প্রথমেই বলে নেই, এটা আমার মিউনিখের কোনা-কাঞ্চিতে যতটুকু ভ্রমন করতে পেরেছি, তার কাহিনী। প্রথমদিকের কিছু কথা ছাড়া এর সাথে আমার আগের পোষ্টের খুব একটা সম্পর্ক নাই। কাজেই মিসিং লিঙ্ক জোড়া লাগানোর জন্য কারো আগের পোষ্ট পড়া না থাকলে পড়তে পারেন। না পড়লেও নো প্রবলেমো।
যা বলতে শুরু করেছিলাম……...আমি আর সারাহ মিউনিখ পৌছলাম মঙ্গলবার (৫ই জুলাই) বিকালে। বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দাপ্তরিক কাজ সারলাম। যেই প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে আমাদের আগমন, তাদের একটা অফিসিয়াল লান্চে এটেন্ড করে কাম শেষ। এরপর সারাহ‘র লন্ডন ফিরে যাওয়া আর আমার মিউনিখ দেখার দৌড়ঝাপ শুরু। খাবার টেবিলে সারাহ খুব আগ্রহ নিয়ে আমার ট্যুর আইটিনিরারী জানতে চাইলো। মনোযোগ দিয়ে আমার বক্তৃতা শুনলো; বক্তৃতার এক পর্যায়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ হলো, ওরও মিউনিখ ঘুরে দেখার ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছে। সাধিলেই দেখিবে। কিন্তু খাল কেটে কুমীর আনার কি কোন দরকার আছে?
এই পর্যায়ে আপনাদের সাথে একজনের পরিচয় করিয়ে দেই। মহাশয়ের কেতাবী নাম মার্কাস ফ্রিডম্যান, সংক্ষেপে মার্ক। আমাদের জার্মান পক্ষের লিয়াজো অফিসার। বেচারা আক্ষরিক অর্থেই বুধবার সকাল থেকে আমাদের সাথে চুম্বকের মতো লেগে ছিল। এটা যদিও ওর এসাইনমেন্ট, তবুও আমাকে স্বীকার করতেই হবে, সে তার দায়িত্ব দুইশতভাগ পালন করেছে। এক সময়ে তো আমার মনে হয়েছিল, টয়লেটে যাওয়া ছাড়া ওকে ছুটানো মোটামুটি অসম্ভব একটা ব্যাপার। জার্মান প্রফেশনালিজমের একটা জলজ্যান্ত উদাহরন এই মার্ক! হাসি-খুশী আর প্রানচান্চল্যে ভরপুর একজন প্রানবন্ত মানুষ।
তো আমি যখন সারাহকে বক্তৃতা দিচ্ছিলাম, তখন মার্কের উশখুশ দেখে আমার সন্দেহ হচ্ছিল, সে বামহাত ঢুকাবে। ফলে আমি সবিশেষ চেষ্টা করছিলাম যেন মার্ক হাত ঢুকানোর কোন সুযোগ না পায়! কিন্তু বিধিবাম! উশখুশ করতে করতে মার্ক বলেই ফেললো, তুমিও থেকে যাও না….তিনজনে মজা করে ঘুরবো!! সারাহ মিনমিন করে বললো, না……..আমার কাজ আছে। আমি আর ভয়ে সারাহ'র দিকে না তাকিয়ে সিলিংয়ে ঝুলন্ত ঝাড়বাতির দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান ধরলাম, আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে……...অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাইরে!!!
যাই হোক, আমাকে না ডুবিয়ে সারাহ যথাসময়ে বিদায় নিলো। আমিও তল্পি-তল্পা গুটিয়ে পাচ-তারকা হোটেল ছেড়ে আমার আগে থেকে বুক করে রাখা বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট হোটেলে গিয়ে উঠলাম। বেড়ানোর জন্য কোন তারকা-চিহ্নিত হোটেলে থাকার মতো বেকুব তো আমি না!! এখানে বলে রাখা ভালো, বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট হোটেলগুলোকে অনেকে চিৎ-কাইৎ হোটেল মনে করে। ভুল। অনেক তারকা-চিহ্নিত হোটেলও বুকিং ডট কমের মতো সাইটগুলোতে বিভিন্ন অফার নিয়ে হাজির হয়। সে যাই হোক, আমার এই হোটেলটাও চমৎকার ছিল। কেউ মিউনিখ ঘুরতে গেলে চাইলে ওটাতে উঠতে পারেন। বেড়ানোর গল্প শুরু করার আগে জার্মান সরকারকে একটা বিষয়ে ধন্যবাদ না দিলে অন্যায় হবে। তারা জুন, জুলাই আর অগাষ্ট এই তিন মাস একটা পরীক্ষামূলক মাসিক ট্রাভেল পাস চালু করেছে। ৯ ইউরো দিয়ে একটা টিকেট করলে আপনি পুরোটা মাস অল্পকিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সম্পূর্ণ জার্মানীতে যে কোনও বাস, ট্রাম এবং ট্রেনে ভ্রমন করতে পারবেন। আমি অল্প কয়েকটা দিনে যেই পরিমান ভ্রমন করেছি, একমাস থাকলে তো পুরো দেশটাই ছ্যাড়াভ্যাড়া করে দিতাম!!!
