গতমাসে ব্লগের জন্য একটা পোষ্ট লেখা শুরু করেছিলাম। স্যাটায়ার আর হিউমার নিয়ে। এ'দুটোর বাংলা সম্ভবতঃ ব্যঙ্গ এবং হাস্যরস। আমার কাছে বঙ্গানুবাদটা খুব বেশী পোক্ত মনে হয় নাই। ইংরেজি শব্দ দু'টার ভাবার্থতে যে ব্যাপকত্ব আর বিশালত্ব রয়েছে, বাংলা শব্দ দু'টাকে সেই তুলনায় ততোটা পরিপূর্ন মনে হয় না; মনটা কেমন খুত খুত করে। হতে পারে, এটা আমার বোঝার ভুল। যাই হোক, আমি এই লেখায় তাই স্যাটায়ার আর হিউমার শব্দ দু'টাই ব্যবহার করবো। আশা করছি, এটা কারো মনোবেদনার কারন হবে না। তো যা বলছিলাম, কেন জানি লেখাটাকে এগিয়ে নিতে পারছিলাম না। বারে বারে কিছুটা লেখি, ক'দিন পরে পড়তে গিয়ে আর পছন্দ হয় না। একটা পর্যায়ে হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা……..সন্মানীত ব্লগারগন স্যাটায়ার আর হিউমার জিনিস দু'টা কতোটা বোঝে? অর্থাৎ কিনা এদের অন্তর্নিহিত অর্থ, পার্থক্য, কখন আর কি কি পরিস্থিতিতে এদের ব্যবহার হয় ইত্যাদি কতোটা বোঝে?
দেশে থাকতে আমি দীর্ঘদিন বাজার ও সামাজিক গবেষণার সাথে পেশাগত কারনেই জড়িত ছিলাম। ভাবলাম, ব্লগে এমন একটা জরীপ চালালে কেমন হয়? ব্লগে কোয়ান্টিটেটিভ রিসার্চ সম্ভব না, তবে কোয়ালিটেটিভ সম্ভব। আর এটার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, নিজে একটা স্যাটিরিক্যাল লেখা পোষ্ট করে প্রতিক্রিয়া দেখা, অনেকটা ফোকাসড গ্রুপ ডিসকাশান (এফজিডি) এর মতো। স্যাটিরিক্যাল লেখা এই জন্য যে, হিউমারাস লেখা তো সবাই বোঝে। দেখার বিষয় হলো অন্যটার কি অবস্থা!! ভাবনা তো ভাবলাম, সমস্যা হয়ে গেল অন্য জায়গায়। আমার ব্লগীয় বয়স প্রায় পাচ বছর। বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখেছি, ক্যাটাগোরিক্যালী দেখলে এক ডজনেরও বেশী হবে। তবে স্যাটায়ারধর্মী কোন লেখা দেয়া হয় নাই। এই ধরনের লেখা যদিও আমার খুবই পছন্দের, কিন্তু একই সঙ্গে এ'ধরনের লেখা আমার কাছে বরাবরই অত্যন্ত কঠিন মনে হয়। তাই ভয়ে ও'মুখো হই নাই কখনও।
সত্যি বলতে, ঠিক এই মূহুর্তে যতোটা মনে করতে পারছি; ব্লগার মিরোরডডলের সৌজন্যে ''মাহা'' নামে খ্যাত ব্লগার মা.হাসান, আর ''বনের রাজা'' হিসাবে খ্যাত ব্লগার টারজান ০০০৭ ছাড়া আর কারো এই ধরনের লেখা আমার মনে হয় চোখে পড়ে নাই। আরো অনেকে নিশ্চয়ই আছেন, কিন্তু মনে পড়ছে না। কেউ মনে করিয়ে দিলে বাধিত হতাম। মাহা'কে আজকাল হঠাৎ হঠাৎ ধুমকেতুর মতো যদিও বা দেখা যায়, বনের রাজা পুরাই নিখোজ! উনার একটা বিশেষ অঙ্গের প্রতি অত্যন্ত আসক্তি ছিল। সম্ভবতঃ বনের লতা-পাতা ধরে ঝুল খেতে গিয়ে সেটা খোয়া গিয়েছে, তাই খোজাখুজিতে ব্যস্ত; অন্যদিকে নজর দেয়ার সময় নাই। অথবা জেন-ঘটিত কোন সমস্যা হলেও হতে পারে!!
