আমি ক্লাশ সেভেনে পড়ার সময় আমার নাইনে পড়ুয়া বোন আর্টস নিল। এদিকে আমার তখন প্রিয় বিষয় হলো সায়েন্স; ফলে প্রতিনিয়ত দু‘জন ঝগড়া করতাম কোনটা বেশী ভালো, এটা নিয়ে। সেই ঝগড়ায় কোন সমাধান হতো না, কিন্তু প্রায়শঃই সেটা রুপ নিতো হাতাহাতিতে। ফলে জাতিসংঘের ঘরোয়া ভার্সান হিসাবে আম্মার আবির্ভাব হতো। কলেজে পড়ার সময়ে আবাহনী সেরা নাকি মোহামেডান, এই নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে তুমুল লেগে যেতো। সেটারও কোন সমাধান কোনদিন হয়নি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঘন্টার পর ঘন্টা চলতো আওয়ামী লীগ আর বিএনপি নিয়ে তর্কাতর্কি। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের এইসব ঝগড়াঝাটি কোনদিনই কোন পরিণতি পায় নাই। পাওয়ার কথাও না।
এখন ব্লগে এসে দেখি প্রতিনিয়ত আস্তিকতা আর নাস্তিকতা নিয়ে তর্ক। ছাত্রাবস্থার কথা আলাদা। তখন ঝগড়া করা একটা নেশার মতো ছিল, কিন্তু এই পরিণত বয়সে এসে ব্লগে যখন অন্যান্য পরিণত মানুষদের এমন অপরিণত ঝগড়া দেখি, তখন হাসি পায়। এই আস্তিক-নাস্তিক তর্ক করে কেউ কোনদিন কোন সমাধানে আসতে পেরেছে? নাকি ভবিষ্যতেও পারবে? সময়ের কি নিদারুন অপচয়! না, তারপরেও আমি এসব বিতর্কের বিরুদ্ধে কিছু বলছি না। তর্ক চলুক, তবে সেটা হওয়া উচিত সুস্থ তর্ক। বাক-স্বাধীনতা সবারই থাকা উচিত। তবে, সেইসঙ্গে বাক-স্বাধীনতার মানে জানাটাও জরুরী।
বর্তমান বিশ্বে বাক-স্বাধীনতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কি জিনিস এটা? হিউম্যান রাইটস এ্যাক্ট এর আর্টিকল ১০ এ বলা আছে, Everyone has the right to freedom of expression. আর তারপরেই বলা আছে, Although you have freedom of expression, you also have a duty to behave responsibly and to respect other people’s rights. আমাদের ব্লগের তথাকথিত সুশীলরা প্রথম পয়েন্টে সোচ্চার, কিন্তু দ্বিতীয় পয়েন্টে স্পিকটি নট! এটাকেই বলে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। একটা উদাহরন দেই। ফ্রান্সের শার্লী এবদো ম্যাগাজিন যখন মহানবী (সাঃ) এর ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ করে, তখন সারা দুনিয়ার মুসলমানরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এটা নিয়ে জল কম ঘোলা হয় নাই। কিন্তু ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন তখন কারো বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না, এই যুক্তি দেখিয়ে এই ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় নাই। ব্লগেও নাস্তিক আর ছদ্ম-মুসলমানরা ফরাসী সরকারের এই মনোভাবের প্রশংসা করে আর মুসলমানদের উগ্রতার নিন্দা করে পোষ্টের পর পোষ্ট আপলোড করতে থাকে। ক'দিন আগের খবর। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট একটি বিলবোর্ড মালিকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করছেন যিনি তাকে কোভিড -১ বিধিনিষেধের প্রতিবাদে অ্যাডলফ হিটলার হিসাবে চিত্রিত করেছিলেন। এই ব্যাপারে সেই বিলবোর্ড মালিক Michel-Ange Flori এর প্রতিক্রিয়া হলো, ''In Macronia you can make fun of the prophet's ass, that's satire, but to make the president look like a dictator is blasphemy.'' ব্লগের সেইসব অত্যুৎসাহী ব্লগাররা এখন এই বিষয়ে নীরব কারন তাদের কাছে বাক-স্বাধীনতার সংজ্ঞা ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভরশীল। কি হাইস্যকর!!!