এই সেই টিকেট, এর নাম ''৯ ইউরো টিকেট''
হোটেলে তল্পি-তল্পা রেখে সময় নষ্ট না করে বেড়িয়ে পড়লাম, কারন টাইম ইজ মানি…...থুক্কু ঘোরাঘুরি! প্রথম গন্তব্য মারিয়েনপ্লাৎজ। তার আগে ছোট্ট করে দু'টা কথা বলি। মিউনিখ হচ্ছে বাভারিয়া রাজ্যের রাজধানী। এই বাভারিয়াতে আল্পস পর্বতমালার একটা অংশ পড়েছে, যেটাকে বাভারিয়ান আল্পস বলা হয়। এটা জার্মানীর তৃতীয় বৃহত্তম নগরী। ও ভালো কথা, জার্মানরা কিন্তু মিউনিখ বলে না, তারা বলে ম্যুনশেন। ম্যুনশেন মানে মঙ্কস বা সন্নাসীদের আবাসস্থল। এই নগরীটার গোড়াপত্তন হয়েছিল সন্নাসীদের হাতে, সেই জন্যই এই নাম। ম্যুনশেনের কোট অফ আর্মস এও সন্নাসীদের ছবি আছে। আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন, বাভারিয়ান বিয়ার বিশ্বখ্যাত। এখানে অক্টোবর মাসে ''অক্টোবারফেস্ট'' নামে একটা বিয়ার পানের উৎসব হয়, যেখানে সারা বিশ্বের বিয়ারখেকোরা এসে জড়ো হয়। আমি যেহেতু শরাব পান বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছি, তাই এটা নিয়ে আর কিছু বললাম না। আগ্রহীরা গুগল করে জেনে নিয়েন!!
মারিয়েনপ্লাৎজ সেই ১১৫৮ সাল থেকে মিউনিখের প্রধান স্কয়ার। এখানে অবস্থিত নয়া টাউন হল একটা দেখার মতো স্থাপত্য। ১৯০৫ সালে এটার নির্মানকাজ শেষ হয়। কয়েকটা ছবি দেখেন,
মারিয়েনপ্লাৎজের আশেপাশে বেশকিছু কারুকার্যময় বিল্ডিং আছে। একটা নমুনা দেখাই,
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোই এই কবুতরগুলোরও কোন ভয়ডর নাই। খাবার দেখলে এরা দলবেধে মানুষের গায়েও চড়াও হয়।
৬ ইউরো খরচ করে টাউন হলের টাওয়ারে উঠলাম। সিড়ি ভাংতে হয় না, লিফট আছে। উঠার আগে শুনেছিলাম, মিউনিখের অতি মনোরম প্যানারোমিক ভিউ পাওয়া যায় ওখান থেকে। দেখলাম, তেমন আহামরি কিছু না। তারপরেও ট্যাকা খরচা করে যেহেতু উঠলামই, কয়েকটা ছবি দেখাই,
প্রথম ছবিটাতে দুরে, স্কাই লাইনে বাভারিয়ান আল্পস এর পর্বতমালা। দেখা যায়?
দুইটা এমনি এমনি ছবি,
স্কয়ারের একাংশ
এই ছবিটা ইন্টারেস্টিং। লিফটের বাটনগুলো না থাকলে এটাকে কেউ লিফটের দরজা বলেই মানতো না। আগে এটা ছিল সিড়িঘরের দরজা। প্রাচীনতা আর আধুনিকতার চমৎকার মিশেল, কি বলেন!!
