ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (১)
ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (২)
ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (৩)
ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (৪)
ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (৫)
(পূর্ববর্তী অংশের পর...)
কৈশোরের শুরুটা কেটেছে একটা দোটানার মধ্যে। সামাজিক ও শিক্ষাগত ভাবে বড় হচ্ছি, কিন্তু মানসিক ভাবে সেটা মেনে নিতে পারিনি। বারবার চোখ চলে যায় বাতিল করে দেয়া হাফপ্যান্টের দিকে। বেশি কষ্ট হতো গাছে ওঠার সময়। মাধ্যাকর্ষণের সূত্র শিখিনি তখনো, কিন্তু নিজের অজান্তেই তা যেন ভর করেছে বাড়ন্ত শরীরে। চির পরিচিত গাছ গুলোকে যেন মনে হত বিশ্বাসঘাতক! আমাকে ডালে রাখতে চাইত'না। প্রতিদিনই নিজের নতুন নতুন পরিবর্তন চোখে পড়ছে। ডাঙ্গুলি আর লাটাই কেন যেন টানে না। টানলেও বেশিক্ষণ মন বসাতে পারিনা। দুপুরটা কাটে খুব অলস আর ক্লান্তিকর ভাবে। ঠিক এমন সময়'ই আমার পরিচয় হল রাজু'র সাথে। রাজু মানে বাস্তবের কেউ নয়, 'গোয়েন্দা রাজু'। সেবা'র এই বইটির সাথে পরিচয় হবার আগে আমি গল্প বলতে জানতাম টেলস এন্ড স্টোরিজ কিংবা চারুপাঠ। কখনো কখনো বা ঈশপের গল্প মিলতো, ভক্ত ছিলাম কৃষণ চন্দর আর আলী ইমামের কিশোর এডভেঞ্চারের। জাফর ইকবাল মিলত খুব কম, কারণ মফস্বলে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তখনো খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। সে যাই হোক, গোয়েন্দা রাজু আমার দুপুরের সঙ্গ নিল। বলতে গেলে বই পড়াটা আগে ছিল উপভোগ করার মত। সেবা'র সাথে পরিচয় হবার পর তা যেন নেশায় পরিণত হয়ে গেল। সমাজ বইয়ের মলাট চলে গেল 'চিলড্রেন অব দ্যা নিউ ফরেস্ট' বই'এ কারণ, স্কুল শেষ হবার আগেই তা ফেরৎ দিয়ে 'দি একসরসিস্ট' টা হাতাতে হবে। ওদিকে 'দি একসরসিস্ট' এর লোভ দেখিয়ে রেখেছি আরেকজনকে, কারণ ওর কাছে দেখেছি 'অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট'। আমার 'কিডন্যাপ' আর 'টমসয়্যার' কাউকে দেখাইনি। তিন গোয়েন্দার নতুন বইটা হাতের পাঁচ-টোপ হিসেবে রেখে দিয়েছি। কত বলব আর, বলে তো আর শেষ করা যাবেনা। এই বইগুলোর হাত ধরেই অলস দুপুর গুলো যেন অনেকগুলো জানালা নিয়ে হাজির হল আমার ঘরে। থ্রিল আর ক্লাসিকস-খেলার মাঠ আমাকে আর টানেনা। বিকেল বেলাতেও বই নিয়ে বাসার ছাদে চলে যেতাম। ভি.পি.পি যোগে বই আসতো, সেই অপেক্ষায় কত অপেক্ষার সময় যে কেটেছে পোস্ট অফিসের সিঁড়িতে বসে!
বইয়ের নেশাটা ধরার পর আমার পারিপার্শ্বিকতাও পালটে গেলো। সব কাজেই থ্রিল খুঁজতাম। কয়েক বন্ধু মিলে বেড়িয়ে পড়তাম রহস্যের খোঁজে। একবার কোন এক গ্রামের রাস্তায় কিছু লোককে গাছের নিচে গামছা বিছিয়ে তাস খেলতে দেখে, দৌড়ে বাসায় এসে ফোন করলাম থানায়। পরিচয় দিলামঃ 'আমি গোয়েন্দা প্রধান পলাশ বলছি। আমরা গোপনে বিভিন্ন অপরাধের খবর রাখি, এবং তদন্ত করি। এই মূহুর্তে অমুক জায়গায় জুয়া'র আসর বসেছে। টাকার ছড়াছড়ি। আপনারা এক্ষুনি যান। এরেস্ট করে নিয়ে আসুন। আমি কোথায় থাকি এটা জিগ্যেস করার পর খুব গম্ভীর ভাবে বলেছিলামঃ 'অপরাধীদের দুর্ভাগ্যের সাথে থাকি'। এই বলে খটাশ করে ফোন রেখে দিলাম (কারণ বইয়ে পড়েছি-কিশোর পাশা এভাবেই ফোন রাখে)। আমার তদন্তের ফলাফল জানতে পারলাম সেদিন সন্ধ্যাতেই। ও.সি আঙ্কেল সপরিবারে বিকেল বেলা বাসায় বেড়াতে এলেন। আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ! তবু'ও হেসে হেসে (কাষ্ঠ হাসি বোধ হয় ইহাকেই লোকে বলিয়া থাকে) কথা বলছি। ও.সি আঙ্কেল প্রসঙ্গটা তুলছেন না বলে পুলিশের এই উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার ভদ্রতায় আমি মুগ্ধ! আবার মনে মনে ভাবছি, এটাতো কনফিডেনশিয়াল ব্যাপার। মনে হয়, উনি আমার সাথে গোপনে কথা বলতে এসেছেন। সে যাই হোক, আমার সমস্ত চিন্তা-ভাবনাকে রেহাই দিয়ে তিনি অবশেষে মুখ খুললেন। ভরা আড্ডায় একগাল হেসে, আমাকে বললেনঃ গোয়েন্দা প্রধান পলাশ, তোমার জুয়ারীদের ধরা যায়নি। তবে কিছু লোক খোলা জায়গায় বসে তাস খেলছিল, ওদেরকে কন্সটেবল'রা মানা করে দিয়েছে। কি, এবার খুশি তো? আর আমার অবস্থা তখন? ধরণী দ্বিধা হও...
বিঃদ্রঃ আমাকে আইডেন্টিফাই করার রহস্যটা কিন্তু আমি'ই সমাধান করেছিলাম! তেমন কিছু না, তখন কাউকে ফোন করতে হলে অপারেটরের মাধ্যমে চাইতে হত। তারপর খুঁজে পেতে কতক্ষণ!
আজ আর লিখবনা। এই মূহুর্তে আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে, 'লিখতে লিখতে কি তোমার চোখে পানি চলে এসেছে? আমি তাকে অবশ্যম্ভাবী ভাবে মিথ্যে বলব। আমি বলবঃ না।
অথচ, আমার সামনের সব কিছুই কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে।
ও কিছুনা।
চোখে কিছু একটা পড়েছে মনে হয়।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ২:৫২