তো, আমার উদ্দেশ্য খোলাসা না করে একটা লেখা পোষ্ট করলাম, আল জাজিরার ফাসি চাই!!!। আমার কাছে পক্ষপাত-মুক্ত প্রতিক্রিয়া দেখার এটাই সবচেয়ে মোক্ষম উপায় বলে মনে হয়েছে। এটা লিখতে গিয়ে এবার প্র্যাকটিক্যালী টের পেয়েছি, এ'ধরনের লেখা গুছানো কতোটা কঠিন। আপনাদেরকে ফাইন্ডিংস নিয়ে কিছু কথা বলবো, তার আগে স্যাটায়ার আর হিউমার নিয়ে কিছু কথা বলে নেই।
সংজ্ঞানুযায়ী দেখতে গেলে, স্যাটায়ার হলো (উইকিডিফ) এমন একটা সাহিত্যের ধরন বা শিল্প যেটার উদ্দেশ্যই হলো এর সাবজেক্টকে সমালোচনা করা। তবে সেটা চিরাচরিত নিয়মে না করে সাহায্য নেয়া হয় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ কিংবা উপহাসের। বিশেষ করে সমসাময়িক রাজনীতি এবং অন্যান্য সাম্প্রতিক বিষয়াদি প্রসঙ্গে সাধারন বা সংশ্লিষ্ট লোকজনের ছাগলামীপূর্ণ কথা, কাজ বা আচরণের ব্যাপারগুলোই এই মাধ্যমে তীর্যকভাবে উঠে আসে। সোজা কথায়, সাবজেক্টকে জ্বালানো; আরো সোজা বাংলায় বললে, সাবজেক্টের গায়ে আগুন (আক্ষরিক অর্থ না) ধরিয়ে দেওয়া। যেহেতু এটাতে হিউমারের মিশেল থাকে, তাই এর প্রকাশভঙ্গির কারনেই মানুষ একে হিউমারের সাথে গুলিয়ে ফেলে। অপরদিকে হিউমার হলো অনেক স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড; এর মূল লক্ষ্যই হলো অডিয়েন্সকে বিশুদ্ধ বিনোদন দেয়া।
উদাহরন হিসাবে আমাদের সিনেমা জগতের কথা যদি বলি, একসময়ের কমেডিয়ান হাসমত, টেলি সামাদ, দিলদার, রবিউল প্রমুখদের নাম চলে আসবে সর্বাগ্রে। তবে উনারা কথার চাইতে অঙ্গভঙ্গি দিয়ে লোক হাসানোতে পারদর্শী ছিলেন। অবশ্য এটা ওনাদের সমস্যা ছিল না। উনাদেরকে পরিচালিতই করা হতো সেভাবে! আমাদের দেশে হুমায়ূন আহমেদই সর্বপ্রথম ডায়লগ দিয়ে দর্শক হাসানো শুরু করেন। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের সিনেমা জগত এখনও সেই গোলকধাধাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে, যেখানে বলিউড যোজন যোজন এগিয়ে গিয়েছে। ভিলেইন থেকে কমেডিয়ান বনে যাওয়া পরেশ রাওয়াল এর প্রকৃষ্ট উদাহরন। বৃটেনে মিস্টার বীনও হিউমার নিয়েই আছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, চার্লী চ্যাপলিন মূলতঃ নির্বাক চলচিত্র যুগের লোক ছিলেন, নয়তো হিউমারের সাথে সাথে স্যাটায়ারধর্মী কাজ করার অসাধারন ক্ষমতা উনার ছিল। তবে বর্তমানে আমেরিকায় বসবাসরত সাউথ আফ্রিকান স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান ট্রেভর নোয়াহ হলো আমার কাছে সমকালীন সবচেয়ে প্রতিভাবান স্যাটারিস্ট। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো; হিউমার সহজ-সরল এবং সরাসরি একটা ব্যাপার। কিন্তু স্যাটায়ার বুঝতে আপনাকে কনটেক্সট বুঝতে হবে। সে'জন্যেই ট্রেভর নোয়াহ যখন একটা কৌতুক বলে, পুরো অডিয়েন্স হাসিতে ফেটে পড়ে কিন্তু সে যখন বলে, ''ট্রাম্প আসলে ইমিগ্র্যান্টদের সাথে যুদ্ধ তার ঘর থেকেই শুরু করেছে…….'' তখন অডিয়েন্সের কিছু মানুষ কিন্তু হাসে না, কারন তারা এই কথার কনটেক্সটটা চট করে বুঝতে পারে না। কাজেই স্যাটায়ার বোঝার জন্য আলোচিত বিষয় সম্পর্কে ধারনা অর্থাৎ কনটেক্সট, এর সাথে বলা বা লেখার গভীরে প্রোথিত বা লুক্কায়িত যোগসূত্র বোঝা এবং সর্বোপরি, সেন্স অফ হিউমার; এই সবগুলোর যথাযথ ব্লেন্ডিং দরকার। এই সবগুলো যখন একসাথে আপনার মনের ভিতরে ক্লিক করবে, তখনই এবং কেবলমাত্র তখনই আপনি একটা স্যাটায়ারের আসল রস আস্বাদন করতে পারবেন। ব্যাপারটা পরিস্কার করতে পেরেছি? উদাহরন দিতে গেলে পোষ্ট অনেক বড় হয়ে যাবে।
