শেষরাতের দিকে জাহিদের এখন প্রায়ই ঘুম ভেঙে যায়। ইদানিং ঘুমের ঘোরে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখে। অসংখ্য লোক কালো পোশাক পরে জাহিদকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মাটিতে একটা তারাজাতীয় পেন্টাকল আঁকা।(পেন্টাকলের চিত্রটা জাহিদ অবশ্য হলিউড সিনেমায় দেখেছে)
সেটাকে আবার ঘিরে রেখেছে বড় আকৃতির একটা বৃত্ত। সবাই অদ্ভুত একঘেয়ে সুরে গুণগুণ করে 'হোম' 'হোম' সুরে মাতম তুলছে। মিচমিচে কিছু কালো বড় বড় কুকুরও মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। জিহ্বাটা লকলক করছে, কুকুরগুলোর চোখ থেকে নীলচে আভায় আলো জ্বলছে ।
তারাটার ঠিক মাঝখানটায় জাহিদ নিজেকে আবিষ্কার করলো, সম্পূর্ণ নেংটো অবস্থায়।
গায়ে একটা সুতো পরিমাণ কাপড়ও নেই। জাহিদ ছিটকে উঠলো, ঘুম তাঁর চোখ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই পগারপার!
রাত্রিবেলায় একবার ঘুম ভাঙলে তা এত সহজে ফিরে আসেনা। অগত্যা জাহিদ, বিছানা ছেড়ে মেট্রোপলিটন হাসাপাতালের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। মাঝরাতে একদম খোলা রাস্তায় হাঁটতে এক অন্যরকম আনন্দ অনুভব হয়। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় টং এর দোকান দেখে জাহিদ চা-সিগারেট খেতে বসে পড়ে।
অনেকক্ষণ ধরে পাশের লোকটা নিষ্পলকভাবে জাহিদের দিকে তাঁকিয়ে আছে।
'উহহহু? এখানে নতুন নাকি?' নতুন দেখা লোকটাকে নির্লিপ্তভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় জাহিদ। অন্ধকারে লোকটার চেহেরা বোঝা যাচ্ছেনা। লোকটার মাঝে ভদ্রতার খানিকটা অভাব আছে। সিগারেট চেয়ে নিয়েছে ভালো কথা। দেয়াশলাইও নিয়েছে মানলাম। কিন্তু, সিগারেট জ্বালিয়ে দেয়াশলাই ফেরত দেবার নাম নেই। নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছে। এটা তো সহ্য করা যায় না।
"নাহ-গতকাল কেবল মাত্র অপারেশন হয়েছে। এখন অবস্থা খুবই শোচনীয়। সময়-গময় নাই যে কোন সময় চলে যেতে পারি ওপারে”-বলেই একগাল ধোঁয়া ছাড়লো
অচেনা লোকটা।
'আমি জাহিদুল ইসলাম। আপনি?'
"আমি সুমন- চাপাতি সুমন ”
'চাপাতি সুমন !'
"জ্বি- আমিই চাপাতি সুমন। পাড়ার ছিচঁড়ে মাস্তান থেকে সোজা সন্ত্রাসী লিস্টে। একসময় হটাৎ করেই উঠে এসেছিলাম পুলিশের খাতায়। এখনো আছি। পুলিশ এখনো আমার এই অবস্থার কথা জানেনা। জানেনা আমার দলের ছেলেপেলেও।
অচেনা লোকটা গরগর করে নিজের ইতিহাস বলতে শুরু করলো, সেদিন সন্ধ্যেবেলা আমাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। বুঝেছেন, একটা গার্মেন্টস এর মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম। শত্রু পার্টির কাছ থেকে টাকা খেয়ে শালীর বেটি (মহিলা) শত্রুদেরকে আমার সেইফ হাউজের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে। ফলাফল আমাকে ইচ্ছে মত কুপিয়েছে। এখন এই অবস্থা...