বেশ কিছু ব্লগার আছেন, যারা ধর্ম নিয়ে মকারী পোষ্টে গিয়ে কিছু ঠিকমতো না বুঝেই মাশাআল্লাহ, সোবহানাল্লাহ বলে ভাসিয়ে দেন। তাদের প্রতি অনুরোধ, চোখ-কান খোলা রেখে ব্লগিং করেন। আমাদের একজন ব্লগার আছে, যার কাছে ধার্মিকরা ''পশুসমতুল্য, মানসিক রোগী। এদের চিকিৎসা দরকার।'' খুবই ভালো কথা। যতোদুর জানি, উনার অর্ধাঙ্গিনী একজন নামায-রোজা ইত্যাদি পালন করা ধার্মিক। ফলে খুব জানতে ইচ্ছা করে, বাইরের মানুষদেরকে নিয়ে ওয়াজ-নসিহত করার আগে ঘরে উনি এই সমস্যা সমাধানে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন! জেনারালাইজ মন্তব্য যে আদপে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, সেটা উনাকে কে বোঝাবে? এই ধরনের বক্তব্য দিনশেষে নিজেকে উজবুকেই পরিণত করে…..আর কিছু না। আরেকজন ব্লগার আছে যাকে নিয়ে বেশী কিছু বলতে চাই না। আপনাদেরকে স্যাম্পল হিসাবে দু‘টা কমেন্ট দেখাই আগে, তারপরে কিছু কথা বলি।
এই রকমের চতুস্পদী মানসিকতার সমগোত্রিয় আরো যারা আছে, এবার তাদেরকে বলি…..আপনারা বিশ্বাস করেন না, খুবই ভালো কথা; কিন্তু এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ করে। তাদের বিশ্বাসে আঘাত করার অধিকার আপনাদের নাই। এই ব্লগে প্রচুর ভিজিটর আসেন। তাদের কেউ যদি ব্লগে আলোচনার স্যাম্পল হিসাবে এ'জাতীয় কিছু স্ক্রীণশট ফেসবুকে শেয়ার করেন, তাহলে কি কি পরিস্থিতি হতে পারে সেটা কি আপনাদের শুন্য মস্তিস্কে ঢোকে? অন্যের বিশ্বাসে আঘাত করার বিষয়টা যদি বাদও দেই; অন্ততঃ ব্লগের স্বার্থে, ব্লগের সাথে জড়িতদের স্বার্থে, সর্বোপরি সাধারন ব্লগারদের স্বার্থে এসব ঘৃন্য মানসিকতার প্রদর্শনী বন্ধ করেন। বেশ কিছুদিন আগে ব্লগ ব্লকের সময়টাতে আমরা, ব্লগাররা কি রকমের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, সেটা সম্ভবতঃ আপনাদের জানা নাই। একই ধরনের কথা আগেও বলেছি, আজ আবারও বললাম। বারে বারে এই জাতীয় কথা বলতে ভালো লাগে না। বাক-স্বাধীনতার মানেটা তৃতীয় প্যারাতে গিয়ে আরেকবার দেখে নেন।
ধার্মিক আর বক-ধার্মিকে তফাৎ আছে। বিজ্ঞানের অন্যতম বড় আবিস্কার আনবিক শক্তি। এটা দিয়ে যেমন সভ্যতা বিদ্ধংসী আনবিক বোমা বানানো যায়, তেমনি সারা বিশ্বের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানও করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে ধ্বংসলীলার জন্য কেউ বিজ্ঞানকে দোষ দেয় না। দোষ যদি দেয়, তাহলে তার পাশবিক প্রয়োগকে। তেমনি কিছু ভন্ড-ধার্মিকের ক্রিয়াকলাপের জন্য যারা ঢালাওভাবে ধর্মের দোষ দেয়, তারা বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। এদের নিয়ে বেশী কিছু বলার নাই। কিছু মানুষ মনে করে ধর্মকে কড়াভাবে গালাগালি করা কিংবা কটুকাটব্য করা বিশাল একটা স্মার্টনেসের ব্যাপার! দু'পাতা বিজ্ঞান পড়ে এইসব ওভারস্মার্টরা একেকজন নব্য আইনস্টাইন বনে যায়। