"যে স্বপ্নভঙ্গে ভয় পায় আদৌ তার স্বপ্ন দেখার কোন অধিকার নেই। মানুষের স্বপ্ন ও বিশ্বাস দু'টোই কাঁচের ন্যায় ভঙ্গুর। কাঁচ যেমন একবার ভেঙে গেলে জোড়া লাগেনা তেমনি বিশ্বাও জোড়া লাগেনা"
.....এরপর নীল পাতার রঙিন ডায়েরী জুড়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। কার রক্ত বোঝা যাচ্ছেনা। ডি-এনএ টেস্ট করালে বিষয়টা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে । আব্দুল হক সাহেব তার সোনালী ফ্রেমের চশমাটা পকেটের কোণায় রাখতে রাখতে পুলিশের সেকেন্ড অফিসারকে নির্দেশ দিলেন, বিষয়টা প্রথমে খুঁটিয়ে দেখতে। এতক্ষণে যেন অনুসন্ধানের কিছু সূত্র বের হলো, মনে মনে বললেন আব্দুল হক সাহেব। তিনি আর কালবিলম্ব না করে সঙ্গে করে আনা বাক্স-প্যাটরা নিয়ে স্টেশনের দিকে যাত্রা করলেন। একদম খাঁটি বাঙালীবাবু। পরনে ধবধবে সাদা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী। মুখে গজগজ করে চিবুচ্ছেন হাকিমপুড়ি জর্দা আর কাঁচা সুপাড়ি দেয়া মিষ্টি পান। পেছন পেছন সাত-আট বছরের এক ছোঁকড়া আসছে। পুলিশের সেকেন্ড অফিসার নন্দলাল বাবু পাঠিয়ে দিয়েছেন। ডায়েরীখানা পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে আব্দুল হক সাহেব দ্রুতগতিতে সামনের লাল-সাদা ট্রেন ধরার জন্য পথ চলছেন।
আব্দুল হক সাহেব। মাঝবয়স্ক হাসি-খুশি ভদ্রলোক। বিয়ে-শাদী এখনও করেননি তাই নিন্দুকেরা নপুংসক দাবী করেই খালাস। ভদ্রলোকের সেদিকে কোন খেয়াল নেই, আছেন তো বেশ। কয়েক কাঠা জমির উপর দোতলা বাড়ি, পুকুর, বাড়ির সামনে প্রকান্ড বাগান। আহ! কি স্বর্গসুধার মতই না তার প্রাত্যহিক জীবন। তার তিনকুলের সবাই যদি পাঁয়ের উপর পাঁ তুলে বসে খায় তবুও তার সম্পদ ফুরোবার নয়। বিয়ে-থা করলে তো তিনকুলে কেউ জন্মাবে!
বাপ-দাদা তার জন্মের আগেই ইহলোক ছেড়ে পরলোকে পাড়ি জন্মিয়েছেন। বাদ রইলো জেঠামশাই। জেঠা মশাইও বছরখানেক হলো মারা গিয়েছেন। জেঠিও স্বামীবিয়োগে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর কাছে গিয়েই পৌঁছুলেন। তার জেঠামশাইয়ের কোন সন্তান-সন্ততি ছিলোনা। সব মিলিয়ে আব্দুল হক সাহেবই এখন সর্বেসর্বা, তবুও কথায় আছেনা, সুখে থাকলে ভূতে কিলায়!
আব্দুল হক সাহেব বসে বসে অন্নধ্বংস মোটেও পছন্দ করেন না। তিনি তার রক্তে বার বার অ্যাড্রোনালিনের ছড়িয়ে পড়াটা উপভোগ করতে চান। যেমন— চার ক্যারট স্বর্ণ ডাকাতির অপরাধে অভিযুক্ত এক ব্যাক্তির অনুসন্ধানের নিমিত্তে তিনি আজ বাক্স-প্যাটরা নিয়ে চট্টগ্রামের বোয়ালখালি অঞ্চলের অভিমুখে চলছেন। লোকমুখে শুনেছেন কর্ণফুলী নদীর তীরঘেঁষে বোয়ালখালি এক অদ্ভুত নয়াভিরাম অঞ্চল। প্রায় সপ্তাহখানেক তিনি সেখানে অবস্থান করবেন। তাই, বাক্স-প্যাটরা বরাবরের মতনই অধিক ভারী। আধা শহর আর আধা গ্রামের মানুষগুলোকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অপরাধী নাকি খুবই চালাক প্রকৃতির। পুলিশকে দু'চারবার পঁচা ঘাটের পানি খাইয়েছে !
