সে একটা সময় ছিল, যখন জ্ঞানী-গুনীদের কদর ছিল সমাজে। তখন গুনীজনদের জ্ঞানের প্রচার ও প্রসার নির্ভর করতো ওনাদের গুনমুগ্ধদের উপর। গুনীজনরা তখন ছিলেন বিনয়ের অবতার। উনাদেরকে কেউ জ্ঞানী বললে উনারা সবিনয়ে জানাতেন, আমার কোন জ্ঞানই নাইরে ভাই। আমি এখনও শিখছি; কিংবা জ্ঞানের সমুদ্রেও নামতে পারি নাই এখনও, পাড়ে দাড়িয়ে মাত্র নুড়ি কুড়াচ্ছি। সেই যুগ গত হয়েছে সেই কবেই। বর্তমান যুগকে বলা হয়ে থাকে কলিযুগ।
কলিযুগ শুনে কেউ কেউ ভিমড়ি খেতে পারেন, আবার কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে উঠতে পারেন। কারন কলি একটা স্ত্রী-বাচক নামও বটে। কাজেই যাদের আলুজনিত দোষ আছে, তাদেরকে বলছি; একে কলি নামক কোন মেয়ের যুগ ভেবে বসলে কিন্তু বিরাট সমস্যা। আসলে এই কলি সেই কলি না। এই কলি মানে……..আক্ষরিকভাবে, কলির যুগ হল হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী চার যুগের শেষ যুগ; তবে বাংলা ভাষায় সাধারনভাবে কলিযুগ বা কলিকালকে আধুনিক কাল হিসাবে দেখা হয়।
এই কলিযুগের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এই যুগে সিংহভাগই জ্ঞানী। আর এই জ্ঞানীরা তাদের প্রচার ও প্রসার নিজেরাই করে থাকেন। কারন, প্রায় সবাই জ্ঞানী হওয়াতে গুণমুগ্ধ ভক্তের সংখ্যা বলতে গেলে শুন্যের কোঠায়। এখন নিজের ঢোল নিজেকেই পেটাতে হয়। ব্লগে যে কেউ এলে আমার কথার সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। এই জ্ঞানীরা শুধু নিজের প্রচার করেই ক্ষ্যান্ত দেন না, অন্য জ্ঞানীদের ইজ্জতের উপরও হামলা করেন সময় এবং সুযোগ পেলেই। সে যাকগে, কথা বেশী বলা বন্ধ করে আসল কথায় আসি।
বলতে শরম লাগলেও আপনাদেরকে জানাই, আমার একটা বই বের হয়েছে। বইটার নাম, আমার সাদা গাড়ি ও সাদা মেম। আর প্রকাশক হলো, অপু তানভীর। প্রকাশকের সাথে আমার শর্তই ছিল, এই বই প্রকাশের ঘটনা কোন কালেই ব্লগে জানানো যাবে না, কলিকালে তো নয়ই। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম, এই মীরজাফর-জগৎশেঠ-রায়দুর্লভদের বাংলায় কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। সুনীলের কেউ কথা রাখেনি, অপু তানভীরও কথা রাখলো না। গোপনীয়তা ফাস করে দিল। দিলই যখন, কি আর করা; লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে আপনাদের সামনে এর পরিচিতি তুলে ধরছি।
আমার এই বইটাতে বড়, ছোট, মাঝারী; অণু-পরমানুসহ ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন জাতীয় পন্চাশটি গল্প রয়েছে। সেই হিসাবে এটাকে গল্প সংকলনও বলতে পারেন। প্রথম বড় গল্পটার নামই হলো, আমার সাদা গাড়ি ও সাদা মেম। এই গল্পটার নামেই বইটার নাম।
গল্পটা তাহলে আপনাদেরকে সংক্ষেপে বলি।
------------------------------------
শিহাব আহমেদ। বিলাত-প্রবাসী একজন বাংলাদেশী। টেসকোর একটা সুপার স্টোরের সেল্ফ চেক আউট কাউন্টারে সে তার খরিদকৃত মাল সামান স্ক্যান করছিল। হঠাৎ তার কানে এলো একটা নারী কন্ঠ। তবে পুলকিত হওয়ার পরিবর্তে সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। কারন নারী কন্ঠটা বলছে, শাট আপ ইউ বিচ্!!!
