সবাই যে যার মত ঘুমে অচেতন। চারিদিকে কেবল ঝিঝি পোকার অবিরত কূজন।রাতের প্রহরে এ বাড়ীর বিশেষ কোন কক্ষে তখনও মিটমিট করে আলো জ্বলছে নিভছে। পরিচিত দৃশ্য। কক্ষের দক্ষিণ কোণের চেয়ারটিতে বসে নিজাম চৌধুরী।পাশেরটিতে ওয়ারেছ।ভোরবেলার ফোজরের নামাজ পড়ে নিজাম চৌধুরীর আর কোন ওয়াক্তের নামাজ পড়া হয়নি। চেষ্টাও করেননি। সম্পদের সুমিষ্ট ঘ্রাণে সে মোহ অনেক আগেই কেটে গেছে।
-কিরে,জাহাজ কিনে নগদ টাকা পয়সাতো সবই শেষ করে আইলি। এখন সামনে এগুবি কি নিয়ে ?
-সিন্দুকের টাকাগুলো আমার কাছে ছিল,বাবা।
-তাও তো দিয়ে দিলি। নিত্যদিন ঐ হাতির খোরাকই বা কেমনে মেটাবি ?……হ্যাঁ রে বাবা, আমার কাছে এগিয়ে এসে বোস দেখি।ওয়ারেছ চেয়ার টেনে পিতার একেবারে কাছে গিয়ে বসে।
-বাবা, ওনিয়ে আমি একদম চিন্তা করছি না। তোমার শরীর স্বাস্থ্য ভাল থাকলে আমার কিসের চিন্তা,বলো ?
-ওরি,(ওয়ারেছকে চৌধুরী স্নেহ করে ওরি ডাকে)আমি মস্তবড় ভূল করে বসলাম।
-কি ভুল বাবা ?
-আগ পিছ না ভেবেই আমি মসজিদে ওতগুলো টাকা দিয়ে দিলাম।তার উপর অতবড় জমিটাও………।
-বাবা, দান খয়রাত ডান হাতে দিয়ে বাম হাতে বুঝতে দিতে নেই।
-কিন্তু কি মোহে পড়ে আমি এতগুলো ভুল করে বসলাম,বাবা ?
-ও ভুল তোমাকে অন্যদিক দিয়ে পুষিয়ে দিব বাবা।
-সে কিভাবে ?
-সময়মত সবই তোমাকে বুঝিয়ে দিব বাবা।কেবল মনে কর তুমি একটা বড় ব্যবসায় টাকা ও জমি বিনিয়োগ করলে। নগদ লভ্যাংশ তুমি পরে পাবা।
-কিন্তু সেটা কিভাবে ? কিছুটাতো বলবি!
-বাবা, জ্যাঠা(একরাম চৌধুরী) এলাকায় কতটা জনপ্রিয় তাতো তুমি বুঝেছো। এই জনপ্রিয়তা আর তোমার দানকে কাজে লাগিয়ে তোমাকে সামনের নির্বাচনে পরিষদের চেয়ারম্যান হতে হবে।তুমি চেয়ারম্যান হতে পারলে দেখ আমি কি করি। খানিকক্ষণ নিরবতা।চৌধুরী তার আপন সন্তানকে আশ্চর্য চোখে কেবল ঘুরে ঘুরে দেখে।কপালে একটা স্নেহের চুমো দিয়ে বুকে টেনে নেয় ছেলেকে।সিদ্ধান্ত নেন নামাজী হয়ে নয় কাল থেকে ব্যবসায়ী হয়ে মসজিদে প্রবেশ করবেন।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:৪২
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×