প্রথম পর্ব এখানে
তুতেনখামেনের সমাধি- প্রায় ৩ হাজার বছর অক্ষত ছিল তুতেনখামেনের সমাধি। চোর ডাকাত, প্রত্নতাত্বিক দের চোখ ফাকি দিয়ে কিভাবে তা সম্পূর্ন রক্ষিত ছিল তা এক আশ্চর্য্য বিষয়। কার্টারের বর্ননা অনুসারে অন্তত দুবার চোরেরা ঢুকেছিল তুতেনখামেনের সমাধিতে এবং তা ছিল সমাধিস্থ করার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। তুতেনখামেনের সমাধি তৈরী করা হয়েছিল তড়িঘড়ি করে। ফারাওয়ের হঠাৎ মৃত্যুই ছিল এই তড়িঘড়ির কারন। তার সমাধি অনান্য ফারাওদের তুলনায় আয়তনে ছিল ক্ষুদ্রাকার, সমাধি গায়ের ছবি গুলো ছিল অসম্পূর্ন এবং অপেক্ষাকৃত বড় আকারের। তখনকার দিনে পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে কেটে ফারাওয়ের সমাধি তৈরী করতে গড়ে ৬ বছর সময়কাল ব্যয় করা হত।এমনকি কোন কোন ফারাওয়ের জন্য ২০ বছর ধরে তৈরী করা হয়েছিল সমাধি। ধারনা করা হয় যে অন্য কারো জন্য তৈরী করা হয়েছিল সে সমাধি। তার মূল কফিন ঢাকা ছিল চারটি বিভিন্ন ধরনের কাঠের কফিন দিয়ে । সমস্ত কফিনগুলো একই রকম হওয়ার কথা থাকলেও তুতেনখামেনের কফিনগুলো ছিল ভিন্ন ধরনের। এতদিন লুক্কায়িত থাকার কারন হিসেবে বলা হয় যে সমাধিতে প্রবেশের সিড়ি ঢাকা পড়েছিল র্যামেসিস-৪ এর সমাধিক্ষেত্র বানানোর সময় সমাধিকর্মীদের ইটের কুড়েঘর এবং পাথরের গাদার নীচে। সমাধির প্রবেশপথ র্যামেসিস-৪ এর সমাধির ১৩ ফুট নীচে।
তার সমাধি ছিল নতুন রাজত্বকালের অনান্য ফারাওদের মতই। সিড়িদিয়ে নীচে নামলে প্রথম দরজা, তারপর পড়বে করিডোর। নীচ দিকে ঢালু প্রায় ৯ মিটার লম্বাকরিডোর পেরোলে প্রথম দরজার মত আরো এক বন্ধ দ্বিতীয় দরজা। দ্বিতীয় দরজার পর হলঘর বা এন্টীচেম্বার।কার্টারের লেখা থেকে উদ্ধৃতি “ সিড়ি পরিস্কার করে ১২ ধাপ নীচে গিয়ে পেলাম বন্ধ দরজা। দরজাতে আগে খোলা এবং তা পুনরায় প্লাস্টার দিয়ে বন্ধ করার চিহ্ন পেয়ে কিছুটা হতাশ হলাম। প্রথম দরজা সরিয়ে যে করিডোর পেলাম তা প্রায় ছাদ পর্যন্ত ছিল চূনাপাথরের বড় বড় চাংড়ায় পরিপূর্ন। সেগুলো সরিয়ে পেলাম দ্বিতীয় দরজা। প্রথম দরজার একই আদলে তৈরী দ্বিতীয় দরজায়। এখানেও পাওয়া গেল আগে ছিদ্র করে ঢোকার এবং তা বন্ধ করার চিহ্ন। দ্বিতীয় দরজার পর পেলাম এন্টিচেম্বার। তা ছিল ফারাওয়ের নিত্যদিনের ব্যবহার্য্য সামগ্রী। করিডোরের সোজা উল্টোদিকে আরোএকটি কামরা বা এনেক্স। হলঘরের ডানদিকের প্রান্ত গিয়ে পড়েছে মুল সমাধিকক্ষে।সমাধিকক্ষে প্রবেশ পথ দেওয়াল গেথে বন্ধ করা। দুপাশে ফারাওয়ের দুই পাথরের মূর্তি। তারা যেন দাঁড়িয়ে আছে সম্রাটের সমাধির অনন্তকালের প্রহরী হিসেবে। সমাধিকক্ষ সংলগ্ন আরো একটি ঘর - কোষাগার" ।