তিনি সপ্তাহখানেক চট্টগ্রামে অবস্থান করলেন। সেখানে থেকে তিনি মামলা-মোকদ্দমার যথাসম্ভব প্রমাণাদি সংগ্রহ করে তূর্ণা নিশিতা-ট্রেনযোগে রাত্রিবেলায় ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। পরদিন সকাল সকাল কাগজপত্র গুছিয়ে, সকল রিপোর্টাদি লিখে অফিসের বড়কর্তা জনাব টেকোন মিত্রের কাছে জমা দিয়ে দেন। আপাতত কয়েক ঘন্টার জন্য মুক্তি!
কেইস নাম্বার— চারশত এক।
আব্দুল হক সাহেব অফিস থেকে ট্রামযোগে বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যেই ইস্কুলজীবনের বন্ধু হরিলাল প্রসাদের সাথে দেখা। সকাল সকাল পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা বলে হরিলাল প্রসাদের বাড়িতে কিছু হালকা-পাতলা জলখাবার না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বে না। নিরুপায় হয়ে হরিলালের বাড়িতে যাওয়া। এদিকে, বেলাও সকাল গড়িয়ে দুপুর হওয়ার উপক্রম। বিদায় জানিয়ে পায়ে হেঁটে সপ্তাহখানেক আগের কেইসটা নিয়ে ভাবছেন।
সিলিং থেকে ঝুলে পড়া মেয়েটার মৃত লাশ। জিহ্বা প্রায় এক হাত বের হয়ে আছে। ভয়ঙ্কর এক অনুভূতি। রাত্রিবেলা ঘুমের মধ্যে কেউ যদি অমন দৃশ্য দেখে আত্মা ফেঁটে নিশ্চয়ই মরে যাবে। আত্মহত্যা নয়কি!
কিন্তু, আত্মহত্যা করার আগে বিছানার উপর অমন করে ডায়েরীর দু'শ চল্লিশ নাম্বার পাতায় লেখা কথাগুলো উল্টিয়ে রাখা হবে কেন?
আব্দুল হক সাহেব মেয়েটার বাড়ির আশে-পাশের পড়শীদের কিছু প্রশ্ন করার জন্য সেদিকে যাচ্ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন গ্রাম থেকে ফিরে তার হাঁটার গতি শহরতলির মানুষদের চেয়ে দ্রুত হয়ে গেছে। আহা কি গ্রাম! সবুজে ঘেরা সবুজ অরণ্যের গ্রাম। স্নিগ্ধ সকালের বিশুদ্ধ বাতাস। সকালের ঘুম ঘুম চোখে কমলা সূর্যের আবেশে মন ভাটির পানির মত শান্ত হয়ে আসে। ঝিরঝিরে হালকা ঠান্ডা বাতাস বয়। মাটির সোদা সোদা গন্ধ। ধানী জমি থেকে সাদা সাদা বক শো শো করে মাছ তুলে নিচ্ছে। ভোরসকালে খাটা-খাঁটুনি শেষে কৃষকরা বাবলা গাছের তলায় বসে গাঁয়ের ঘাম শুকোচ্ছে। কৃষকের বউ কিংবা ছোট ছোট বাচ্চারা টিফিনকারি বাটি আর পানির বোতল হাতে মাঠে আসছে এবেলায়। জমির আলে জন্মানো বৈতাশাকের ভাজি, তেঁতুলের রসের তরকারি, গুঁড়ো মাছ, আলুর চড়চড়ির তরকারি আর আমন ধানের লাল চালের গরম ভাত। সারা সকালের ক্লান্তি লাঘব করে দেয়। সন্ধ্যে অব্দি মাঠে থাকার শক্তি জোগায়। কৃষকরা মনের সুখে তাদের কাজ করে যায়। গৃহিণীরা নিজেদের বান্ধাবাড়ির পাশ ঘেঁষে বারমাসি ফল পেঁপে, পেঁয়ারা আর নারিকেল বাগান করেন। মধুর সে এক জীবন!