মরে গেলে আর সবাই জানবে বলে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সিগারেটটা টানতে লাগল চাপাতি সুমন। জাহিদ লক্ষ্য করলো খুব স্বাভাবিক চেহেরার আড়ালেই তার দগ্ধ হৃদয়টা ফুটে উঠছেনা।
শহরের নামকরা দাগী আসামীর সাথে এখন জাহিদ কথা বলছি, ভাবতেই অবাক লাগছে। জাহিদ ভয়ভীতি ভুলে মুখ ফসকে বলে ফেললো,
'আপনাকে আমি চিনি'
"আমাকে চিনেনা এমন ক'জনই আছে বলেন"
'একবার আপনি আমার মানিব্যাগ চুরি করেছিলেন'
" সে আর নতুন কি "
'আপনার এ খারাপ কাজগুলো করতে খারাপ লাগেনা '
" বড়লোকরা ঘুষ খায় তাদের কি খারাপ লাগে..? "
একপ্রকার বিরক্তিভরা মেজাজ নিয়ে জাহিদ তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। মানুষটা অদ্ভুত রকমের ভয়ংকর। এরকম মানুষ থেকে মুরুব্বী প্রজাতি বরাবরই দূরে থাকার প্রেরণা দিয়ে এসেছেন। জাহিদ আবার কম যায় কিসের। ছোটবেলা থেকেই সকলে যেটা মানা করতো; জাহিদ সেটাই বেশি বেশি করতাম। অচেনা অদ্ভুত লোকটা অবশ্য মেট্রোপলিটনের হাসাপাতালটায় থাকতো।
রাত্রিবেলায় ঘুম না আসলে প্রায়সময়ই জাহিদ হাঁটতে হাঁটতে ওদিকেই
চলে যেতো । একেকজনের আলাদা আলাদা নেশা বলে কথা। কারো আছে মেয়ে-নেশা, কারো আবার চা-সিগারেটের এইতো। জাহিদের ঘুম না আসলে মারাত্মকভাবে চায়ের নেশা পেয়ে ধরতো।
সকালে উঠেই আবার ভার্সিটিতে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা প্রয়োজন। জাহিদ দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরে এল। জাহিদের শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে তাই, রূমে এসে সোজা গোসল করতে ঢুকলো। হালকা গরম পানিতে ফ্রেশ হওয়ার পর, জাহিদের মনে হল, ঘুমটা আবার চোখ থেকে উধাও। তাই, সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে ইউটিউবে একটু চোখ রাখলো। কাল্ট অফ বেলিয়ালদের উপর অ্যানোনিমাসরা একটা ডকুমেন্টারি আপলোড করেছে।
কাল্ট অফ বেলিয়াল অনেক প্রাচীন একটা ধর্ম।"সেভেন্টি টু স্পিরিটিস অব সলেমোন" হলো এমন বাহাত্তরটা শয়তান যাদের,রাজা সলেমোন একটা পিতলের কলসিতে আবদ্ধ করে পানিতে ফেলে দিয়েছিলেন।এদের মধ্যে সবচেয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলো "বেলিয়াল"। তবে নরকের সাত রাজপুত্রের কিংবা সবচেয়ে শক্তিশালী সাত শয়তানের
লিস্টে বেলিয়ালের নাম নেই!! এর কারন অনেকেই বলে থাকেন যে বেলিয়াল হলো
লর্ড লুসিফারেরই আরেক নাম।
কাল্ট অফ বেলিয়ালের জন্ম হয়েছিল ব্যাবিলনে।এখানে বেলিয়ালের উপাসনা করা হতো ।বিভিন্ন প্রকার রিচ্যুয়াল দিয়ে সাজানো ছিল এই ধর্ম।মামলূক সুলতান "রোকনুদ্দীন বাইবার্স" এর সময় পর্যন্ত সুদানী কিছু গোত্রের ভিতরে টিকে ছিল এই ধর্ম। এই ধর্মের একটি প্রধান রিচ্যুয়াল ছিল নারীবলি আর নারী অপহরন।অপহরনের পর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে বেলিয়ালের নামে বলি দেওয়া হতো।আর বাকী মেয়েদের একটা ফুলের ঘ্রাণ নেওয়ানো হত যার ফলে তাঁরা সব ভুলে গিয়ে উপাসনা করা পুরুষদের সাথেই বসবাস করত।