সমাধির নকশাঃ-
এন্টিচেম্বার বা হলঘর- ফারাওয়ের সমাধির প্রথম হলঘর ছিল পার্থিব জীবনে সম্রাট কর্তৃক ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা । বিছানা,পালঙ্ক,কাপড়চোপড়, মূর্তি, খাট, খাবারদাবার, পানীয়, সিন্দুক, বাক্স, ঝুড়ি ইত্যাদি। মোট ৭০০টি জিনিসের তালিকা করেছিলেন কার্টার এই ঘর থেকে। ৩টা রথ পাওয়া যায়। সবচে আকর্ষনীয় ছিল তিনটা খাট, একটা জলহস্তী, আরেকটা সিংহ এবং, অপরটি গরুর মাথাযুক্ত।খাটগুলো কাঠের তৈরীহলেও কাজ করা সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো । সম্ভবত এ গুলো ব্যবহৃত হত অনুষ্ঠানাদি বা মমী করার সময়।এন্টিচেম্বারের দেওয়ালে কোন ছবি বা পেন্টিং ছিল না। এই হল ঘরে সমস্ত কিছু উদ্ধার এবং তালিকা করতে কার্টার সময় ব্যয় করেন দুই বছর।
এনেক্স- হলঘরের বামদিকে ছোট দরজা দিয়ে সংলগ্ন ছিল সবচে ছোট কক্ষ -এনেক্স। এর মেঝে ছিল হলঘরের থেকে বেশ কিছুটা নীচুতে। এই কামরা জিনিসপত্র ছিল এলোমেলো বিশৃংখল্ভাবে। প্রায় এক বছর ধরে খনন কাজ চালান কার্টার এই কক্ষে এবং ২৮০টি সামগ্রী উদ্ধার করেন।
মূল সমাধিকক্ষঃ- সমাধি’র ৪ টা কক্ষের মধ্যে সবচে’ বেশী জৌলুসপূর্ন হল এই ঘর। এর চার দেওয়ালে উজ্জ্বল হলুদ রঙের উপর ফারাওয়ের জীবিতকালের এবং পরকালের যাত্রার ম্যুরাল আঁকা।অনান্য ফারাওদের সমাধিক্ষেত্রের তুলনায় এই ছবিগুলোর আয়তন বেশ বড়। এ থেকে ধারনা করা হয় যে তড়িঘড়ি করে শেষ করতেই এ গুলোর আকার বড় করে আঁকাহয়।
হল ঘর দিয়ে ঢুকলে সোজা চোখ পড়বে উত্তর দেওয়ালে। এখানে তিনটি দৃশ্যের ম্যূরাল। প্রথম দৃশ্য হল “ মুখ খোলা” অনুষ্ঠানের। মুখ খোলা বা “Opening of the Mouth” , অনুষ্ঠানটিতে মমী করার আগের মৃতব্যাক্তির মুখগহবর খুলে রাখা হয়। উদ্দেশ্য হল যাতে পরকালে মৃত ব্যাক্তি পানাহার করতে পারে এবং পূনর্জন্ম লাভ করতে পারে। এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন পূরহিত “আই” এবং ফারাও কে আঁকা হয় দেবতা ওসিরিস হিসাবে। আই তুতেনখামেনের পরবর্তি ফারাও হিসেবে মিশর শাসন করেন। দ্বিতীয় দৃশ্যে বালক তুতেনখামেনকে দেখা যায় দেবতা “নাট” এর সাথে। দেবতা নাট, ফারাওকে পরলোকের অনন্ত যাত্রায় আশ্বস্ত কছেন। উত্তর দেওয়ালে তৃতীয় দৃশ্যে দেবতা ওসিরিস ফারাওকে আলিঙ্গন করে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন পরলোকে আর এর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ফারাওয়ের “কা” বা আত্মা।
