জাতীয়তাবাদ -গণতন্ত্র -খেলাফত
রোহিঙ্গা; পৃথিবীর সবচেয়ে
দুর্ভাগা জাতি। এদের ভাষা
বাংলা (চট্টগ্রামের ভাষা),
লিখিত বর্ণ আরবি, ধর্ম ইসলাম। এরা
আরাকানের বাসিন্দা। আরাকান
হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে
লাগোয়া মায়ানমারের একটা
রাজ্য। বৃটিশ আমলের শেষে ভারত
পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সময় এরা
পাকিস্তানের সাথে অন্তভূক্ত হতে
চেয়েছিল। অর্থ্যাৎ যদি তাই হত
তাহলে তারা সেই সময়ের পূর্ব
পাকিস্তান তথা আজকের
বাংলাদেশের নাগরিক হত। আর
বাংলাদেশ পেত আরাকান নামক
বিশাল ভূখন্ড। কিন্তু বৃটিশদের
খামখেয়ালি আর সেই সময়ের
পাকিস্থানের নেতাদের
অদূরদর্শিতার কারণে তারা
পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভূত না
হয়ে হয়েগেল বার্মার নাগরিক।
প্রথম প্রথম এরা বার্মাতে ভালই
ছিল। আরাকান থেকে অনেক
মুসলিম নেতা বার্মার সংসদ সদস্যও
নির্বাচিত হল। কিন্তু পরে সামরিক
সরকার এসে সব হিসাব পালটে
গেল। ভাষা, ধর্ম, গায়ের রঙ,
চেহারা অমিল থাকার কারণে
মায়ানমার তাদেরকে নাগরিক
হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার
করল। অথচ তারা পাঁচশত বছর যাবত এই
ভূখন্ডে বসবাস করছে। কেড়ে
নেওয়া হল তাদের সকল প্রকার
নাগরিক অধীকার। তারা ভোট
দিতে পারে না, সরকারি চাকরি
করতে পারে না, সরকারি
সুযোগসুবিধা পায় না, ব্যাবসা
করতে পারে না, বিনা অনুমতিতে
বিয়ে করতে পারে না, এমনকি
বাচ্চা নিতেও তাদের অনুমতি
লাগে, শিক্ষা চিকিৎসা সেবা
তো পায়না। এখানে তাদের উপর
নির্যাতন থেমে নেই, এরপর আরেক
ভয়ংকর খেলা। তাদেরকে শুধু
একঘরে করে রাখে ক্ষান্ত হয়নি,
এরপর শুরু হল আরেক ভয়ংকর খেলা।
ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদের খেলা। এই
উদ্দেশ্যে তাদের উপর চালানো হল
নির্যাতন, খুন, বাড়ি ঘরে
অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ ভয়ংকর সব
কার্যক্রম।
এই যখন অবস্থা তখন বাকিদের জীবন
বাঁচাতে রোহিঙ্গারা দলে দলে
সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মুসলিম দেশ
বাংলাদেশের প্রবেশের চেষ্টা
করল। কিন্তু তাদেরকে
বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হল
না। বাঁধা হয়ে দাঁড়াল
জাতীয়তাবাদ। কারণ তারা
বাংলাদেশী নই। রোহিঙ্গারা
বাংলা ভাষী, মুসলিম, আমাদের
মত শ্যাম বর্ণের হওয়ার পরও
বাংলাদেশে শরনার্থী হিসেবে
আশ্রয় পেলনা শুধুমাত্র
"বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী
তথা বাংলাদেশের নাগরিক না
হওয়ার কারণে। মজার কথা হচ্ছে
ঠিক একই অজুহাতে মানায়মার
সরকারও তাদেরকে তাদের দেশে
নাগরিক হিসেবে স্থান দিতে