গ্রামের ফেলে আসা সুখময় কথা ভাবতে ভাবতে আব্দুল হক সাহেব হঠাৎ ময়লার স্তূপে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। বিদঘুটে গন্ধ আর পঁচা আবর্জনার আড্ডাখানা। পাশ থেকে কে যেন মুখ নামিয়ে বলে উঠলো, কি হে মশাই বিয়ে-থা তো করলেননা, জামা-কাপড়গুলো এখন কেচে দেবে কে ?
আব্দুল হক সাহেবও দমবার পাত্র নয়। ভদ্রলোকের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে আপনমনে সোনালী ফ্রেমের চশমাটা হাঁতড়াতে লাগলেন। মাছিগুলো পঁচার গন্ধে ভনভন করে নাকে-মুখে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। অবশেষে, কিছুক্ষণ ময়লা হাঁতড়ে চশমাটা পাওয়া গেল। চশমাটা চোখে দিয়ে আব্দুল হক সাহেব ময়লার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। কিছু পুরোনো পেপার-পত্রিকা, পঁচন ধরে যাওয়া ফল-মূল আর গৃহস্থালি সবজির উচ্ছিষ্ট অংশ। ময়লার আবর্জনার স্তূপে থাকা কয়েকটা বস্তুর উপর আব্দুল হক সাহেব দৃষ্টি সড়াতে পারছিলেন না। জার্মান ক্লোরোফর্ম আর একটা পরিষ্কার সিরিঞ্জ। অত্র পাড়ায় একটা হাসপাতাল আছে। সেটাও দশ ক্রোশ দূরে। অতএব, সিরিঞ্জগুলো এখানে ফেলার কোন হেতু নেই। কৌতূহলবশত আব্দুল হক সাহেব হাতে গ্লাভস পড়ে সিরিঞ্জ আর ক্লোরোফর্মের বোতলটা সঙ্গে নিয়ে মেয়েটার বাসার দিকে চললেন। মেয়েটার বাড়িতে একটু যাওয়া অতি প্রয়োজন। সেদিন অবশ্য খুনের আতঙ্কে পাড়া-মহল্লার কেউ মুখ খুলতে রাজি হয়নি। পুলিশের সেকেন্ড অফিসার নন্দলাল বাবুকে ফোন করে বলে দিয়েছেন তিনি ভিক্টিমের বাড়িতে যাচ্ছেন। নন্দলাল বাবু যেন অতি তাড়াতাড়ি উক্ত বাড়িতে চলে আসেন।
আব্দুল হক সাহেব গন্ধময় কাপড় পরিধান করেই তৃষ্ণা দেবীর বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পথিমধ্যে দামী পাঞ্জাবী আর পাদুকা ছেড়ে ধড়াচূড়ার মত বেশ ধরলেন। নেহাৎ অর্থ-সম্বলহীন গরীব না হলে যেটা হয়না। ধোপা বেঁচারাও একবার আব্দুল হক সাহেবের দিকে, আরেকবার কাপড়ের দিকে সন্দেহর দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরেই নন্দলাল বাবু এসে হাজির। আব্দুল হক সাহেবের এমন বিদঘুটে বেশ-ভূষা দেখে তিনি হেঁসেই গড়াগড়ি খাচ্ছেন। হাঁসি চেপে রেখে আব্দুল হক সাহেবকে গাড়িতে উঠতে বললেন। আব্দুল হক সাহেব তার কথায় আপত্তি জানালেন। রহস্য উদঘাটনে আয়েশ করলে চলে না। তিনি হেঁটে হেঁটে মফঃস্বলে ঢুকলেন। এক মধ্যবিত্ত বাড়িতে ক্ষুধার্ত পথিকের বেশে ঢুকলেন। গোলগাল মাঝবয়সী এক মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আব্দুল হক সাহেব এক প্লেট ভাতের জন্য খুব আকুতি-মিনতি করলেন যেন তিনি এক মাসের ভুখা মানুষ। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বরাবরের মতন অতিথীকে নারায়ণ বলে মান্য করে, আব্দুল হক সাহেবও সেই সুযোগটাই খুচ্ছিলেন। ভদ্রমহিলা তাকে ঘরের বাইরের বারান্দায় বসার জন্য আসন তৈরী করে দিলো, আব্দুল হক সাহেবও আয়েশ করে ভাত খাচ্ছেন—
'মাগো, শুনলাম এইখানে কিছুদিন আগে একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে'
"আত্মহত্যা না ছাই। পোড়ামুখি দূর হয়েছে মফঃস্বলের আপদ বিদেয় হয়েছে"
'কেনো গো মা, মানুষ যে সৃষ্টির সেরা জীব'
"ধূর ছাই"
'মেয়ের স্বভাবচরিত্র কি ভালো ছিলোনা ?'