অণুসন্ধানী দৃষ্টিতে সে পাশের কাউন্টারের দিকে তাকালো। সেখানে এক ঢেউ-খেলানো চুলের সাদা মেম মেশিনকে গালাগালি করছে। ঘটনা হলো, কোন আইটেম স্ক্যান করে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে হয়; সেখানে কোন সমস্যা হলে একটা অটোমেটেড ভয়েস বলে, প্লিজ, চেক ইয়োর ব্যাগিং এরিয়া!!! আর এই অটোমেটেড ভয়েসটা সাধারনতঃ নারী কন্ঠের হয়। এখন এই মেয়ে তার আইটেমের কোন সমস্যা দেখছে না, অথচ মেশিন ক্রমাগত এই কথা বলে যাচ্ছে। রাগ হওয়ারই কথা। এই চেক আউট এরিয়াতে একজন এটেনডেন্ট থাকে ক্রেতাদের যে কোনও সমস্যা সমাধানের জন্য। শিহাব এই স্টোরের নিয়মিত খদ্দের হওয়ার কারনে সবাইকেই চিনে। এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখলো এটেনডেন্ট একটু দুরে আরেক কর্মীর সাথে খোশ-গল্প করছে। সে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।
মেম শিহাবকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার জিনিস-পত্র নিয়ে চলে গেল। মেয়েটার মধ্যে কি জানি একটা আকর্ষণ আছে। সেটা হতে পারে, তার মজার আচরণের কারনে, হতে পারে তার ঢেউ খেলানো চুলের কারনে কিংবা হতে পারে একটু পর পর কিছু অবাধ্য চুল তার মুখের উপর এসে পড়া, মাথা ঝাকি দিয়ে সেই চুল সরানো আর কথা বলার আমুদে ভঙ্গির কারনে। অবশ্য যেই মেয়ে মেশিনকে গালাগালি করে, সে মজাদার চরিত্রের হওয়ারই কথা।
শিহাব তার কেনাকাটা শেষ করে বাইরে এসে দেখলো, সেই মেয়ে বাইরে দাড়িয়ে চোখ-মুখ কুচকে বিরক্ত ভঙ্গিতে সিগারেট টানছে। এটা একটা ভালো সুযোগ! শিহাব তার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে এগিয়ে গেল।
এক্সকিউজ মি……...আমার লাইটারটা খুজে পাচ্ছি না। তোমারটা একটু পেতে পারি?
মেয়েদের সাথে কথা বলার এটা একটা পুরানো টেকনিক হলেও সময়ে সময়ে কাজে দেয়! আমি নিশ্চিত, তোমার লাইটার তোমার পকেটেই আছে! লাইটারটা এগিয়ে দিতে দিতে চোখ মটকে মেয়েটা বললো।
প্রথম কথাতেই এমন সরাসরি আক্রমণে অনেকেই ভড়কে যাবে, তবে শিহাব ভড়কালো না। বরং আরও মজা পেল। সিগারেট ধরিয়ে একগাল ধোয়া ছেড়ে বললো, তোমাকে কেমন যেন বিরক্ত দেখাচ্ছে! দিনটা মনে হয় ভালো যাচ্ছে না তোমার।
ঠিক তাই! পনের মিনিট আগে ট্যাক্সি কল করেছি। এখন বলছে, কিছুটা দেরী হবে। কি জানি একটা টেকনিক্যাল সমস্যা হয়েছে ওদের নেটওয়ার্কে। ড্রাইভারদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না ঠিকমতো। এদিকে আমাকে এক্ষুনি বাসায় ফিরতে হবে। জুলি না খেয়ে আছে। সময় মতো খাবার না পেলে মাথা ঠিক থাকে না ওর!
জুলি কে, তোমার মেয়ে?
আরে ধ্যাৎ! আমার মেয়ে আসবে কোথা থেকে? ঝাঝিয়ে উঠলো মেয়েটা। আমি তো বিয়েই করিনি এখনও। জুলি আমার কুত্তার নাম। মেয়ে তো!! খুবই দেমাগী আর সেইসাথে রাগটাও একটু বেশী!!!
