আব্দুল হক সাহেব একজন সাদাসিধে সুখী মানুষ।বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন সরকারী চাকুরে। প্রায় সাত-আট বছর হলো রিটায়ার্ড করেছেন। রিটায়ার্ডের সময় হাউজ বিল, পেনশন, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড,
বাড়তি ছুটির টাকা সব মিলিয়ে একসঙ্গে বেশকিছু টাকা পেয়েছেন। সেই টাকা ব্যাংকে জমা রেখেছেন।মাসে যে টাকা 'ইন্টারেষ্ট' পান সে টাকা দিয়ে সংসার মোটামুটি চলে যায়। বয়স এখন ষাটোর্ধ অথচ স্বাস্থ্য ভাল, কোন রোগবালাই নেই। পাঁচটে মেয়েকেই
ভালো পাত্র দেখেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। দু'জন
প্রবাসী। বাকি দু'জনের মধ্যে একজন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা প্রফেসরের কাছে অন্যজন চট্টগ্রামের বন্দরের সরকারী উধ্বর্তন কর্মকর্তার কাছে। স্ত্রী গত হয়েছে দু-তিন বছর হলো। আব্দুল হক সাহেব একা একা থাকেন । তাই, নিরিবিলি দেখে পুরোনো
একটা বাড়ি ক্রয় করেছেন।
গত কয়েকবছর একা একা থেকে মানিয়ে নিয়েছেন চারপাশের পরিবেশের সাথে। দিনের বেলাটা শরৎচন্দ্রের বই পড়েই কাটিয়ে দেন। দুপুরে নিরিবিলি দেখে আশেপাশের হোটেলে বসে খেয়ে নেন। কোলাহল
থেকে যতটাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্ট করেন। রাতে কিছু খান না। কোনদিন একটা আপেল কিংবা কোনদিন এক কাপ গ্রীণ-টি খেয়ে শুয়ে পড়েন। এক ঘুমে এর পরদিন ফজরের আজান পর্যন্ত।
আষাঢ়-শ্রাবণের এক মাস। বেলা প্রায় দশটা-এগারোটা।আব্দুল হক সাহেব বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র-র লাইব্রেরি দেখে লাইব্রেরিতে ঢুকলেন। লাইব্রেরির ভেতরটা একদম ফাঁকা। মনে মনে আক্ষেপে বললেন, এখনকার আধুনিক যুগে বইপড়া একদমই ছেড়ে দিয়েছে যুবসমাজ।
একদিকে 'হক সাহেব' মনে মনে খুশিই হলেন। বই পড়াটা প্রধান না, নিরিবিলিটাই প্রধান তাঁর কাছে।লাইব্রেরিয়ানরা হয়তোবা দুপুরের খাবার খেতে গেছে।'ম্যাক্সিম গোর্কি'-র মা উপন্যাসটা হাতে নিয়ে 'হক সাহেব' নিরিবিলিতে একটু পড়তে বসেছেন। তখন,
লাইব্রেরিতে আরেকজন ভদ্রলোক ঢুকলেন।
অচেনা ভদ্রলোকের দৈহিক অঙ্গ-ভঙ্গি দেখে বোঝাই যাচ্ছে-লোকটা প্রচুর কথা বলবে।
"একটা দেয়াশলাই হবে ? "
কথা না বাড়িয়ে হক সাহেব দেয়াশলাইটা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বের করে দিলেন।
"আশাকরি সিগারেটের ধোঁয়ায় আপনার অসুবিধে হচ্ছেনা"
'জ্বি, না'
"আন্তরিক ধন্যবাদ,আপনি কি সিগারেট খাবেন ? "
আব্দুল হক সাহেব বিরক্তিসুরে আঙ্গুল দিয়ে
"লাইব্রেরির ভিতরে ধূমপান করা নিষেধ" সাইনবোর্ডটা
দেখিয়ে দিলেন। লোকটা মাথা নিচু করে চলে গেল।
এহেন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আব্দুল হক সাহেব মন খারাপ করে চলে এলেন লাইব্রেরি থেকে।
বিকেল হয়ে গেছে। পাখিরা যার যার মত তার নীরে ফিরে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে আসার সময় পথিমধ্যে রূগ্ন এক ব্যাক্তিকে কিছু বড়বড় আকারের রূপচাঁদা মাছ বিক্রি করতে দেখলেন। সদাই কিনতে এসে কখনোই
দরদাম করেননি হক সাহেব। এবারও তার ব্যাতিক্রম হলোনা।
মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তায় পরশী শওকত সাহেবের সাথে দেখা হলো।
শওকত সাহেবের হাতে লাল কাগজে মোড়া প্রশস্ত চারকোণা একটা সন্দেহজনক জিনিষ। বক্সের ভিতর কি আছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবার পাত্র নয় হক সাহেব।
