ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (২)
ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (৩)
ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (৪)
ছেলেবেলা, কৈশোর ও একটি ঝাপসা আয়না! (৫)
(পূর্ববর্তী অংশের পর...)
প্রাক-অধুনা এবং অধুনা'র এক বিব্রত সময়ে কেটেছে ছেলেবেলাটা। তাই, ইলেকট্রিক বাতির পাশাপাশি হারিকেন কিংবা হ্যাজাকের পরিচয় ছিলো আমার। আর একটা আবশ্যিক জিনিস ছিলো- 'গ্লোব' মশার কয়েল। কখনো কখনো ধূপ জ্বলত ঘরে-আহ! কি মিষ্টি ঘ্রাণ! ওর'ই মাঝে ডুবে ডুবে চলতো আমাদের পড়ালেখা। আব্বা টিভির ভ্যলিউম কমিয়ে দিয়ে ৮টার খবর শুনতেন, আর আমরা তখন ব্যস্ত ওয়ার্ডবুকে। আসলে সময় পার করে দেবার ফন্দি! কারণ, আমাদের মফস্বলে রাত নামত সন্ধ্যাতেই। সুতরাং, রাতে খাবার পরেই ঘুমের ভিসা পেয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে যখন ইলেকট্রিসিটি থাকতনা, বাসার সামনের বিশাল মাঠে (তখন বিশাল'ই লাগত; এখন হেঁটে পার হতে লাগে মোটে ২৫ সেকেন্ড) চলতো আড্ডা। আমরা শিশুর দল যেন স্বাধীনতা পেয়ে যেতাম, কারণ, তখন শাসনের মাত্রাটা অনেকটা শিথিল থাকত। পুরো পাড়া ভেঙ্গে পড়তো তখন ওই মাঠ'টিতে। আর আমরা তখন শব্দের উৎস ধরে খুঁজে বের করতাম ঝিঁঝিঁ পোকার বাসা; পেলেই পানি ঢেলে দিতাম! জোছনারাতে কখনোবা টুক-পলান্তি (লুকোচুরি) খেলতাম, মাঝে মাঝে বরফ-পানি। ও হ্যাঁ আরেকটা খেলা ছিল-'কুমির তোর জলে নেমেছি'। এটা খুব উত্তেজনাকর খেলা ছিলো। সে যাই হোক, এরকম হৈ-হল্লার মধ্যেই কখন যে বেরসিকের মতো ইলেকট্রিসিটি চলে আসত! আমরা মুখ ব্যাদান করে ঢুকে পড়তাম মশারির ভেতরে ওত পেতে থাকা ঢালাও বিছানায়।
ওই সময় আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক ঘটনা ছিল গ্রামের বাড়ি যাওয়া। যদিও খুব কাছেই, কিন্তু ওই বয়সে আমার সাহসে'র বাইরে ছিল গ্রামের বাড়ি। যাবার সময় আব্বা টিভিটা সাথে করে নিয়ে যেতেন, কারণ রাত ৮টার সংবাদ ছিল তার ৬ নম্বর মৌলিক চাহিদা। যেজন্য একটা ব্যাটারি'ও কেনা হয়েছিল টিভি চালানোর জন্য। যাই হোক, গ্রামের বাড়ি আমার জন্য ছিল চারণভূমি, কারণ, ওখানে কেউ বাধা দেবার ছিলনা। কখনও পুকুরে নেমে চোখ লাল করার আগে উঠিনি। একটু দূরেই নদী। শীতের সময় যখন সত্যি সত্যি'ই জল হাঁটুর নিচে নেমে যেতো, তখন চলত কাদার মধ্যে আমাদের মাছ ধরা, নিজের উপার্জিত মাছ খেতে গিয়ে গর্বে বুক ফুলিয়ে থাকতাম।
আসলে আমার ছেলেবেলাটা গাঁয়ের আর দশটা সাধারণ ছেলের মতই কেটেছে। তখন কোন দর্শন ছিলোনা, ছিল বৈচিত্র। শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠতাম শুধু সর্ষেক্ষেতের এপার-ওপার দৌড়ে যাবার জন্য, কারণ, শিশিরে ভেজা সর্ষেফুলের হলুদ রং-এ পুরো পা হলুদ হয়ে যেতো। আমার খুব স্পষ্ট মনে পড়েনা, কিন্তু এটুকু মনে পড়ে, এই সুন্দরের দিকে আমার গেঁয়ো চোখটা যেন আশ্রয় খুজে পেত! আমি তখন'ও 'অমল' কে চিনিনা, কিন্তু এখন বুঝতে পারি, সব শিশুর মধ্যেই একজন করে 'অমল' বাস করে। নইলে কেন, এই বাংলাদেশের অখ্যাত একটা গ্রামের ক্ষুদ্র একটা শিশুর ভাবনার সাথে মিলে যাবে অমলের দইওয়ালা হবার স্বপ্নটা! আমি হতে চেয়েছিলাম ফেরিওয়ালা...।
তারপর একসময় আমরা ফিরতাম গ্রামের বাড়ি থেকে। সবাই ভাবে ছুটি কাটিয়ে ফিরলাম। আর আমি ভাবতাম বুঝি ছুটি মেখে ফিরলাম! আমার ছোট্ট মনের কোল জুড়ে কেবল উঁকি দিত সহজিয়া দিনগুলোর টুকরো টুকরো ছবি। আমার আয়নাটা তখনও ঝাপসা হয়ে যায়নি। আমার গোপন বিলাসে তখন ভাবনাগুলো কে নিরলস সংগ দিত আমার আয়না।
আর আমি তখন শৈশবের পুকুরে ডুবসাঁতারে পাড়ি জমাচ্ছি কৈশোরের পথে...। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ২:৫১