ঘুড়ি ছেঁড়ার দিন (১)
কিছু কিছু স্বরচিত অভাববোধ কিংবা যাযাবর চিন্তা ভীড়ে, জটিল সময়গুলোও কখনো কখনো সচল হয়ে ওঠে। যদিও মনের কোনে কিছুটা অস্বস্তি থেকে যায়, তাকে পাত্তা না দিলেই হল! "ব্যস্ততা" নামের সর্বরোগের মহৌষধটা হাতে পেয়ে গেছি, তাই ধুরছাই বলে ঝেড়ে ফেলেছি হার মানা অপমানকে। আপন খেয়ালে থাকি, ইচ্ছেমতন নিজের পরিধিকে ভাঙ্গি। নিজের অনুভূতি পেতে নেই বৈচিত্র্যের সব অ-আ-ক-খ গুলোকে। বন আর পাহাড়ের সাথে সখ্যতা আমার পুরনো। সেই বন্ধুতা যেন হঠাৎ ডালপালা মেলে বাড়তে লাগল। অন্ধকার বনে একা পথে হাটতে আমার আলো কিংবা সাহস কোনটাই লাগেনা। পুরো বন-পাহাড়ী যেন আমার পঞ্চইন্দ্রিয়ের মতই আরেক ইন্দ্রিয় হয়ে গেছে। সপ্তম ইন্দ্রিয়। সব মিলিয়ে 'ভালো আছি' এবং 'ভালো নেই' এর ভরকেন্দ্রে বাস করছি যেন।
এমন সময়ই 'লাল' ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয়।
সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। শেষ বিকেলে কাঁথামুড়ি দিয়ে জম্পেশ একটা ঘুমের আয়োজন করছি। মাথার উপর টিনের চালে বৃষ্টির 'সোনাটা' বাজছে অনেকটা 'দাদরা' আর 'একতালা'র মিশ্র তালে। ঘুমের জন্য যথোপযুক্ত সময়। এমন সময় বৃষ্টিতে যাকে বলে একেবারে কাকভেজা হয়ে ঘরে ঢুকলেন 'লাল' ভাই। ছোটখাটো মানুষ। চঞ্চল। জীবনে এই প্রথম দেখলাম উনাকে। তাই চিনতে পারিনি। আম্মা পরিচয় করিয়ে দিলেন উনার কাজিনের এই ছেলেটির সাথে। আমাদের লাল ভাই।
লালভাই বোহেমিয়ান মানুষ। উনি ঘুরে বেড়ান সারা দেশ। কখন কোথায় থাকেন, তার কোন ঠিক নেই। এবার এলেন প্রায় ১০ বছর বাদে। এই ১০ বছর তার কোন খোঁজ কেউ জানতোনা। লালভাইকে দেখে আম্মা অনেক অবাক হয়েছিলেন বলে একটু কৌতুহল হয়েছিল। এতক্ষণে তার কারণ জানা গেল। আম্মা জিগ্যেস করলেনঃ 'এতোদিন পরে কোত্থেকে এলি?' সে তার ডায়েরি দেখিয়ে বললো 'এটাতে লেখা আছে পুরো ভ্রমণ বৃত্তান্ত। বলতে ইচ্ছে করছেনা।' তার আচরণে মনেই হচ্ছেনা, এতদিন পরে ভূতের মত উদয় হওয়াতা আসলে একটা অদ্ভুত ঘটনা। নির্বিকার ভাবে আমাদের খোঁজ খবর নিয়ে যাচ্ছেন। আম্মা বললেন, 'বিয়ে করেছিস?'
: হুমম। এই ধরিত্রীকেই বিয়ে করেছি ক'বছর হল।
আম্মা হাল ছেড়ে দিলেন। বুঝলেন একে কোন প্রশ্ন করে লাভ নেই। অনেকক্ষণ গল্প হল। তিনি আমাদেরকে অনেক গল্প শোনালেন। সুন্দরবনের গল্প, বর্মীদের গল্প, দার্জিলিং, সুমাত্রা আরো কত গল্প! রাতে খাবার সময় তার চোখ পড়লো হারমোনিয়ামের উপর।
: কে বাজায় এটা?
আমি বললামঃ আপা
: তুই শিখিসনি?
: এই একটু আধটু।
: সরগম জানিস?
: তালিম নিচ্ছি আপার কাছেই।
ওকে। এখন গানের আসর হবে; ঘোষণা দিলেন তিনি।
হলও তাই সবাই গান করলাম একের পর এক। তিনি কেবল শুনলেন।
সবশেষে হারমোনিয়ামে হাত বুলাতে বুলাতে হঠাৎ বাজাতে শুরু করলেন। তিনি যে গান জানেন, একবারও বলেন নি। অবাক হবার পালা শেষ করতে পারিনি, কারণ, তাঁর নিঁখুত কন্ঠে তখন বাজছে শ্যামল মিত্রের বিখ্যাত গান, "কি নামে ডেকে বলব তোমাকে, মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে।" একে একে শোনালেন শ্যামল মিত্রের আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, মান্না দে'র তীর ভাঙ্গা ঢেউ আর নীড় ভাঙ্গা ঝড়, সহেলি গো কি নামে তোমায় বল ডাকি, হেমন্তের পথের ক্লান্তি ভুলে, আর ভূপেন হাজারিকার- প্রতিধ্বনি শুনি, গঙ্গা বইছো কেন আর আমি এক যাযাবর।
এতো সুন্দর গানের গলা! শুনলাম তিনি কোলকাতায় ছিলেন চার বছর। ওখানে ওস্তাদ পিন্টু ভট্টাচার্যের কাছে তালিম নিয়েছেন। তাঁর ভবঘুরে জীবনে, অনেকের কাছেই গান শিখেছেন। গানটা তার নেশা।
সে রাতে অনেক দেরি করে ঘুমাতে গেলাম।
সকালে উঠে দেখি, উনার বিছানা ফাঁকা। আলনায় ঝুলানো ক্যাম্বিসের ব্যাগটা নেই। টেবিলের উপর ডায়েরির কিছু ছেঁড়া পাতা; তাতে আগের রাতে উনার গাওয়া সব ক'টি গানের স্বরলিপি লেখা।
সবশেষে লিখা একটি শব্দঃ চলি।
তারপর লালভাইয়ের সাথে আর কোনদিন দেখা হয়নি। উনাকে প্রথম এবং শেষ দেখি ১৪ বছর আগে। অথচ সেই দেখার স্মৃতিটা এতো স্পষ্ট, যেন আগের রাতে দেখা কোন ছায়াছবির মত। অদ্ভুত সেই লোকটা।
ভবঘুরে এই মানুষটা, যেন চোখের সামনে জীবনের দূর্দান্ত একটা উদাহরণ রেখে গেল। সে অপেক্ষা করতে জানেনা। করাতে জানে।
ছবিসুত্রঃ আন্তর্জাল
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ১১:১৬