পৃথিবীর বুকে শয়তানপূজারীদের স্থান কোথাও ছিলোনা আর এরা বারবার পর্যদুস্ত হয়ে এসেছে। তাঁরা কখনো সফল হয়নি। সর্বপ্রথম এদের বিরুদ্ধে অভিযান
চালান সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।তিনি তাদের এলাকাগুলো দখল করে নেন।এরপর এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লোক ইসলাম গ্রহন করে।বাকীরা গোপনে নিজেদের কাল্ট চালিয়ে যায়। এরা ক্রুসেডারদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে নিজেদের গ্রামগুলো
ফিরে পাবার জন্য কিন্তু "শয়তান উপাসক"
আখ্যা দিয়ে ক্রুসেডাররা তাদের সাহায্য করেনা। মোঙ্গলরা বাগদাদ জয়ের পর এদের সাহায্য করতে রাজী হয়।হালাকু খানের সেনাপতি কিতবুগা এদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন কিন্তু মামলুক সুলতান "বাইবার্স" এর কাছে মোঙ্গলরা পরাজিত এবং কিতবুগা নিহত হন। এরপর বাইবার্স এদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারন করে এদের নির্মুল করে। এভাবেই কাল্ট অফ বেলিয়ালের সমাপ্তি ঘটে।
ডকুমেন্টারিটা দেখে জাহিদ নিজেকেই ধিক্কার দিতে লাগলো। কি সব আলতু ফালতু জিনিষ ! শুধু শুধু মেগাবাইটগুলো নষ্ট। আশ্চর্যজনক ব্যাপারটা ছিলো, এতক্ষণ জাহিদের পিছনে একজন দাঁড়িয়ে ছিলো অথচ জাহিদ বুঝতেই পারেনি।
আদৌ মানুষ ছিল কি না তা নিয়ে সন্দেহের ফুল ফুঁটেছে জাহিদের মনে। ডকুমেন্টারি দেখে শেষ করার পর জাহিদ আড়মোড়া দিয়ে পেছনে ঘুরতেই জাহিদের মনে হল, কেউ একজন দরজা দিয়ে মাত্র বেরিয়ে গেলো। কিন্তু, তা তো হবার কথা নয়। মা-বাবা সকলেই ঘরে ঢুকার আগে একবার নক করে ঢুকে। এ সময় অবশ্য সবাই ঘুমে বিভোর। জাহিদ উঠে সবার ঘর দেখে আসলো। সবাই নিভৃতে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।
শেষরাতের ঘটনার পর সামান্যতম কোন সংশয় জাহিদের মনে ছিলোনা। সারাদিন ক্লাস, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে সময় পার হয়ে গেছে। রাত্রে পড়তে বসার সময় স্বপ্নটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো,
পুরো ঘটনাটা কি স্বপ্ন ছিল?
রাতে হঠাৎ দাড়োয়ান চাচা এলেন জাহিদের ঘরে। দাঁড়ি-গোঁফ মিলে একাকার অবস্থা। জাহিদকে জড়িয়ে ধরলেন। দাড়োয়ান চাচার এ ব্যাবহারে জাহিদ কিছুটা বিস্মিত হয়ে যায়। জাহিদের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়,
'আচ্ছা, দাড়োয়ান চাচা কি হচ্ছে আসলে?'
"বাবা, তুমি সবার থেকে স্পেশাল। স্বপ্নের কুকুরগুলো তোমার গার্ডিয়ান। তোমায় কিচ্ছু হতে দেবে না ওরা।"
আশ্চর্য! দাড়োয়ান চাচাকে কিছু বলতে হলোনা, ওনি এত সহজে কিভাবে জানলেন এতসবকিছু ?জাহিদ নিজে নিজেকে প্রশ্ন করলো, আমিইবা সবার থেকে স্পেশাল কেন!