তাহলে তো বিরাট সমস্যা!! কোনদিকে থাকো তুমি? চাইলে আমি তোমাকে ড্রপ করতে পারি।
আমি কোথায় থাকি বললে তুমি বলবে, তুমিও সেইদিকেই যাচ্ছো, তাই না!! ঝকঝকে দাত বের করে হাসলো মেয়েটা। তবে, তোমার প্রস্তাব ভালো। আমি আসলেই আর দেরী করতে পারছি না। ও…..ভালো কথা! হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটা। আমার নাম এলিনা। বন্ধুরা আমাকে লিনা বলে ডাকে। তোমার গাড়ি কি অনেক দুরে পার্ক করেছো? ট্রলিটা কি ছেড়ে দেবো?
শিহাব হাত বাড়াতে বাড়াতে বললো, আমি শিহাব। বন্ধুরা অবশ্য আমাকে শিহাবই ডাকে। তবে ওরা বলে, যোগাযোগের হাব হিসাবে আমার কার্যকারিতা নাকি অসাধারন!! সব কটা দাত বের করে একটা হাসি দিলো শিহাব। হ্যা, ছেড়ে দাও ট্রলিটা। আমার গাড়ি কাছেই…….ওই যে…..ওই সাদা গাড়িটা। চলো যাওয়া যাক! তা আমি তোমাকে কি বলে ডাকবো, এলিনা নাকি লিনা?
সেটা নির্ভর করবে, তুমি কতো তাড়াতাড়ি আর নিরাপদে আমাকে বাড়ি পৌছে দেবে, তার উপর!!
এই ছোট্ট শহরের নাড়ি-নক্ষত্র শিহাবের চেনা। মিনিট দশেক পরেই পৌছে গেল জায়গা মতো।
ঝটপট নেমে গেল এলিনা। বললো, আমি এখন চরম ব্যস্ত থাকবো বেশ কিছুক্ষণ, নয়তো তোমাকে কফি খেতে ডাকতাম। সামনের উইক এন্ডে এদিকটাতে যদি আসো, আমাকে নক কোরো। লিফটটার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। হোপফুলি আই'ল সি ইউ এগেইন! তারপর একটু পজ দিয়ে বললো, ভেরী সুন!!!
শিহাব মৃদু হেসে বললো, আশা করি!! আর মনে মনে বললো, অবশ্যই সুন্দরী!!!!
এলিনার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে শিহাবের মনে একটা গান গুনগুনিয়ে উঠলো। বহুদিন আগে দেখা একটা সিনেমার গান….….. যেও না, সাথী! চলেছো একেলা কোথায়!! পথ খুজে পাবে না তো, শুধু একা!!!!
এরপর…….পরের উইক এন্ড কি শিহাবের জীবনে এসেছিল? প্রেমের ফুল ফুটেছিল? জানতে হলে আপনাকে কিনতে হবে, ভুয়া মফিজের প্রথম বই.….…...আমার সাদা গাড়ি ও সাদা মেম!!!

পাচশত পৃষ্ঠার এই বইটার কভার ফটো দেখতে চাইলে এইখানে ক্লিকান। অনেক চিন্তা-ভাবনা করেও অমুল্য এই বইটার কোন মুল্য নির্ধারন করা সম্ভব হয় নাই। বই পড়ার পর খুশী হয়ে যে যা দিবে, সেটাই মুল্য। আর বইটা সংগ্রহের সময়ে যেহেতু মুল্য পরিশোধের কোন ব্যাপার নাই, কাজেই ''বিফলে মুল্য ফেরত'' কথাটা এখানে মুল্যহীন। বইটা পাওয়া যাবে, নীলক্ষেতের সামনে ফুটপাথের যে কোনও বইয়ের স্তুপে। খুজে নেয়া আপনাদের দায়িত্ব।
শেষ কথাঃ সম্পূর্ণ লেখাটাই কাল্পনিক। এইটাকে সত্য ধরিয়া লইয়া কেউ যদি কোন প্রকারের আছাড়-বিছাড় খান, নিজ দায়িত্বে খাইবেন। কথিত পুস্তকের লেখক বা প্রকাশককে কোন রকমের দোষারোপ করা যাইবে না। আমার এই লেখাটা আমার বইয়ের সুযোগ্য প্রকাশককে উৎসর্গ করা হইলো। কারন এই গোটা কর্মযজ্ঞে তাহার উৎসাহ এবং উদ্দীপনা আমার চাইতে অধিক ছিল!!!

ছবিঃ গুগল থেকে সংগ্রহকৃত।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১:৫৪