তবে,এই লোকটার সমস্যা হল, একটা কথা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বারবার বলেন।
"আসসালামু আলাইকুম"
'ওয়ালাইকুমুস-সালাম,কোথাও যাচ্ছেন ? '
"না, এমনি। চলেন চা খাই"
'না, অন্যদিন'
বাসায় ঢুকে মাছটা রান্নাঘরে রেখে এসে হাতমুখ ধুয়ে নিলেন। চশমাটা, পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে পরিষ্কার করছিলেন। কাজের বুয়া তাকে নাশতা দিয়ে গেল।
একটা পিরিচে কয়েক টুকরো আপেল, মালাই চা আর পাঁচ ছয়টা বাটার-টোষ্ট। আপেলগুলো খেতে কেমন যেন
তিতকুটে লাগছিলো। বিস্কুটগুলো মিইয়ে গেছে। দাঁতের চাপে রবারের মত চেপ্টে যাচ্ছে। মাথাটা একটু ধরেছে।
আব্দুল হক সাহেব প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খোঁজে শোবার ঘরে ঢুকলেন। কিছুই পাওয়া গেলো না। বাইরে পাখির ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ শোনা গেল। বাইরে থেকে পড়শীদের ফুল বাগানের মিষ্টি গন্ধটা নাকে লাগলো। কাজের বুয়াটা রান্নাঘর থেকে বলে উঠলো,
"ভাইজান !!! "
'জ্বি, বল'
"শইলডা ভাল ঠেকতেছেনা"
'কি করতে চাও'
"কাইল রাইন্ধা দিয়া যামু"
'আচ্ছা, তাহলে বাসায় চলে যাও'
কাজের বুয়াটা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আব্দুল হক সাহেবও ঘরে তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ঘর থেকে উঠোনে দাড়াতেই ছাতিম গাছে ঝুলন্ত সাইনবোর্ডটার দিকে চোখ পড়লো,
"চিশতীরহমান ফকির
জ্বিনসাধক, পরীসাধক
তাবিজ, যাদু-টোনা,বাটি চালান
তেল পড়া, চুন পড়া, বান মারা
(বিফলে মূল্য ফেরত)"
রোদে বৃষ্টিতে সাইনবোর্ডটা নষ্ট হয়ে গেছে। একটু মুচকি হেঁসে ফার্মেসীর দিকে হাঁটতে থাকলেন।
প্যারাসিটামেল না হলে আজ চলছেনা।
কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হল পিছু পিছু কেউ আসছে। পকেট থেকে 'ক্যাপস্টন' সিগারেটের প্যাকেটা বের করে একটা সিগারেট রোল করে ঠোঁটে ধরালেন। অদ্ভুত
মাদকতাময় স্বাদ।
" দেয়াশলাই হবে!"
কিছুটা চমকে উঠলেন আব্দুল হক সাহেব। পাশেই ক্যাথলিক চার্চ তাই এদিক দিয়ে নিতান্ত বেশি প্রয়োজন না হলে এ সময়ে কেউ আসে না। কিন্তু, আব্দুল হক সাহেব চমকে উঠলেন সকালের লাইব্রেরিতে দেখা
লোকটার মতন দৈহিক আকার-আকৃতি-অঙ্গভঙ্গি দেখে।
এবারও হক সাহেব কথা না বাড়িয়ে স্বাভাবিকভাবেই দেয়াশলাইটা এগিয়ে দিলেন।
"আপনি আমার সাথে কথা বলতে মনে হচ্ছে, বিরক্ত
হচ্ছেন। আমার পরিচয় পেলে মনে হয় আপনি আর বিরক্ত
হবেন না। আমি একজন ভ্যাম্পায়ার।"
' আব্দুল হক সাহেব এবার লোকটার দিকে ভ্রুঁ কুচঁকে
তাঁকালেন। তাঁকিয়ে মনে মনে বললেন, দিনে দিনে
ভ্যাম্পায়ারদেরও অস্তিত্বও শেষকালে বিপর্যয়ের
মুখে। '
"কি, বিশ্বাস হচ্ছেনা,তাইনা। আপনার চেহেরা দেখে
মনে হচ্ছে আপনি আমায় বিশ্বাস করতে পারছেন না।"
আব্দুল হক আনমনে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন।
'আপনি ভ্যাম্পায়ার ভালো তো'
"ট্রান্সেলভেনিয়ার বিখ্যাত কাউন্ট ড্রাকুলার গল্প
পড়েননি ?"
'হাসোজ্বলভাবে হক সাহেব প্রশ্ন করলেন, ড্রাকুলাদের
তো রোদ লাগলে মারা যায় ?'
" হা হা হা, মিডিয়াগুলোর ভাবনা এটা। আসলে তেমন
কিছুনা"
'তো থাকেন কোথায়, কফিনে ?'
এবার আব্দুল হক সাহেবের এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথায় কিঞ্চিৎ ব্যাথিত দেখা গেল লোকটাকে।
"আপনি কি কখনো ভ্যাম্পায়ার দেখেছেন ?"