"আপনি এত্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন কেন গো, ভাত খেতে এসছেন তাড়াতাড়ি খেয়ে বিদেয় হন"
'না গো মা, ঐ মেয়ের অতৃপ্ত আত্মা যদি আপনার বাড়ির চৌকাঠে পাঁ রাখে সংসারের কি হবে ভেবে দেখেছেন কি!'
"দূগ্গা, দূগ্গা ! মেয়ের চরিত্র কেলো ছিলো গো।
বিয়ে হয়নি অথচ পরপুরুষের সাথে ফষ্টি-নষ্টি "
'তা অবশ্যি, তা অবশ্যি '
"একটু আশীর্বাদ করে যাবেন দেখিনি, আমার সোনার সংসারে অমন যেন কুলক্ষণার দৃষ্টি না পরে "
'কুলক্ষণা?'
"কুলক্ষণা নয়তো কি, দিনে দুপুরে মর্দা মানুষের সাথে ঘষাঘষি, ফষ্টি-নষ্টি! রাত হলে আবার মোবাইলে কি সব ঘুস-ঘাস করে তা কি পাড়ার কেউ জানেনা নাকি!"
'দেবী মা তোমায় ডালা ভরে আশীর্বাদ করুক, আসি গো মা, তোমার সংসার সোনায় ভরে উঠুক'
আব্দুল হক সাহেব অতি দ্রুত উক্ত হিন্দু বাড়ি প্রস্থান করলেন। নন্দলাল বাবু আব্দুল হক সাহেবকে দেখে একগাল হেঁসে বললেন, দুপুরের ভোজ তো করেই নিলেন মশাই!
হ্যা, রিজিকের মালিক রাজ্জাক বলে মুচকি হেঁসে নন্দলাল বাবুর সাথে তিনিও পাঁ বাড়ালেন। মেয়েদের বাড়িটা অনেকটা দ্বিতল; উপরের চারটি ঘর, নীচে দুটি। বাড়িতে অধিক সদস্য না থাকায়, প্রত্যেকের সুবিধার নিমিত্তে আলাদা আলাদা ঘরে থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। বাবা-মা নিচ তলায়, মেয়ে আর মেয়ের ছোট ভাই গৌরাঙ্গ উপরের তলায়। নীচের একটি ঘরে রান্না ও অপরটিতে খাওয়া-দাওয়ার কাজ-কর্ম সম্পন্ন হতো। বাড়িতে চারু মাসি নামে একজন রান্না-বান্নার কাজ করে দিতেন। চারুমাসি রাত্রে বাড়িতে থাকেন না।
০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত্রিবেলায়, মেয়ে তৃষ্ণা দেবীকে অন্যান্য রাত্রির ন্যায় সবাই সুস্থ শরীরে আপন ঘরে সাজ-সজ্জায় ব্যাস্ত থাকতে দেখেছে। পরে সকালবেলা তৃষ্ণা দেবীকে ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে গৌরাঙ্গ উচ্চ চিৎকারে সবাইকে একত্রিত করে। পরে, উপস্থিত সকলের সঙ্গে পরামর্শ-মত পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ অনুসন্ধান করে সে ঘরে একটা লাল ডায়েরী বিনা আর কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। ডায়েরীটা অবশ্য
ইতিপূর্বে ঘরের কোন সদস্যবৃন্দই দেখেনি এমনকি শিশু গৌরাঙ্গও না। হত্যাকারীর এ পর্যন্ত কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি। আশ্চর্যের বিষয়, হত্যাগৃহের একটি সামান্য জিনিস কিংবা একটি কাজলের কৌটাও স্থানান্তর হয় নাই। ডায়েরীটি বর্তমানে আব্দুল হক সাহেবের তত্ত্বাবধানে আছে। ভালবাসার বিভিন্ন উক্তি, কথা, কবিতা সবকিছুই সুন্দরভাবে গুছিয়ে লেখা। গোটা গোটা অক্ষরে পরিষ্কার করে লেখা। চট্টগ্রামে থাকার সময় বেশ কয়েকবার কিছু পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখেছেন। দু'পক্ষের কথা-বার্তা সব লিপিবদ্ধ আছে। প্রতিটা সকাল, প্রতিটা দুপুর এবং প্রতিটা সেকেন্ডের কথোপকথন। আব্দুল হক সাহেব একটা জিনিষ ভেবে পেলেন না, পুরো ডায়েরী জুড়ে কোন মানব-মানবীর নাম নেই। এ কেমন করে সম্ভব?