বাবা, তুমি চিন্তা করোনা। তোমার সাথে আমরা অনেকেই আছি যারা তোমার কোন
ক্ষতি হতে দেবে না। জাহিদ অবাক চোখে তাঁকিয়ে থাকে, দাড়োয়ান চাচার হাসি হাসি মুখ আর জ্বলজ্বলে চোখ। জাহিদের ভেতরে কেমন করে যেন ভয়ের গাছটা ডাল-পালা মেলে বড় হতে থাকে। কয়েকদিন এভাবেই কেটে যায়। জাহিদ আবার সব ভুলে কলেজে
যাওয়া শুরু করে। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবেই চলতে শুরু করে। বাবা-মার মাঝেও লেখা-পড়া নিয়ে জাহিদ কোন উদ্বেগের চিহ্ন দেখতে পায়না।
সেদিন লিটারেচার ক্লাস নেওয়ার সময় ম্যাম সবাইকে চমকে দেয়। ম্যাম না ঠিক 'মিস' বলাই শ্রেয়। পেটের নিচে শাড়ি পরে যে তাঁর নগ্ন নাভি দেখিয়ে পুরুষ প্রজাতিকে পাগল করে ফেলে তাঁকে ম্যাম বলা চলেনা। মিস সেদিন বলতে থাকে-
"তোমাদের সবার জন্য আজ চমৎকার এক সারপ্রাইজ আছে "।
সবাই মিসের দিকে উৎসুক চোখে তাঁকায়। ক্লাসের ত্যাদড় ছেলেগুলো কানা-ঘুসা করতে থাকে আজ কি ব্রেসিয়ার খুলে কোনকিছু দেখাবে নাকি !
মিস মুখ নামিয়ে খুব ঠান্ডা গলায় ভ্রু নাঁচিয়ে সবাইকে কঠিনস্বরে প্রশ্ন করে,
"প্যাগানিজম নিয়ে কি কিছু জানো তোমরা?"
ক্লাসের সবার মুখে এক নতুন অনুভূতি বিরাজ করছিলো। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই মুখ শুকনো করে বসে থাকে। মিস বলতে শুরু করে,
প্যাগানিজম আর খ্রিস্টধর্ম একে অপরের সাথে কিছুটা জড়িত। প্যাগানিজম হল একেশ্বরবাদকে সম্পূর্ণ বিরোধীতা করা । আর, এই প্যাগানিজমে যারা বিশ্বাস করে তাঁদের বলা হয় পেগান । এরা যে কোন শক্তিকেই তাদের প্রভু হিসেবে বিশ্বাস করে । অবশ্য, এরা বহু-ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলেও এদের
ঈশ্বরদের কিন্তু সনাতন ধর্মের মানে, হিন্দুদের দেবতাদের মত কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই । পেগানরা ক্ষণে ক্ষণে তাদের ঈশ্বর পাল্টে ফেলতো । যখন যা তাদের প্রভাবিত করছে
সেটাকেই তারা দেবতা বলে মেনে নিত । কারণটা সহজ, ওরা পাগল ছিল না । তবে ওদের ধারণা ছিলো, ঈশ্বর নিজেকে পাল্টে ফেলেন তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী। এজন্যই অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ওরা দিত তাদের প্রয়োজনে আসা সব প্রভাব রাখার মত বস্তুকেই ।
সেদিনের মত ক্লাস শেষ হলো।মিসের কথার আগা-মাথা কেউ বুঝলো না।তবুও, সেশনাল মার্কসের কথা মাথায় রেখে, সবাই মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে এমন ভাব দেখালো যেন মনে হয়, সবকিছু বুঝে উল্টিয়ে ফেলেছে। জাহিদের কাছে ব্যাপারগুলো মাথার উপর দিয়ে গেল।
রাতে প্রতিদিনকার মতো হঠাৎ করেই ঘুম ভাঙলো জাহিদের। আজ শব্দগুলো খুব স্পষ্ট মনে হচ্ছে। জাহিদ তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন। জাহিদ ঘুমকাতুর চোখে চারপাশটা দেখে বুঝলো, এটা তাঁর শোবার ঘর নয়। জাহিদ আস্তে করে বললো,
"মা...মা। বাবা...বা "
জাহিদ হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো। তাঁর পুরো শরীর বাঁধা। ফ্লেক্সিকাফ দিয়ে হাত-পা বাঁধা। পুরো নগ্ন শরীর। জাহিদ চারপাশে তাঁকিয়ে দেখলো, অন্ধকারে একটা লোক মেঝেতে উপুর হয়ে পড়ে আছে।
"এখন কেমন আছো তুমি"- বুঝলাম সব দাড়োয়ান চাচার কাজ।
'আমরা কোথায় আছি চাচা?'-জাহিদ আতংকের সুরে জিঙ্গেস করলো।
"তোমার জন্য বিগ সারপ্রাইজ আছে ।"
'সারপ্রাইজ। ভালো কথা কিন্তু আমার হাত-পা বাঁধা কেনো?'
