হুইসেল বাজাইয়া মাত্রই রাত দশটার মতিহার এক্সপ্রেস ট্রেনটা পাহাড়পুর ছাড়িল। প্রথম শ্রেণীর আলোক সজ্জিত বিলাস বহুল কামরায় একমাত্র যাত্রী হইয়া ডাঃ সুবোল চন্দ্র বোস উঠিয়াছেন। আজন্ম আঁধার ডরাইয়া চলা সুবোল, আঁধারে হারাইয়া যাইবার নিমিত্তে নিজের অজান্তেই কামরার সমস্ত আলো নিভাইয়া ফেলিতে উদ্যত হইল। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু বেরসিক আলো জানালার ফাঁক গলিয়া আসিয়া তাহাতে একটু আধটু বাধ সাধিতে চাহিল। নির্জন আঁধারে হারাইয়া যাইতে অগ্যতা স্রষ্টা প্রদত্ত চক্ষু দ্বয়কেই মুদিয়া রাখিলো। অন্ধকারে হারাইয়া যাইতে এখন তাহাকে আর ঠেকায় কে?
আপদমস্তক বাস্তববাদী সুবোল চক্ষু মুদিয়া বড়ই ভাবুক হইয়া উঠিল। আঁধার রাত্রির নির্জনতার মাঝে স্মৃতির ঝাঁপি খুলিয়া, কোন এক সুপরিচিত রমণীর মুখ মনের আয়নায় ফুটাইয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। এন্টি রোমানন্টিক ডাঃ বাবুর প্রেম এবং বিবাহ কোনটাই যেহেতু করাহইয়া উঠে নাই তাই একটু ঝুঁকি লইয়া বলিয়া ফেলা যায় যে তিনি নিশ্চয়ই সবিতা দেবীকে স্মরণে আনিবার চেষ্টা চালাইতেছেন।
সবিতা দেবী সুবোলের ছোট মা। মা মরা সুবোলের মাতৃস্নেহ পূরণ করিবার নিমিত্তে এনাকেই বিয়ে করেছিলেন হরিহর বাবু।সুবলের সেই সাধ কস্মিন কালেই পূরণের চেষ্টাটুকুন যে তিনি করেন নাই উহা শিবপুরের সকলেই কমবেশি জ্ঞাত। মা কহিয়া ডাকিবার পরে সুবলের মস্তকে কেবল হাতটুকুন বুলাইয়া আদর করিয়াছেন এহেন ঘটনাও কেউ কোন দিন দেখে নাই। বরঞ্চ নিজের অমল, কমলের চাইতে সর্বদাই সুবোলকে আড় চোখে দেখিয়াছেন।
আশ্বিনের পুজোর সেই জামা কেনার ঘটনাখানি বলিলেই সুবোলের প্রতি তাহার মাতৃস্নেহের একটা ধারনা পাওয়া যাইতে পারে। সেই বৎসর আশ্বিনের কথাই বলিতেছি যেই বৎসর বানের জলে সকল ধানই ডুবিয়া গিয়াছিল। হরিহর বাবু সেই বৎসর পুজোর সময় অমল কমলকে একটা করিয়া জামা কিনিয়া দিলেও সুবোলকে কেনই যেন দিয়াছিলেন দুইখানা। এহেন পার্থক্য সবিতা দেবী এতটুকুনও মানিয়া লইতে পারেন নাই। তাই চালে টান পরিবার বাহানা দেখাইয়া পুরো দুই মাস সুবোলকে রাত ভর অভুক্ত রাখিয়াছিলেন।
হরিহর বাবু প্রয়াত হইয়াছেন আট বৎসর হইয়াছে। সুবোল গ্রাম ছাড়িয়াছে তাহারও দুই বৎসর পূর্বে । এই সময়টুকুর মধ্যে সবিতা দেবী কেবল একটি বারের জন্য সুবোলের খবর লইয়াছিলেন তাহা তিনি হলফ করিয়া বলিতে পারিবেন না। তবে হ্যা গত বৎসর সুবোলকে ফোন একবার করিয়াছিলেন । তাকে মোলায়েম সুরে বাবা বলিয়া সম্বোধনও করিয়াছিলেন। সম্ভবত তাহার মুখে সুবোলকে বাবা বলিয়া সম্বোধন ওটাই ছিল প্রথম হয়ত শেষ বারের মতো। খুব বেশি কুশলাদি না করিয়া অতি প্রয়োজনে বিশ হাজার টাকা চাহিয়া ফোন খানা রাখিয়া দিয়াছিলেন তিনি। মাতৃস্নেহহীন সুবল বিনা বাক্যেই তাহার দাবি মিটাইয়া ছিল।
এই সবিতা দেবীকে সুবোল কল্পনার আয়নায় আনিয়া কি করিতে চায়? নিশ্চয়ই তাহাকে প্রশ্নবানে জর্জড়িত করিবে অথবা করিবে র্ভৎসনা। না সুবোল উহা কিছুই করিবে না। কেবল মা বলিয়া ডাকিবে। মা বলিয়া ডাকিবে যখন তখন বাড়ি যাইয়াইতো ডাকিতে পারে।উহাইতো ভাবিতেছেন নাকি? না তাহা আর সুবোল পারিবে না । কারন আজ রাত্রেই সবিতা দেবী প্রয়াত হইয়াছেন। তাহার অন্তস্টিক্রিয়া সম্পন্ন করিবার নিমিত্তেই সুবোল এখন ট্রেনে। তাই তাহার সহিত কথা কহিতে চাহিলে কেবল কল্পনার আয়নাই সুবোলের একমাত্র পথ। সুবোল তাহাই করিল। কল্পনায় সবিতা দেবীকে জোড়াজুড়ি করিয়া আনিয়া ডুকরে কাঁদিযা উঠিয়া কহিল,“ মা তোমায় আমার খুব মা কইতে ইচ্ছা করতেছে। তুমি একবার বাবা কইয়া আমার মাথায় হাত বুলাইয়া দেও; মা....।”
অবিরাম খটখট করিয়া চলা ট্রেনের শব্দে সুবোলের আর্তনাদ বিলীন হইয়া গেল। চক্ষু খুলিয়া, পানি মুছিয়া, দুরের বাটিতে জ্বলা মৃদু আলোর দিকে তাকাইয়া সুবোল কি ভাবিল তাহা কেবল ও আর ওর স্রষ্টাই বলিতে পারিবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১২:২৪