রসময় দাদু আমার রোগী । প্রায় পনের বছর আগে কোমর ব্যাথা নিয়ে দাদু প্রথম আমার কাছে আসেন এবং তারপরেও এসেছেন বেশ কয়েকবার। দাদূর কোমর ব্যাথা আমি ভাল করে দিতে পারিনি তবুও তিনি ছিলেন আমার ভক্ত রোগী ।
দাদুর ভাল নাম রসময় দত্ত, বাড়ী চাঁদপুরে। প্রথম যখন দাদুকে দেখি তখনই তার বয়স ছিল সত্তরের কাছাকাছি। আগে ব্যবসা করতেন, কিন্তু বয়স ষাটের কোঠা পেরোনোর পর ছোট ছেলের হাতে ব্যাবসা ছেড়ে দিয়ে দাদু এখন ধর্মকর্ম নিয়ে থাকেন। দাদুর বড় ছেলে ঢাকায় ভাল বেতনের চাকরী করেন , থাকেন ধানমন্ডীতে। বেশ কয়েকবার দেখার সুবাদে দাদু আমার কাছের মানুষ। ডাক্তার রোগীর পেশাগত সম্পর্ক কিছুটা হয়ত ক্ষুন্ন হয়েছিল কিন্তু তাতে কোন সমস্যা হয় নি। দাদুর কিছু কিছু বৈশিস্ট ছিল চোখে পড়ার মত।
রসময় দাদু সবসময় ধুতি পাঞ্জাবী পরে আসতেন এবং মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকতো। প্রতিবারেই দাদু জোর করে নতুন রোগীর ভিজিট দিতেন। দাদুর বক্তব্য ছিল ডাক্তারকে ভিজিট না দিলে রোগ ভাল হয় না। দিদিমা প্রতিবারই দাদুর সাথে আসতেন। তিনি নিজেই ছিলেন হার্টের রোগী এবং মাঝে মধ্যে শ্বাসকস্টে ভুগতেন। তবুও তিনি দাদুর সাথে আসবেনই। একদিন দিদিমাকে জিজ্ঞেস করলাম “ দিদিমা আপনি নিজেই তো আরো বেশী অসুস্থ্য তবুও প্রতিবার দাদুর সাথে কেন আসেন, আপনার ছেলে অথবা ছেলের বৌ তো দাদুর সাথে আসলেই পারেন? দিদিমা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন, “বুড়ো মানুষ, চোখে কম দেখেন, কানেও কম শোনেন ওকে একা ছাড়তে ভরসা পাইনে”।
দাদুদের বিশেষ করে মনে রাখার কারন হল দাদু এবং দিদিমা প্রায়ই চেম্বারে আমার সামনে বসেই ঝগড়া শুরু করে দিতেন। দাদুদের ঝগড়ার উদাহরন দিচ্ছি -
দাদু রোগীর চেয়ারে এসে বসলে আমি জিজ্ঞেস করলাম “ কেমন আছেন দাদু? দাদু উত্তর দিলেন “ভালো আছি” আর ওমনি দিদিমা তেড়ে উঠলেন “ ভাল না ছাই,ডাক্তার বাবু, ওর কথায় বিশ্বাস করবেন না। কাল সারা রাত ওর কোমরে তেল মালিশ করেছি, গরম সেক দিয়েছি তবেই না রাতে একটু ঘুমিয়েছে আর এখন আপনার কাছে আসতে পেরেছে। দাদু বলে উঠলেন “ তুমি আমার শরীর সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশী জানো নাকি? যা জানো না তা নিয়ে কথা বলো না”। দুজনকে থামাতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
দাদু ছিলেন রসিক মানুষ। একদিন কৌতুক করে দাদুকে বললাম “দাদু , আপনি এই ঝগড়াটে বুড়ি বৌ নিয়ে কিভাবে সংসার করেন বুঝি না, বুড়িকে তালাক দিয়ে দেন , আমি নতুন করে আপনাকে যুবতী মেয়ে দেখে বিয়ে দেবো। রাগে ফেটে পড়লেন দাদু “ মস্করা করেন আমার সাথে? চিকিৎসার জন্য এসেছি পারলে চিকিৎসা করেন আর তা যদি না পারেন তো আমি চললাম ,এই রইল আপনার ভিজিট। পকেট থেকে পাঁচশ' টাকার একটা নোট টেবিলে রেখে দাদু গজ গজ করতে করতে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেন। দিদিমাকে দিয়ে কোনোমতে দাদুকে ধরে এনে শান্ত করি।