চারদিন দেখতে দেখতে চলে গেল। ডায়েরী ছাড়া আর কোন তথ্যই আব্দুল হক সাহেবের কাছে ছিলো না। পঞ্চমদিন, সকালবেলায় ডাকযোগে কিছু নথিপত্রাদি পাওয়া গেল। তৃষ্ণা দেবীর পোষ্ট-মর্টেম রিপোর্ট আর জার্মান ক্লোরোফর্ম ও সিরিঞ্জের রিপোর্ট।
রিপোর্টগুলোর সারমর্ম হল— তৃষ্ণা দেবীর শরীরে প্রথমে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ধর্ষণ করা হয়েছে, এরপর হাতের শিরায় ফাঁকা সিরিঞ্জ পুঁশ করা হয়। ফলস্বরুপ রক্তে উচ্চ বায়ুচাপের ফলে হার্ট-অ্যাটাক অতঃপর তাকে সিলিং থেকে ফ্যানের সাথে দড়িতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। আব্দুল হক সাহেব কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ব্যাপারগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। প্রত্যেকটি ঘটনা চোখের সামনে ভাসমান করে দেখার চেষ্টা করেন। মৃত্যুর রহস্য বর্তমানে পরিষ্কার কিন্তু হত্যাকারী এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
আব্দুল হক সাহেব ময়লার স্তূপে কুড়িয়ে পাওয়া সিরিঞ্জগুলো নিয়ে মফঃস্বলের ঐ হাসপাতালে চলে গেলেন। তার জানামতে, জার্মান ক্লোরোফর্ম অতি উচ্চ মাত্রার ক্লোরোফর্ম । ডাক্তারী কিংবা সাধারণ কোন চিকিৎসায় বিশেষত এ ধরনের ক্লোরোফর্ম ব্যাবহৃত হয় না। ক্লোরোফর্মগুলোর প্রাচুর্যতাও খুব অল্প। চোর-ডাকাত কিংবা শহরের স্বনামধন্য স্মাগলাররা বিশেষ করে এ ধরনের ক্লোরোফর্ম সংগ্রহ করে থাকেন। অতএব, ক্লোরোফর্মটা কে কিনেছে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হলে অনুসন্ধানের রাস্তা সুপ্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাপস পাল। কপালটা উপরের দিকে বাড়তে বাড়তে বড়সড় একটা টাকের চেহেরা নিয়েছে। বয়সের ভারে চামড়াগুলো ঢিলে হয়ে গেছে। দু'কানের কাছে এক খাবলা চুল। কাঁচা-পাকা চুল। নাকটা সাধারণের তুলনায় একটু বড়সড়। চোখে গোল গোল মোটা ফ্রেমের চশমা। তার উপরেই কপালের কাছে তিন-চারটে ভাঁজ। মফঃস্বলের একমাত্র ডিসপেনসারি খুলে বসেছেন। চেহেরা দেখে মোটেও মানুষ হয়না, অশরীরি অশরীরি একটা ভাব রয়েছে।
সাধারণ বেশ-ভূষায় দোকানে প্রবেশ করলেন আব্দুল হক সাহেব। 'নমস্কার, দাদাবাবু। কাছের কোন জায়গায় নাকি কয়েকদিন আগে লাশ পাওয়া গেছে!'
