যাদুঘর আমাকে খুবই টানে। সময়ের স্বল্পতায় সব দেশের যাদুঘরে যেতে পারি নি। লন্ডনের বৃটিশ মিউজিয়াম, প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামের বিশালত্ব দেখে অন্য দেশে মিউজিয়ামে যাওয়ার উৎসাহ অনেক অংশে উবে গেছিল। অনেকদিন টোরোন্টোতে থেকে এখানকার মিউজিয়াম না দেখার একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। ২০০৯ সালের গ্রীস্মে এক শনিবারে লাইনে গিয়ে দাড়ালাম টোরন্টো পাবলিক লাইব্রেরীতে বিনা পয়সার মিউজিয়ামের টিকিটের জন্য। টোরন্টোর সবচে বড় মিউজিয়ামের নাম হল “ রয়্যাল ওন্টারিও মিউজিয়াম”
সেদিন“ রয়্যাল ওন্টারিও মিউজিয়াম” এ “ডেড সী স্ক্রল” দেখে এসে এর সম্পর্কে বিস্তারিত জানার একটা ইচ্ছে মনের মধ্যে কাজ করছিল। মিউজিয়াম গাইডের স্বল্প বর্ননা আমার জানার কৌতুহল পরিপূর্ন মেটাতে পারে নি। ভূলেও গেছিলাম। এই ব্লগেই ডয়েচেভেলে’র অংশে জানলাম হারিয়ে যাচ্ছে ডেড সী। তখন আবার মনে পড়ল জর্দান এবং ইজরায়েলের মাঝে অবস্থিত ডেড সী এবং ডেড সী’র তীরের কামরানে আবিস্কৃত দুই হাজার বছরের পূরোনো পার্চমেন্ট এবং প্যাপিরাসের উপর হিব্রু ভাষায় লেখা বাইবেল, যা ডেড সী স্ক্রল নামে পরিচিত। হিব্রু বাইবেলকে প্রকৃত খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থের চেয়ে ইহুদীদের গ্রন্থ বলাই বেশী সমীচিন যদিও বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের উল্লেখযোগ্য অংশের উৎস হল এই হিব্রু বাইবেল।
ডেড সী’র উত্তরপশ্চিম তীর থেকে আরো এক কিলোমিটার পশ্চিমে এখনকার ইজরায়েলের জুডিয়ান হিল বা পাহাড়ের উপত্যকার ধ্বংশপ্রাপ্ত ইহুদী বসতি “খিরবেত কামরান” রুক্ষ মরুভূমি গাছপালাহীন পাহাড়ী এলাকা। ১৯৪৭সালের জানুয়ারী মাস। ছাগল গুলো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অনেক উপরে উঠে যাচ্ছে দেখে চিন্তায় পড়ে গেল বেদুইন বালক জুমা। পাহাড়ের ঢালে অসংখ্য গুহা। উপরে উঠতে উঠতে খেলার ছলে গুহামুখে ছূড়ে মারল একখন্ড পাথর। পাথর গূহার মধ্যে পড়ে টং করে শব্দ হল। নিশ্চয়ই গুপ্তধন লুকিয়ে রাখা আছে এই গূহাতে? হয়ত ছাগল চরিয়ে খাওয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে। ডেকে আনল চাচাত ভাই মোহাম্মদ এবং খলিলকে। এর মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে আসায় তারা ঠিক করল পরদিন গুহাতে নেমে খোজ করবে গুপ্তধনের। পরদিন সবার আগে মোহাম্মদ গুপ্তধনের লোভে অন্য দুজনের আগে গিয়ে হাজির হল পাহাড়ের ঢালের সেই গূহাতে। অন্ধকার পাহাড়ের গুহা আবর্জনা পোড়া মাটির ভাঙ্গা টুকরো তে পরিপূর্ন। গূহার দেওয়ালে সযত্নে রাখা ঢাকনা দেওয়া কতগুলো পোড়ামাটির জার । নিশ্চয়ই সোনা দানা, গুপ্তধন। একে একে সবগুলো জার খুলে পরীক্ষা করে পাওয়া গেল কতগুলো কালের আবর্তনে সবুজ হয়ে যাওয়া কাপড়ে পেচানো পুথির বান্ডিল। হতাশ হয়ে তারা ফিরে এল গুহাতে পাওয়া সাতটি পার্চমেন্টের পুথির বান্ডিল নিয়ে। টানিয়ে রাখল বেদুইনের তাবুর খুটিতে। বেদুইনরা অংশবিশেষ বিক্রি করে দিল মাত্র ৭ পাউন্ডের বিনিময়ে পুরাকীর্তি ব্যাবসায়ীদের কাছে। জেরুজালেমের বিশপ মার স্যামুয়েল ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে ৪ বান্ডিল কিনে নেন। অপর ৩ বান্ডিল কেনেন জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুহেনিক এবং অধ্যাপক মাজার বেথেলেহেমের আরব খৃস্টান পূরাকীর্তি ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে । বিশপ মারের কাছের পুথিগুলো দেখে সর্বপ্রথম এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন আমেরিকান স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল রিসার্চের ডঃ ট্রেভর। ডঃ ট্রেভর পুথিগুলোর ছবি তোলেন। এরপর খ্যাতনামা প্রত্নতত্ববিদ উইলিয়াম অলব্রাইট তা পরীক্ষা করে রায় দেন যে ওগুলো খৃস্টপূর্ব ২০০ সাল থেকে ২০০ খৃস্টাব্দের কোন এক সময়ের। মার