"একটু ধৈর্য ধরো সব ঠিক হয়ে যাবে"
জাহিদ অন্ধকার ঘরের আবছা আলোয় মেঝেতে পড়ে থাকা, অচেনা লোকটা বৃথাই ডাকার চেষ্টা করলো। লোকটা ঘুমিয়ে
কাদা। কয়েকবার ডেকে জাহিদ হাল ছেড়ে দিয়ে প্রমাদ গুণতে লাগলো। নিশ্চয়ই খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। জাহিদ চেয়ারটাকে নেড়ে নেড়ে ছোট্ট জানালার মত ফুঁটোটার কাছে যেতে চাইলো। পর্যাপ্ত ফুঁটো না থাকায় এক চোখ দিয়ে দেখলো, চারদিকে সারি সারি পাহাড়। মাঝখানে একটা ফাঁকামতন জায়গা।
দু'জন দীর্ঘদেহী মানুষ আচমকা অন্ধকার ফুঁড়ে যেন উদয় হল। একজন অচেনা লোকটাকে বগলদাবা করে তুলে নিয়ে গেল। অন্যজন জাহিদের ফ্লেক্সিকাফ খুলে সসম্মানে নিয়ে চললো। আকাশে আজ বিশাল গোলাকার একটা চাঁদ। বাহিরের চারপাশ ফকফকা আলোয় উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করছে। আকাশের চাঁদের দিকে স্বপ্নে দেখা কুকুরগুলো মুখ উচিঁয়ে সজোড়ে কান্না করছে। কুকুরগুলোর কান্নার শব্দ জাহিদের, গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। জাহিদের মনে হয়, যেন শতবছরের খুনখুনে বুড়ো হাপরের মত করে শ্বাস টেনে টেনে কাঁদছে। ভয়াবহ এক অবস্থা। জাহিদের মন চাইছিলো জায়গা ছেড়ে এক দৌড়ে পালাতে।
বিশাল হলঘরের মত বড় জায়গার ভেতরটা। হলঘরের ভেতরটা দেখে জাহিদের মনে হচ্ছে, ভিতরে কমপক্ষে হাজারখানেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই কালো একটা আলখাল্লা পড়া। এসাসিনের মত মুখে কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। বিরাট হলরূমে জাহিদকে দেখেই সবাই চাপা উল্লাসধ্বনি করে উঠলো। ভেতরে একটা গোল বড় বৃত্ত। মাটিতে খোদাই করে আঁকা। তার মাঝে একটা তারা। সেটাও মাটিতে খোদাই করে
আঁকা। লোকটা জাহিদকে তারাটার মাঝে নামিয়ে দিলেন। কালো আলখেল্লা পড়া দুজন অর্ধবয়সী মহিলা এগিয়ে এল। তারা
জাহিদের গা থেকে দ্রুত কাপড় খুলে নিল। সবার মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। কারো চেহারা দেখা যাচ্ছে না। জাহিদের কাছে সবকিছু কেমন যেন পরিচিত মনে হচ্ছিল ।
সত্যিই তো ! এই দৃশ্য তো জাহিদ প্রতি শেষরাত্রিতে স্বপ্নে দেখতো।
দীর্ঘাদেহী এক লোক বের হয়ে এলেন ভিড়ের মধ্যে থেকে। অচেনা লোকটাকে শুইয়ে রাখা হলো বেদীর উপর।সেই বেদীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। লোকটা দুহাত উচু করতেই সব থেমে গেল। সবাই বিড়বিড় করে 'হোম' 'হোম' শব্দে মাথা নাড়াতে লাগলো।লোকটার গলার স্বর গম্ভীর, জোরালো, একঘেয়ে। চারপাশে হঠাৎ পিন-পতন নিরবতা বিরাজ করতে থাকলো।