নারাজ, কারণ তারা
বাংলাভাষী, মুসলিম ও তাদের মত
সাদা চামড়ার নয়।
এখন রোহিঙ্গাদের সামনে দুইটা
পথ,
এক. হয় নিজ ভূখন্ডে থেকে মগ তথা
বার্মিজদের হাতে মরা।
দুই. নতুন কোন দেশে প্রবেশের আশায়
সাগরে পাড়ি দেওয়া।
তারা যেহেতু "জাতীয়তাবাদের"
বাঁধার কারণে মুসলিম দেশ
বাংলাদেশ থেকে কোন রূপ
সাহায্য বা আশ্রয় পাচ্ছে না, তাই
তারা আর দুই ধনী মুসলিম দেশ
মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়
আশ্রয়ের আশায় নৌকায় চড়ে দলে
দলে সাগর পাড়ি দিচ্ছে। তারা
মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করে
থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার সীমান্ত
হয়ে। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের জঙ্গলে
তাদের উপর চালানো গণহত্যার
প্রমাণ পেয়ে আন্তর্জাতিক চাপে
থাই সরকার তাদেরকে আর প্রবেশ
করতে দিচ্ছে না। তাই তারা
সরাসরি পাড়ি জমাল
মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার
দিকে। কিন্তু হায় এই অসহায় মুসলিম
রোহিঙ্গাদেরকে তারাও গ্রহণ
করতে নারাজ। কারণ এখানেও
বাঁধা হয়ে দাঁড়াল
"জাতীয়তাবাদ"। এরা
মালয়েশিয়ান বা ইন্দোনেশিয়ান
নন। এরা রোহিঙ্গা। ফলশ্রুতিতে
কোন দেশে আশ্রয় না পেয়ে এই
অসহায় মুসলিমগুলো গত দুই সপ্তাহ
যাবত তাদের নৌকায় ভাসতেছে,
খাদ্য পানির অভাবে তারা মারা
যাচ্ছে। অনেকে নিজের মুত্র পান
করে এখনো বেঁচে আছে। অন্যদিকে
বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া,
মালয়েশিয়ার মুসলিমরা দামি
দামি রেস্টুরেন্টে বসে চিকেন
ফ্রাই চিবাচ্ছে। কারোর কোন
মাথা ব্যাথা নেই রোহিঙ্গাদের
ব্যাপারে। কারণ তারা মুসলিম
হওয়ার সত্ত্বেও একমাত্র
"জাতীয়তাবাদের" কারণ
আমাদেরকে বিভক্ত করে
রেখেছে। তাই আমরা চাইলেও
"ভিন্ন" এক জাতিকে সাহায্য
করতে পারছি না। আবার ভিন্ন
দেশের কোন নাগরিকের জন্য
"জাতীয়তাবাদীদের" মানবতাও
কাজ করে না।
অন্যদিকে বর্তমানে মায়ানমার
একটি গণতান্ত্রিক দেশ,
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ,
মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়াও
গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু গণতন্ত্রও
রোহিঙ্গাদের মুক্তি দিল না।
মায়ানমারের নেতা সুচি
রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ
খুলল না, কারণ তার ভয় হচ্ছে এর ফলে
বার্মিজ বৌদ্ধদের "ভোট" তার দিক
থেকে সরে যাবে। অন্যদিকে
বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও
ইন্দোনেশিয়া দেশগুলোর গণতন্ত্রও
নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য।
অন্যদেশের নাগরিকদের জন্য নয়। অন্য