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে ইওরোপে অনেক নাস্তিক দেখেছি, তবে এদেরকে কখনও কোন ধর্মকে গালাগালি বা ধর্মীয় ব্যক্তিদের ব্যাপারে অশালীন কথা বলতে শুনি নাই। একমাত্র কু-শিক্ষাই এই ধরনের মানসিকতা-সম্পন্ন দ্বি-পদী প্রাণীর জন্মে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আরেকটা কথা না বলে পারছি না। ইসলাম কোন কন্ডিশনাল ধর্ম না। মুসলমান হতে হলে আপনাকে আল্লাহ, তার রাসুল (সাঃ) আর অবতীর্ণ কিতাব কোরআন শরীফকে আনকন্ডিশনালী মানতে হবে, বুকে ধারনও করতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, ব্লগে কিছু আছে যারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবী করে, কিন্তু এই সমস্ত মানে না। এসব ক্ষেত্রে একটা কথাই আমার মনে আসে…...হলি কাউ!!! এদেরকে মুসলমান বলে না, আবার কাফেরও বলে না। কি যেন একটা বলে? কারো জানা থাকলে মন্তব্যে সবাইকে জানাবেন দয়া করে। তবে তার চেয়েও মজার ব্যাপার হলো, আরো কেউ কেউ এদেরকে বোঝানোর জন্য হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। আরে…...যে আল্লাহ-রাসুল মানে না, কোরআন শরীফের বাণী বোঝে না; তাকে হাদীস শোনানোর মানে কি? নির্বুদ্ধিতার একটা সীমা তো থাকা উচিত! কিছু ভুল বললাম কি? পোষাক-সর্বস্ব তথাকথিত হুজুরদের মতো এদের ব্যাপারেও আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
আমি একজন আস্তিক, কিন্তু আমি নাস্তিকতার বিরুদ্ধে নই। নাস্তিকতাও একটা বিশ্বাস। একজন বিশ্বাসী হিসাবে আমি নাস্তিকদের বিশ্বাসকেও সন্মান করি। কিন্তু কোন নাস্তিক যখন বলে, আল্লাহ কেন আমেরিকার কথা কোরআন শরীফে বলে নাই, কলম্বাসকে কেন আমেরিকা আবিস্কার করতে হইলো…….তখন হাসি বন্ধ করা কঠিন হয়ে যায় আমার জন্য। আবার অনেকে কোরআন শরীফের কোন একটা আয়াতকে উদ্ধৃত করে বিশাল মন্তব্য করে বসে। কিন্তু এর আগের/পরের আয়াত বা তার কনটেক্সট বোঝার চেষ্টা করে না। তা না করুক, কোন অসুবিধা নাই। আগেই বলেছি, আমি সব সময়েই গঠনমূলক আলোচনার পক্ষে। তবে সেটা অবশ্যই হওয়া উচিত অশালীনতাকে পরিহার করে।
আমি জানি, ব্লগ টিমকে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করতে হয়। তারপরেও ব্লগের স্বার্থে, ব্লগের সাথে জড়িতদের স্বার্থে, আর ব্লগারদের সম্পর্কে সমাজে যে সামাজিক স্টিগমা প্রচলিত আছে…...তা নিরসনের স্বার্থে উনারা এই ব্যাপারে আরেকটু নজর দিবেন। ব্লগে গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা জোরদার হোক, এটাই তো দিনশেষে আমাদের সবার কাম্য!!
এতোক্ষণ ধৈর্য ধরে আমার এই লেখাটা পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ফটো কৃতজ্ঞতাঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০২১ দুপুর ১২:২৪