এর পর অনেকদিন আর আসেন নি দাদু। প্রেস্কৃপশান নিয়ে দাদুর বড় ছেলে চেম্বারে এলে জিজ্ঞেস করলাম দাদু এলেন না কেন? ছেলে জানালো মাস দুয়েক আগে মার স্ট্রোক হয়, মা এখন শয্যাশায়ী। মাকে খাওয়ানো, স্নান করানো, প্রস্রাব পায়খানা ইত্যাদি সব কিছুই বাবা করেন। মাকে টানাটানি করতে করতে বাবার কোমরের ব্যাথাটা বেড়েছে। তিনি মাকে ছেড়ে আসবেন না। ছেলেকে দাদুদের ঝগড়ার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ছেলে জানালো বাবা মাকে খুব ভালোবাসেন। বি,এ ক্লাশের ছাত্র থাকতে ঠাকুরদার অমতে পালিয়ে গিয়ে বাবা মাকে বিয়ে করেন। জাতিগত পার্থক্যের কারনে ঠাকুরদা এবং সমাজ এ বিয়ে মেনে নিতে চায়নি। বিয়ের পর বাবা চটকলে শ্রমিকের চাকরী নেন। আমার ঠাকুরদা ছিলেন চাঁদপুরের সবচে' ধনী ব্যাবসায়ী অথচ বিয়ের পর কি অভাবেই না দিন কাটিয়েছেন বাবা মা। বাবার বিয়ের তিন বছর পর আমার জন্ম হয়। তারও কিছুদিন পর ঠাকুরদা আমাদেরকে চাঁদপুরে ফিরিয়ে নিয়ে বাবাকে ব্যাবসায় বসিয়ে দেন।
এর পর অনেকদিন দাদু আর আসেন নি। ভুলেই গেছিলাম দাদুর কথা। একদিন বড় ছেলে দাদুকে নিয়ে চেম্বারে হাজির হল। কি চেহারা হয়েছে দাদুর! শরীর ভেঙ্গে পড়েছে, মুখের সেই চিরাচরিত হাসি নেই। দাদুকে দেখলে প্রায় চেনাই যায় না। দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম “দিদিমা কেমন আছেন'? দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদু উত্তর দিলেন “ ও তো নেই, আমাকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। ভেবেছিলাম আমি আগে যাবো কিন্তু বরাবরের মত আমাকে ফাকি দিয়ে নিজে জিতে গেল।" পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন দাদু।
ছেলে জানালো- মা মারা যাওয়ার পর বাবা যেন কেমন হয়ে গেছেন। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না, স্নান করেন না, কথা বলেন না। অধিকাংশ সময় বারান্দার চেয়ারে এক একা বসে থাকেন। ব্যাথায় কস্ট পান , রাতে কাতরান কিন্তু উনি ডাক্তার দেখাবেন না। ছেলেরা ডাক্তার দেখানোর কথা বললে দাদু উত্তর দেন “ কি হবে ডাক্তার দেখিয়ে, ডাক্তার কি আমাকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে পারবে? তোদের মা চলে গেছেন, এবার আমার যাওয়ার পালা। যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি ততই মঙ্গল।” সেবার অনেক পীড়াপীড়ি করে দাদুকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলো বড় ছেলে।
এরপর দাদু আর খুব বেশীদিন বাঁচেন নি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৮