আগেই বলেছি, হিউমারধর্মী সাহিত্য বা শিল্প শুধুই বিনোদনের জন্য। কিন্তু স্যাটায়ারের একটা বড় এবং প্রধানতম উদ্দেশ্য হলো, সামাজিক পরিবর্তন। এটা প্রভাবশালী ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা প্রতিষ্ঠানের দূর্বল বা অসুস্থ দিকগুলো নিয়ে মজা করার মাধ্যমে তাদেরকে পরিশোধিত করে তোলে। অবশ্য যাদের একেবারেই লজ্জা-শরম নাই, তাদের কথা ভিন্ন। তবে তারাও সমাজে উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেক সময়ে বাধ্য হয় পরিশেধিত কিংবা পরিশীলিত হতে। স্যাটায়ারের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো, এটা বিশাল আকারের টার্গেট অডিয়েন্সকে আকর্ষণ বা প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। তাই ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষ বা প্রতিষ্ঠানগুলো একে একেবারেই অবহেলা করতে পারে না। এটা একটা পরীক্ষিত সত্য।
সত্যি বলতে, আমার তথাকথিত স্যাটায়ারধর্মী পোষ্টের ফাইন্ডিংস খুব বেশী আশাব্যন্জক না। অনুভূতিটা মিশ্র! বিস্তারিততে যাবো না, তাছাড়া বেশী ডিটেইলসে গেলে পোষ্টও অনেক বড় হয়ে যাবে। তবে, সামগ্রিকভাবে ব্লগারদের মেধাশক্তি বিবেচনা করে আমার আশা অনেক বেশী ছিল। কিছু মন্তব্যে তো আমি দারুনভাবে হতাশ হয়েছি। মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্লগারদেরকে তিন ভাগে ভাগ করতে পারি।
কেউ কেউ বোঝেনই নাই যে, এটা একটা স্যাটায়ার। লেখার বিষয়বস্তুকে খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছেন। একটা উদাহরন দিলে সিরিয়াসনেসের মাত্রা বোঝা যাবে। মনে করেন আপনি বললেন, আমি কচুগাছে ঝুলে আত্মহত্যা করবো। শুনে একজন আৎকে উঠে বললো, ''না, না! এটা করবেন না। দূর্বল লোকেরাই আত্মহত্যা করে। জানেন তো, আত্মহত্যা মহাপাপ!!!'' এখানে কনটেক্সট হলো কচুগাছ। তবে হ্যা…...কেউ যদি কচুগাছ না চিনেন, আর এটাকে ঝুলে পড়ার মতো বৃহদাকার কোন গাছ ভেবে থাকেন, তাহলে আৎকে উঠতেই পারেন। সেটা ভিন্ন ব্যাপার। আরো বিষয় আছে, বিতং করে বলতে চাই না। অনেকে আবার মন খারাপ করতে পারেন। আমি আবার কারো দুঃখী চেহারা দেখতে পারি না!
কেউ কেউ এটাকে বিশুদ্ধ রম্যই ভেবেছেন। সেটা ঠিক আছে। কারন দিনশেষে স্যাটায়ারের একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো রম্য। এটা আমার কাছে অনেকটা হাটু পানিতে নেমে গোসল করার মতো। ডুব দিতে নাই বা পারলাম, অন্ততঃ গোসলটাতো হলো!!
তবে আশার কথা হলো, অনেকেই লেখার স্যাটিরিক টোনটা ধরতে পেরেছেন। তাদেরকে ধন্যবাদ। উনাদের ব্লেন্ডিংটা খুবই পরিপক্ক অবস্থায় আছে। তাদেরকে অনুরোধ, ব্লগার হিসাবে আপনারাও যেহেতু লিখতে পারেন, চমৎকার চমৎকার স্যাটায়ারধর্মী লেখা আমাদেরকে উপহার দিন। আসলে স্যাটায়ারধর্মী লেখা ব্লগে প্রচুর আসা উচিত। সাহিত্যের এই আকর্ষনীয় দিকটাকে ব্লগে বেশ খানিকটা অপাংতেয়ই মনে হচ্ছে। কারনটা সুপ্রিয় ব্লগারদের ভাবতে অনুরোধ করছি।
পরিশেষে বলি, আইরিশ লেখক জোনাথন সুইফ্ট এর স্যাটায়ারধর্মী গল্প 'গ্যালিভার্স ট্রাভেল' পড়েন নাই, এমন শিক্ষিত মানুষ এই পৃথিবীতে খুব কমই আছেন। তবে, আমার সবচেয়ে পছন্দের স্যাটারিস্ট হলেন জর্জ অরওয়েল। সম্ভব হলে, উনার ''এনিমেল ফার্ম'' বই অবলম্বন করে বানানো মুভিটা দেখতে পারেন।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া। ইংরেজ সাহিত্যিক এরিক আরথার ব্লেয়ার (ছদ্মনামঃ জর্জ অরওয়েল)।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:০৫