স্যামুয়েল তার ৪ খন্ড পূথি নিয়ে ১৯৪৯ সালে যান আমেরিকায়। সুবিধামত খদ্দের না পেয়ে ৫বছর পর নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রীট জার্নালে তা নীলামে বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন। ঐ সময়ে নিউইয়র্কে ভ্রমনরত প্রফেসর সুহানিকের ছেলে আইগাল ইয়েদিন তা কিনে নেন আড়াই লক্ষ ডলারে ১৯৫৪ সালের জু্লাই মাসে(এখনকার দিনের হিসেবে তা ২০লক্ষ ডলার বা ১৬ কোটি টাকা) ইয়েদিন তখন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ইজরায়েলের সেনাবাহিনী প্রধান। পরবর্তীতে ইয়েদিন হন একজন বিখ্যাত প্রত্নতত্ববিদ।অতঃপর প্রফেসর সুহানিকের কাছে ফিরে এল সাতটা পূথির বান্ডিল।ইজরায়েল সরকার পূথিগুলোকে জাতীয় সম্পদ ঘোষনা করে সাতটি পুথিকে জেরুজালেমের ইজরায়েল মিউজিয়ামে রাখার ব্যাবস্থা করেন।
১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাস্ট্র গঠন এবং আরব ইজরায়েল যুদ্ধের কারনে অনেকটা ভাটা পড়ল প্রত্নতাত্বিক অনুসন্ধানে। অবশেষে ১৯৪৯ সালে জর্দান প্রত্নতাত্বিক অধিদপ্তর বেদুইনদের সহায়তায় খুজে বার করল গুহাগুলো। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অনুসন্ধান এবং খনন কাজ চালিয়ে একে একে ১১টা গূহাতে আবিস্কৃত হল পুথি্গুলো। গুহাগুলোতে পাওয়া গেল আরো অনান্য প্রত্ন তাত্বিক সামগ্রি যেমন অলংকার, মাটির পাত্র, কাপড় ইত্যাদি। জর্দান সরকার পুথিগুলোকে রাখেন জেরুজালেমের রকফেলার মিউজিয়ামে।
কিভাবে কোথা থেকে এল পুথিগুলো?
গুহার নিকটবর্তী কামরানে ছিল ইহূদি এসেনেস উপগোষ্ঠীর বাস। এসেনেস এবং সম্ভবতঃ আরো ইহূদি উপগোষ্ঠী দের লেখা এই পুথি । ৭০ খৃস্টাব্দে রোমানদের আক্রমনে ধ্বংশ হয় এই ইহুদি বসতি।ইহূদিরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালায়। তারা আর ফিরে আসেনি ।তারাই পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে রাখে তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ এবং অনান্য সামগ্রী। প্রায় ২হাজার বছর ধরে তা রক্ষিত ছিল পাহাড়ের গূহাতে।
কি আছে পুথিগুলোতে?
পুথিগুলোকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। হিব্রু বাইবেল যা মোট পাওয়া পূথিগুলোর ৪০%, ইহুদিদের দ্বীতিয় মন্দির কালের(খৃঃপু- ৫৬২ থেকে ৬৮খৃস্টাব্দ) বর্ননা সম্বলিত রচনা-৩০% এবং ঐ সময়ের ইহুদি রীতিনীতির বর্ননা – ৩০% পুথি। অনেকগুলো পুথি অবিকৃত থাকলেও অধিকাংশ পুথি ছিল খন্ডিত পার্চমেন্টের টুকরা বিশেষ। ফলে অনেক পুথির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। হিব্রু , গ্রীক এবং আরামাইক ভাষাতে লেখা পূথিগুলো। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে বিশ্লেষন করা তা আয়রন গল এবং চিনাবার বা মারকারী ক্লোরাইডের কালি দিয়ে লেখা। মোট ৯৭২টি পুথি পাওয়া যায় সেখানে আর পুথির টুক্রোগুলো যদি ধরা হয় তাহলে মোট সংখ্যা ১ লক্ষের কাছাকাছি।
পূথিগুলোর গুরুত্ব কি?
এই পুথিগুলো পাওয়ার আগে প্রাচীনতম বাইবেল ছিল ১০ শতাব্দীর আলেপ্পো কোডেক্সে লেখা বাইবেল। এই পুথিগুলো হিব্রু বাইবেলকে পিছিয়ে নিয়ে যায় আরো হাজার বছর আগে।পুথিগুলো খৃস্টপূর্বাব্দ ১৫০ থেকে ৭০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে লিখিত। পুথিগুলোর ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।
বর্তমানে পুথিগুলো ইজরায়েল মিউজিয়ামের “ শ্রাইন অফ দি বুক” এ রক্ষিত আছে। ১৯৬৫ সালে লন্ডনের বৃটিশ মিউজিয়াম পুথিগূলোর প্রদর্শনীর আয়োজন করার পর তা ব্যাপক কৌতুহলের সৃস্টি করে। ১৯৬৭ সালের আরব ইজরায়েল যুদ্ধের পর এই অমূল্য সম্পদ চলে যায় ইজরায়েলের হাতে। কানাডার রয়্যাল ওন্টারিও মিউজিয়াম যখন ২০০৯সালে এর প্রদর্শনীর আয়োজন করে জর্দান তখন সরকারীভাবে কানাডা সরকারের নিকট দাবী জানায় তা জর্দানের কাছে ফিরিয়ে দিতে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১২ ভোর ৪:৪৩