দেশের কোন মুসলিম অনাহারে মরল,
নাকি নির্যাতনে মরল তা তাদের
ভাবনার বিষয় নয়।
সলিউশন আছে ইসলামিক
খেলাফতে। দুইটি ঘটনা বলি।
ওসমানী খেলাফতের সময় একবার
ফ্রান্সের এক নাট্যমঞ্চে আমার
নবীকে ব্যাঙ্গ করে একটা নাটক
মঞ্চস্থ করার আয়োজন করা হল। খবর
পেয়ে ওসমানী খলিফা ফ্রান্স
রাজাকে থামাতে বলে একটা
চিঠি দিলেন, ফ্রান্স সরকার
জবাবে বলব আমরা তা পারব না,
"এটা মত প্রকাশের স্বাধীনতা"।
পাল্টা জবাবে খলিফা বললেন,
যদি না থামাও তাহলে আমরা
জিহাদের আকবর (সবচেয়ে বড়
জিহাদ) ঘোষণা করব। ভয় পেয়ে
ফ্রান্স সরকার সেই নাটক থামিয়ে
দিল।
আরেকটা ঘটনা, ভারত বর্ষ মুসলিম
শাসনের সময় শাসকগণ ওসমানি
খলিফার আনুষ্ঠানিক অনুমতি
নিতেন। অনুমতি পেলেই তারা দেশ
পরিচালনা কার্য শুরু করত। একবার
দক্ষিণ ভারতের মুসলিম রাজ্যে
ইউরোপীয় বাহিনী হামলার
পরিকল্পনা করল, খবর পেয়ে ওসমানি
খলিফা বিশাল নৌবহর পাঠালেন।
ভয় পেয়ে এখানেও ইউরোপীয়রা
পালাল।
সুতরাং এখানে স্পষ্ট হয়েগেছে
মুসলিমদের মুক্তি জন্য অন্যতম বাঁধা
হয়ে আছে "জাতীয়তাবাদ" চেতনা
ও তথাকতি "গণতন্ত্র"। আজ যদি
খেলাফত থাকত তাহলে কি
বার্মার সাহস হত রোহিঙ্গা
মুসলিমদের মারার? আজ যদি
খেলাফত থাকত ইন্ডিয়ার কি সাহস
হত কাশ্মির, আসাম, গুজরাট,
হায়দারাবাদ, উত্তর প্রদেশের
মুসলিমদের মারার? আজ যদি
খেলাফত থাকত চীন উইগু মুসলিমদে,
রাশিয়া চেচনিয়া মুসলিমদে,
থাইল্যান্ড পাত্তানি মুসলিমদে,
ফিলিপাইন মিন্দানাও মুসলিমদের
মারতে পারত না। আমেরিকাও
সাহস পেত না দেশে দেশে
মুসলিমদের উপর গণ হত্যার চালানো।
আসলে আমরা মুসলিমরা
জাতীয়তাবাদ নামক কুড়ালের
আঘাতে বিভক্ত হয়েগেছি। এখন
কেউ যখন পাকিস্তানি মুসলিমদের
উপর আঘাত করে আমিরা বাঙ্গালী
মুসলিমরা খুশি হয়ে যাই, কেউ যখন
আফগান মুসলিমদের উপর হামলা করে
তখনও আমরা খুশি হই, কেউ যখন
ভারতীয় মুসলিম, রোহিঙ্গা মুসলিম,
ফিলিপাইন মুসলিম, চীনা মুসলিম
বা রাশিয়ান মুসলিমদের উপর
আঘাত করে তখনো আমাদের অনুভুতি
জাগে না, কারণ তারা তো
আমাদের দেশের নাগরিক নন। তাই
তা আমাদের মাথা ব্যাথার কারণও
নয়।
অথচ আল্লাহ এই পৃথিবী সৃষ্টি
করেছে মানুষের বসবাস করার জন্য।
অথচ আমরা মানুষ হয়েও
"জাতীয়তাবাদের" দেওয়ালের
কারণে অন্যদেশে নির্যাতিত
অসহায় মানুষগুলোকে আশ্রয় দিচ্ছি
না, পাশেও দাঁড়াচ্ছি না। আমরা
যারা নিজেদেরকে মুসলিম দাবি
করছি তাদেরকে স্মরণ করে দিয়ে
বলছি। মনে রাখবেন মৃত্যুর পর
আমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে-
১) তোমার রব কে?
২) তোমার নবী কে?
৩) তোমার দ্বীন কি?
সেখানে কিন্তু জিজ্ঞেস করবে
না-
১) তোমার জাতীয়তা কি?
২) তোমার আদর্শ কে?
৩) তোমার চেতনা কি