"তা বৈকি"
'মফঃস্বলটা একদম গেল'
"মশাই মফঃস্বলটা পাগলের আড্ডাখানা ছিল,বলুন আপদ গেল "
'কেন বলুন তো'
মশাই আপনি কে বলেন তো, এত প্রশ্ন করছেন। আব্দুল হক সাহেব তার আইডি কার্ডটা খানিক উঁচিয়ে বললেন—
'ডিটেক্টিভ হক।'
"নমস্কার, নমস্কার মশাই। আসুন, ভেতরে আসুন, কি করতে পারি আপনার জন্য!"
'করার তো অনেক কিছুই আছে তবে একটা জিনিষের প্রয়োজন ছিল'
"বলুন,মশাই। আপনাদের সেবায় তো আমরা সদা প্রস্তুত"
'আচ্ছা, মশাই। জার্মান ক্লোরোফর্ম পাওয়া যাবে?'
"দেখুন মশাই, জার্মান ক্লোরোফর্ম তো দূষ্প্রাপ্য বস্তু। যদি বলেন তবে এনে দিতে পারি"
'হুমম। আচ্ছা, কোন ভদ্রলোক এর আগে কি এখান থেকে জার্মান ক্লোরোফর্ম নিয়েছে ?'
দোকানদার তাপস পালের মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুঁটে উঠলো। চোখ-মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। আব্দুল হক সাহেব গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলে উঠলেন— কি হে, মশাই বলুন না কেউ কি নিয়েছে?
দোকানের ভিতরে বড় স্ট্যান্ড ফ্যান গটগট শব্দ করে চলছে। ঝড়ো বাতাসের মাঝেও দোকানদার ঘামছে, ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগলো আব্দুল হক সাহেবের। তিনি রীতিমত তাকে শাঁসিয়ে উঠলেন—
‘দেখুন মশাই, মফঃস্বলের আপনারা সকলেই অতি বিদ্বান ও বুদ্ধিমান। অবশ্য বুঝতে পারছেন, এ হত্যার কূল-কিনারা করা বড় সহজসাধ্য নয়। কেউ অর্থলোভে কিংবা ঈর্ষামূলে নয়তো পাপকর্ম নিবারণ করতে এ
লোমহর্ষক হত্যার নৃশংস কাণ্ড সম্পন্ন করেছে। অবস্থা পর্যবেক্ষণে, এমন বিশ্বাস এখনো করতে পারছি না। এক্ষণে যদি আমি মৃত ব্যক্তির সম্পর্কের কথা অবগত হইতে না পারি, তবে প্রকৃত দোষীর অনুসন্ধান কিরূপে করতে সমর্থ হব? আর অবশ্য এটাও আপনারা বুঝতে পারছেন, যদি কোন প্রকারে এ লোমহর্ষক হত্যার কূলকিনারা করা না যায়, তবে পুলিশ শেষকালে আপনাদের নিয়েই টানাহিঁচড়া করতে পারে। কে জানে আপনারা কেউ যে এ ব্যাপারে বিজড়িত নন? মেয়েলি ব্যাপার তার মাঝে পুরো মফঃস্বল নিশ্চুপ!