"ঈশ্বরের নামে শপথ করছি, ঈশ্বর নিশ্চয়ই আমাদের রক্ষা করবেন।
আমেন ! আমেন! আমেন
আমাদের কাল্টকে নতুন একজন আইকন দিতে আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি । আমরা আমাদের মাঝে এমন একজন বাহককে খুঁজে পেয়েছি যে "লর্ড আংরা মাইনুর" দেহকে নিজের দেহে ধারণ করবে। আদর্শ বাহক খুঁজে পেতে আমাদের দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী লেগেছে।অন্ধকারের দেবতা আজ আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। আমাদের দেবতাকে দেবলোক থেকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্বাসনের কাল দ্রুতই শেষ হতে যাচ্ছে। যা আমাদের পূর্বপুরুষরা করতে পারেননি তা আমরা করতে পেরেছি। আমাদের মহামান্য দেবতাকে অপমান করা হয়েছিল।
তাকে অপমানকরভাবে 'পাতালের দেবতা' বলে খেতাব দেওয়া হয়েছিল। শয়তান হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আর না। অভিসম্পাতের দিন আজ শেষ হতে চলেছে।
অ্যাংরা মাইনু Angra Mainyu (also: Aŋra Mainiiu) আজ আবার ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে। এই দেহটিকে ধারণ করবে তাকে নিজের মধ্যে। আমাদেরকে অন্য এই
দেহটি দেবে অপার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা দিয়ে একদিন আমরা সমগ্র পৃথিবীতে রাজত্ব করবো। আহুরা মাজদা, দাহাকা,আহরিমান, মিত্রা, বাহরাম,ফ্রাবাসিস কেউ আমাদের প্রভুর সামনে টিকতে পারবে না। আমাদের প্রভু স্বর্গ দখল করে নেবেন । তখন, স্বর্গ চলে
আসবে আমাদের হাতে। আমাদের রাজত্ব কায়েম হবে সারা দুনিয়ায়।
একজন অর্ধবয়সী মহিলা এগিয়ে এসে জাহিদকে একটা সোনালী রঙের পাত্র দিল। পাত্রের ভেতরে ফেনাউঠা গরম গাঢ় লাল তরল পদার্থ। জাহিদ বুঝতে পারলো সেটা তাকে পান করতে হবে । সোদা সোদা ঘ্রাণযুক্ত নোনতা ধরণের অদ্ভুত ঝাঁঝালো তরল পদার্থটা পরক্ষণেই খেয়ে ফেলে।
এরপরের ঘটনাগুলো জাহিদের অবশ্য বেশি মনে নেই। যতটুকু মনে আছে সেটুকু মনে না থাকারই সমান অর্থাৎ অস্পষ্ট। অচেনা লোকটা একবার চিৎকার করে উঠেছিল। চিৎকারের গলা শুনে জাহিদের নিকট মনে হয়েছিলো শব্দটা খুব পরিচিত। এর আগে শব্দটা কোথাও শুনেছে জাহিদ।