এর পরের যাত্রা ১০ মিনিটের হাটাপথে একটা ক্যাথেড্রালের দিকে। ইউরোপের প্রাচীন ক্যাথেড্রালগুলো দেখে আমি আনন্দ পাই এর ভিতরের অঙ্গসজ্জার জন্য। তবে, এটা দেখতে গিয়েছিলাম একটা বিশেষ কারনে। পরে বলছি। ফ্রাউয়ানকির্শা বা দ্য ক্যাথেড্রাল অফ আওয়ার লেডি‘র নির্মান শেষ হয় ১৪৬৮ সালে। এর ১০৯ মিটার লম্বা ক্লক টাওয়ার দু'টা দেখার মতো।
সদর দরজা
চলেন, ভিতরে ঢুকে বেদীর দিকে যাই,
বেদীর উল্টাদিকে এই চমৎকার নক্সা করা অর্গান (পুরানোটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস করা হয়, পরে ১৯৯৩ সালে এটা তৈরী করা হয়)
সম্রাট চতুর্থ লুইস এর সেনোটাফ (খালি কবর)
এবার বলি, কেন বিশেষ করে এই ক্যাথেড্রালটা দেখতে গেলাম। ছবিগুলো দেখেন।
একটা পায়ের ছাপ। তাই না!! এটা হলো, ডেভিল'স ফুটপ্রিন্ট (শয়তানের পায়ের ছাপ)। বুঝতেই পারছেন, এটা একটা মিথ! গল্পটা বলি তাহলে।
এই ক্যাথেড্রালটা তৈরী করতে গিয়ে এর নির্মাতা জর্গ ভন হালসবাচ টাকার অভাবে পড়ে যায়। সেই অভাব পূরণে তখন শয়তান এগিয়ে আসে। তার শর্ত ছিল, প্রয়োজনীয় টাকা সে দিবে, কিন্তু ক্যাথেড্রালে কোন জানালা থাকতে পারবে না। শয়তানের উদ্দেশ্য ছিল, যেখানে প্রার্থনা হবে সেই জায়গাটা যেন ঘন কালো অন্ধকার থাকে। সেই অন্ধকারে শয়তান কি শয়তানী করবে, সেটা অবশ্য খোলাসা করে নাই। যাই হোক, উপায় না দেখে জর্গ সেই শর্তে রাজি হয়ে যায়, কিন্তু একটা চালাকী করে। জানালাগুলো পিলারের আড়ালে এমনভাবে বসায়, যেন কেউ ঢোকার পরপরই সেগুলো তার নজরে না আসে। তো, তৈরী শেষ হওয়ার পরে শয়তান সরেজমিনে তদন্ত করতে আসে। এসে কোন জানালা না দেখে খুবই খুশী হয়, কিন্তু অচিরেই তার এই খুশী ক্রোধে রুপান্তরিত হয়, যখন সে আরো কয়েক পা এগিয়ে যায়! জানালাগুলো নজরে আসার পরে সে রাগে এমন জোরে মেঝেতে পা ঠোকে যে, ফ্লোরের মার্বেল পাথরে তার পায়ের ছাপ পড়ে যায়।
এই গল্প থেকে আমরা যেটা জানতে পারি তা হলো, ''চোরের উপর বাটপারী'' বলে যে একটা বাগধারা বাংলায় প্রচলিত আছে, সেটা শয়তানের জানা ছিল না। শয়তানও জুতা পরিধান করে; আর আইএমএফ বা ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের মতো বিভিন্ন প্রোজেক্টে শর্তসাপেক্ষে লোন দিয়ে থাকে। আমাদের দেশের ছোট-বড় শয়তানেরা চেষ্টা করে দেখতে পারেন; প্রধান শয়তানকে বোকা বানানোতে উনাদের খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না।
ক্যাথেড্রালের সামনে স্থাপিত এই শিল্পকর্মটা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। পাথর খোদাই করে বানানো এটাতে ক্যাথেড্রাল, মারিয়েনপ্লাৎজসহ আশেপাশের পুরো এলাকাটা নিখুতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এবার পরিবেশ রক্ষায় জার্মান সরকারের একটা চমৎকার উদ্যোগের কথা বলি। এই ছবিটা দেখেন।
REWE CITY নামের একটা সুপার স্টোর থেকে ৬২ সেন্ট দিয়ে এক বোতল পানি কিনেছিলাম, তার রশিদ। রশিদে ৬২ সেন্ট নাই; ৩৭ সেন্ট আর ২৫ সেন্ট আছে। ৩৭ সেন্ট হলো পানির দাম। আন্ডারলাইন করা ২৫ সেন্ট প্লাস্টিকের বোতলের দাম। পানি খেয়ে বোতল ফেরত দিলে ওরা ২৫ সেন্ট ফেরত দিয়ে দেবে!!! যত্রতত্র প্লাস্টিকের বোতল ফেলা বন্ধ করার কি অভিনব কিন্তু কার্যকর পন্থা, তাইনা!!!
বৃটিশ বা বাংলাদেশ সরকার এই সিস্টেম চালু করে না কেন…...আমার মাথায় ঢোকে না। ভালো জিনিস শিখতে অসুবিধা কি?
আমি পাবলিক প্লেস গুলোতে অনেককে এই বোতল সংগ্রহ করতে দেখেছি। ৪টা বোতল হলেই এক ইউরো! মন্দ কি!! আরেকবার গেলে ভাবছি আমিও কিছু বোতল কুড়াবো। পার্ট-টাইম পেশা হিসাবে ভালোই, কি বলেন?
এই পর্ব এখানেই শেষ করি। পরের পর্বে আপনাদেরকে একটা বিশেষ জায়গায় ঘোরাবো। আচ্ছা…….এটা একটা কুইজ হিসাবে থাকুক। কোথায় ঘোরাবো যিনি প্রথম বলতে পারবেন, তার জন্য থাকবে আকর্ষনীয় পুরস্কার। পুরস্কার সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে পেয়ে যাবেন। ব্লগে যারা আমার বেড়ানোর পছন্দ জানেন, তাদের জন্য খুব একটা কঠিন হওয়ার কথা না। আলেস গুটে!!!
শিারোনামের ছবি সূত্র। বাকী ছবিগুলোর কৃতিত্ব আমার মোবাইলের।