তাপস পালের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে জড়িয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন,
"দেখুন দাদা, আমি এই ব্যাপারে কিছুই জানিনা। আমি নির্দোষ। আপনার দু'জন ভাগ্নে-ভাগ্নী আছে, তাদের কথা চিন্তা করুন, দয়া করুন এ গরীবের উপর।"
'আহা! এত বিচলিত হচ্ছেন কেন ?আপনাকে তো কেউ বলেনি যে আপনিই হত্যা করেছেন। আপনাকে যেমন যেমন করতে বলছি তেমন তেমন করুন না, ল্যাটা চুঁকে যাবে। '
"জ্বি দাদা বলছি বলছি,
সেদিন ছিল শনিবার। ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বেলা শেষ হয়ে এলো বলে দোকান বন্ধ করার তড়িঘড়ি করছিলাম। সেদিন বাতের বেদনাটাও একটু বাড়ছিলো। এমন সময় মাঝবয়সী একজন হৃদপুষ্ট ছেলে এসে জার্মান ক্লোরোফর্মের খোঁজ করলো। হাতে চার-পাঁচটে শতের নোটও গুঁজে দিলো। অনেকদিন বিক্রি-বাট্টা হয়না দেখে আমার মন-মেজাজটাও দাদা ভালো ছিল না। তাই, এনে দিয়েছিলাম! দাদা, আমাকে মাফ করে দিন। অমন কাজ আর কোনদিনও করবোনা। "
'সে বুঝলাম, ছোঁকড়ার নাম কি তোমার মনে আছে?'
"না বৈকি, মাঝে মাঝে মঞ্জিলের রাস্তার মোড়ে দেখা যায়। মশাই, খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন"
' চলুন তাহলে, আমি যে এসেছিলাম একথা পাঁচকান যেন না হয়, নয়তো চৌদ্দ-শিকের ভিতরে বুঝেছেন মশাই, নমস্কার !'
আব্দুল হক সাহেব নন্দলাল বাবুকে পুরো পুলিশ ফোর্স নিয়ে মঞ্জিলের রাস্তার মোড়ে চলে আসতে বললেন। বুড়ো তাপস পালের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। আব্দুল হক সাহেব গাড়ি থেকে নেমে বাইরে একটা ক্যাপস্টন সিগারেট রোল করে ঠোঁটে ধরালেন। নিকোটিনের মাদকতাময় অদ্ভুত তেতো স্বাদ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ট্রলি ব্যাগসমেত একজন তরুণের দেখা পাওয়া গেল। কোথাও যাচ্ছে মনে হচ্ছে বিশেষ করে স্টেশনের অভিমুখে। কারন, রাস্তাটা সোজা রেললাইন চলে গেছে। তাপস পাল মুখ নামিয়ে বললো, মশাই লাল ট্রাভেল ব্যাগওয়ালা ছেলেটাই সেদিন সিরিঞ্জ আর জার্মান ক্লোরোফর্ম খরিদ করেছিল।
তাপস পালের কথা শুনা মাত্র আব্দুল হক সাহেব পাগলা ঘোড়ার ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন মাঝবয়সী তরুণের উপর। আব্দুল হক সাহেবের কথা ও ভাবভঙ্গি দেখে জামসেদ নামের ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে আব্দুল হক সাহেবের দিকে তাঁকিয়ে রইলো।
কিছুক্ষণ ঝাপ্টা-ঝাপ্টি করে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছিলো কিন্তু পুলিশের হস্তক্ষেপে তা আর হয়ে উঠলো না। তখন আব্দুল হক সাহেব হাতের মুষ্টি দৃঢ়তর করে, মুখের চোয়াল শক্ত করে দোষীকে বললেন,
'তোমার সে চেষ্টা বৃথা জামসেদ; তুমি তৃষ্ণা দেবীর হত্যাকারী, তোমাকে এখন গ্রেপ্তার
করা হলো।’
পুলিশের সেকেন্ড অফিসার নন্দলাল বাবু বিজয়ীর বেশে আব্দুল হক সাহেবের দিকে তাকালেন। আব্দুল হক সাহেব মুচকি হেঁসে তাঁকে বললো, আপনি আসামীকে নিয়ে থানায় চলুন। জামসেদ পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে একেবারে দমে গেল। আব্দুল হক সাহেব এরপর জামসেদকে লক্ষ্য করে পুনর্বার বললেন, দেখো জামসেদ, আমি সমস্তই জানতে পেরেছি, তুমি স্বহস্তে তৃষ্ণা দেবীকে হত্যা করেছো। এ বিষয়ের সমস্ত নথিপত্র ও প্রমাণাদি আমার সংগ্রহে আছে। বর্তমানে ভনিতা বন্ধ করে থানার দিকে চলো। জামসেদের জীর্ণ চেহেরায় ক্রমেই তার দোষের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো।
অতএব,আব্দুল হক সাহেব তাকে তৃতীয়বার জিজ্ঞাসা করলেন, জামসেদ তুমি এখন কি বলতে বা করতে চাও? তুমি কি নিজের দোষ স্বীকার করে নিবে?