অসম্ভব সুন্দরী এক তরুণী তারপর জাহিদের কাছে এসে স্পর্শ করে। শীতল অনুভূতি মেশানো হাতে জাহিদের পুরো নগ্ন গায়ে লাল রঙের কিছু একটা মেখে দিয়ে যায়। তরুণী জাহিদকে জড়িয়ে ধরে জাহিদের পুরো শরীর অনেকক্ষণ ধরে লেহন করে। ভয়ংকর এক ধরনের উত্তাল উত্তেজনতা অনুভব করছিলো, জাহিদ। এক সময় সব শান্ত হয়ে যায়। ক্লান্ত শরীরে টলে পড়ে যাচ্ছিলো। শরীরের সকল ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছিলো। কাজ করছিলোনা কোন অঙ্গ-প্রতঙ্গ। চারপাশের সবাই লুটিয়ে পড়ে কুর্নিশ করছিল।এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় জাহিদ।
চারপাশে আলোয় আলোকাচ্ছন্ন। সূর্য তার তেজীদ্বীপ্তিতে আলো ঝরাচ্ছে। ঘরের সবাই যে যার কর্মক্ষেত্রে বেরিয়ে পড়েছে। জাহিদ আজ জাহিদ নয়, সে অন্য এক প্রাণী। দাড়োয়ান চাচা কাল চাকুরি ছেড়ে তার বাড়ি ফিরে গিয়েছেন-জাহিদ সব জানে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাথরূমে যেতে হলোনা জাহিদের। জাহিদের জামা-কাপড়, বিছানা গোছানো কিংবা সকালের নাস্তার প্রয়োজন হলোনা।
জাহিদ আজ অন্য সত্ত্বাধিকারী। কয়েক হাজার
বছর আগে আলোর দেবতা আহুরা মাজদা দ্বারা নির্বাসিত শয়তান অ্যাংরা মাইনু আজ জাহিদ। পাপ আর অন্ধকারের দেবতা অ্যাংরা মাইনু যে, পারসিক সভ্যতা অনুযায়ী বর্তমানের জাহিদ হচ্ছে একজন শয়তান। শয়তানকে পুনরোজ্জীবিত করে দেহে ধারণ করার জন্য পুর্ণিমায় জন্ম এবং তার ষষ্ঠ জন্মদিনও পূর্ণিমায় হতো এমন একজন শিশু দরকার ছিল।জাহিদ ছিল সবদিক থেকে যোগ্যবাহক। মাইনুর দেহকে ধারণ ক্ষমতাকারীকে বলা হয় শর্বর। জাহিদ এখন শর্বর। ম্যাগাস, ইপসিসিমাস ছেড়ে সে এখন একাদশ স্তরে। শয়তান এখন তার মাঝে বিরাজমান।
জাহিদ বর্তমানে পুরোদমে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক ব্যাক্তি। জাহিদ তার শৈশব এখন আয়নার মত পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছে। কিভাবে তাঁর পুরোনো মা-বাবাকে খুন করে তাকে নিয়ে পালিয়েছিলো দাড়োয়ান চাচা। বিক্রি করে দিয়েছে কর্পোরেট এক বাবা-মায়ের কাছে অতঃপর নিজের তপস্যাও সিদ্ধ করেছে। এত সুবিধা যখন নিয়েই ফেলেছে, শেষ সুবিধা থেকে অ্যাংরা মাইনু কিভাবে তাঁকে বঞ্চিত করে। জাহিদ অপ্রতিরোধ্য, অ্যাংরা মাইনুকে আর ঠেকানো যাবে না ! জাহিদ ছাদে উঠে চুপচাপ বসে আছে । তাঁর দু'পাশে গার্ডিয়ান। লকলকে জিহ্বা ঝুলে পড়া কালো মিচমিচে দু'টি কুকুর।
সামনে পড়ে আছে দুটো মৃতদেহ।ধীরে ধীরে রক্ত তার নিজ পথ খুঁজে, বয়ে চলেছে বহমান নদীর ধারার মতন......
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৪১