পূব দিকের দেওয়ালের ম্যুরাল হল ফারাওয়ের শবযাত্রার ছবি। শোকার্ত আত্মীয় স্বজন এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা নৌকার উপর শায়িত সম্রাটের মমীর সঙ্গী। সম্রাটের মমীর উপর চাঁদোয়া টানান।
পশ্চিমের দেওয়ালের ম্যুরালে আঁকা ১২ টা হনুমান যারা রাত্রের ১২ ঘন্টার প্রতীক। পরলোকে যাত্রা শুরু করার আগে এই ১২ ঘন্টা অতিবাহিত করতে হয় মৃতকে। পরলোকের এই নৌকা যাত্রা খুবই গুরত্বপূর্ন। ময়ূরালের বামদিকে উপরে দেখান হয় সূর্য্য দেবতা রা’য়ের প্রতীক গুবরে পোকা এবং নৌকা আরোহী ওসিরিস দেবতার দুই রূপকে। সাথে আছেন অনান্য দেবতা যেমন মা’ত এবং হোরাস।
দক্ষিনের দেওয়াল কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ কারন হল এই দেওয়াল দিয়েই কার্টার প্রথম ঢোকেন সমধিকক্ষে। এর আঁকা ছবিতে দেখা যায় দেবতা হাথর এবং শেয়ালমূখী দেবতা আনুবিস ফারাও তুতেনখামেনকে পরলোকে স্বাগত জানাচ্ছেন।
তুতেনখমেনের কফিনঃ- মূল সমাধি কামরায় ফারাও তুতেনখামেনের মমি রাখা আছে এক উচু বেদীর উপর। সবচে বাইরে ছিল পাথরের মমী আবরনী যাকে বলে “ সারকোফেগাস” তার ভিতর ছিল আরো দুটো কাঠের কফিন এবং সবচে ভিতরের কফিন নিরেট ১১০ কিলোগ্রাম সোনার তৈরী। মুখ ঢাকা ছিল ফারাওয়ের ছবি খোদাই করা ২৫ পাউন্ড ওজনের সোনার মুখোশ দিয়ে। তার সেই সোনার কফিন আজ ও রাখা আছে ভ্যালী অফ দি কিং এ তার মূল সমাধি কামরায়। বাকী কফিনগুলো কায়রোর যাদুঘরে। কফিন গুলো সোনার পাতে মোড়া এবং তার উপর দেব দেবীর এবং ফারাওয়ের নিজের ছবি আঁকা।
ফারাওয়ের কফিন
কোষাগারঃ- ফারাওয়ের কোষাগার মূল সমাধিকামরার পূবের দেওয়াল সংলগ্ন। কোষাগারের উল্লেখযোগ্য সামগ্রী হল বেদী, সিন্দুক, নৌকা, এবং তুতেনখামেনের মৃত জন্ম নেওয়া দুই কন্যার মমী। এই কামরায় পাওয়া যায় সোনার পাতে মোড়ানো কাঠের বেদী। ফারাওয়ের আভ্যন্তরীন প্রত্যংগ সংরক্ষিত পাত্র বা “Canopic Jar”. ছিল এই বেদিতে। মৃতদেহকে মমী করার আগে তাদের লিভার, ফুসফুস, অন্ত্র এবং পাকস্থলী সংরক্ষন করা হত ৪টি পৃথক জারে। এই কাঠের বেদীর চার দিকে ছিল ৪জন দেবতার মূর্তি-সেলকেত, নেপথিস, আইসিস, এবং নেইথ। তারা পাহারা দিচ্ছেন সম্রাটের প্রত্যংগ গুলোকে পরলোকের অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে।
এ কক্ষে পাওয়া যায় ১৪টি নৌকা এবং জোড়া জোড়া করে রাখা ফারাওয়ের ৩৪টি সোনার পাতে মোড়া কাঠের মূর্তি।
ক্যানোপিক জার।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:১৭