সে কাঁদো কাঁদো স্বরে উত্তর দিল, 'স্যার, আমার আর কিছুই বলার বা করবার নেই। আমি এখন বন্দি। পাপ সত্যিই বাপকেও ছাড়েনা। কোন পাপই কখনো গোপনে থাকে না। পাপের ফল অবশ্যই প্রত্যেককে ভুগতে হবে; চলুন, আমাকে
কোথায় যেতে হবে।'
আব্দুল হক সাহেব বললেন, 'তুমি তৃষ্ণার হত্যাপরাধ স্বীকার করছো?’
জামসেদ মাথা নিঁচু করে উত্তর দিল, ‘আর মিথ্যে বলবো না; হ্যা, আমিই। আমিই হত্যা
করেছি তৃষ্ণা দেবীকে।'
জামসেদের ছোট্ট একটা জবানবন্দী মতে,
জামসেদ শহরে একজন বেসরকারি চাকুরে। মাঝেমাঝে মফঃস্বলে বেড়াতে আসে। একদিন বিকেল বেলা তৃষ্ণা দেবীকে দেখে তার খুব ভালো লাগে। হিন্দু বন্ধু শুভ চন্ডির মাধ্যমে জামসেদ ও তৃষ্ণা দেবী সম্পর্ক স্থাপন করে। জামসেদ তৃষ্ণা দেবী নামে অজ্ঞান ছিলো। একদিন তৃষ্ণা দেবীর মোবাইলে জনকয়েক তরুণের মোবাইল নাম্বারের সন্ধান পাওয়া যায়। জামসেদ বড় ধরনের এক ধাক্কাপ্রাপ্ত হয়। তৃষ্ণা দেবী প্রায়ই জামসেদকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে থাকে। জামসেদের নিকটও তৃষ্ণা দেবীর মুখোশ উন্মোচিত হতে থাকে। মৌখিক হিসেব মতে তৃষ্ণা দেবী প্রতি মাসে, তার হাতখরচ বাবদ জামসেদের নিকট হতে ফুসলিয়ে-ফাসলিয়ে ত্রিশ হাজার টাকার মত বের করে নেয়। এমনি একদিন, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ তারিখে রাত করে বাড়ি ফেরার পথে জামসেদ অন্ধকারে তৃষ্ণা দেবী ও পাড়ার অন্য একজন ছেলের অন্তরঙ্গ দৃশ্য দেখে ফেলে। এরপর, জামসেদ ও তার বন্ধু শুভ চন্ডী যুক্তি করে ঘটনার দিন ছাদ পেরিয়ে তৃষ্ণা দেবীর বারান্দায় পৌঁছায়। শুভ চন্ডী ঘরের যে কোন খিল খোলার কাজে অতীব পারদর্শী। ডায়েরীটা জামসেদেরই ছিল। অনুসন্ধানের কাজে ধুলো দেওয়ার নিমিত্তে এই কাজ করা হয়। অবশেষে, লোমহর্ষক এক হত্যাকান্ড!
দীর্ঘক্ষণ এইরূপে জামসেদের জবানবন্দী নেওয়া সমাপ্ত হলে আব্দুুল হক সাহেব ও নন্দলাল বাবু তাকে থানায় নিয়ে চললেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য, এই জেদবশত লোমহর্ষক নারী হত্যাকান্ড মোকোদ্দমা দায়রা জজের কাছে সোপার্দ হয়। দায়রায়, জজ সাহেব ও সম্মানিত জুরির বিচারে, মোঃ জামসেদ ভূইয়্যার যাবৎজীবন দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত হয়। সেই সাথে আব্দুল হক সাহেবের চারশত এক নাম্বার কেইসের ফাইলও বন্ধ হয়।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১২:৪৫