হঠাৎ এহেন প্রশ্নে, আব্দুল হক সাহেবও চুপসে গেলেন। তার তাচ্ছিল্যপূর্ণ চেহেরাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনি কোন নতুন তথ্য জানার কৌতূহলী মনোভাব নিয়ে আছেন ।
অচেনা লোকটা এবার ধীরে ধীরে বলা শুরু করলো।আব্দুল হক সাহেব এবার আর বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেননা।
সময়টা আজ থেকে অনেক বছর আগের।
আমরাও সাধারণ মানুষ ছিলাম। আমার বাবা-মা আর
আমি। খুব সুন্দর একটা ছোট্ট পরিবার। ঐ সময়টাতে সভ্যতা এতটা দ্রুত পরিবর্তন হয়নি, এখন চারপাশ যতটা উন্নত। আমরা ছিলাম ভেনিজুয়েলান আমাজানে
বসবাসকারী ক্ষুদ্র ইন্ডিয়ান শ্যামেইন উপজাতির ধ্বংসাবশেষ। আমাদের জীবন-ব্যাবস্থা বর্তমানের মত অতটা উন্নত
ছিলোনা। আমরা বরাবরই মাটির নিচে ঘর তৈরি করে থাকতাম। আমাদের পূর্বপুরুষরা লোকালয় পছন্দ করতেননা। এটা অনেকটা ট্যাবুর মত হয়ে গিয়েছিল
আমাদের শ্যামেইনদের মধ্যে। তাই, আমাদের
জীবনকালও ওভাবেই কেটে গিয়েছে।
জঙ্গলের বিশাল বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস,বোয়া কিংবা শেরমান-ট্রি'র গুঁড়ির নিচে ঘর বানাতাম। আমাদের
জীবন-ব্যাবস্থাও অদ্ভুত ছিলো।
আমাদের জনগোষ্ঠী ভ্যাটিক্যান সিটির এক বুড়ো পাদ্রীর কথা খুব মানতো। তখানকার সময় ইউরোপে বিপ্লব চলছিলো। চারপাশে জনগণের হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ আর ইউরোপিয়ান সৈনিকদের বিদ্রোহ চলছিল।
আব্দুল হক সাহেব এবার রীতিমত খেকিঁয়ে উঠলেন।
'ভ্যাম্পায়ারদের সাথে এদের সম্পর্ক কি ?'
"আছে, আছে। পুরোটা শুনুন "
'সেটা তো দেখা যাচ্ছে, আমার সময় নেই। আমি চলি.....'
"আহ! শুনুন না"
আমাদের জনগোষ্ঠীতে হঠাৎ একজন অচেনা লোকের আগমন ঘটলো। লোকটা রীতিমত অস্বাভাবিক এবং ভয়ংকর চেহেরার। কিন্তু, লোকটাকে দেখে আমাদের
সকলের মাঝে কোন এক অজানা কারণে কেমন যেন মায়া হয়েছিল। লোকটা নিজে নিজেই অনেক দুঃসাহসিক কাজ সমাধা করতো। কিন্তু, লোকটার বদঅভ্যেস ছিলো, সে রাত্রে হাঁটাহাটি করতো। দিন
কয়েক যেতেই আমরা উপলদ্ধি করলাম, লোকটা সাধারণ কোন মানুষ নয়।
লোকটা পেশায় একজন ফিজিশিয়ান ছিলো। আমাদের অনেকের বিভিন্ন শারীরিক অসুখ যা নিরাময়যোগ্য ছিলো না, লোকটা খুব সহজেই রোগ নিরাময় করে
দিতো। একটা সময় আমরা তাকে বিশ্বাস করতে থাকি।
আমাদের একজন বলেই তাঁকে মেনে নিই।
আব্দুল হক সাহেব অস্ফুটস্বরে বললেন,
হঠাৎ অচেনা একটা লোক আপনাদের সাথে থাকছে অথচ আপনারা তার পরিচয় জানতে চাইছেননা, অদ্ভুত !
"লোকটা ছিল একজন গবেষক"
'কি নিয়ে গবেষণা করতো,ট্রাইব নিয়ে ?'
"জ্বি, না।মানুষের জন্ম-মৃত্যু নিয়ে! "
'তাই বুঝি'
একদিন নিশুতি রাতে লোকটাকে পাশের কবর থেকে
উঠতে দেখে আমাদের পাদ্রী। মুখে হলদে চর্বি।এছাড়াও, অন্য আরেকদিন ঘুমন্ত মানুষের শরীর থেকে রক্ত চুষে খাওয়া দেখে ফেলেন পাদ্রীসাহেব ।লোকটা ব্যাপারগুলো স্বাভাবিকভাবেই নিতো কিন্তু
আমাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে থাকে ধীরে ধীরে ।
একসময় লোকটা আমাদের সকলকে তাঁর বশে এনে ফেলে।লোকটা আমাদের বেশিরভাগ সাধারণদের দিয়েই
রক্তচোষা বাদুড় সংগ্রহ করাতো। রক্তচোষা বাদুড় খুব দুষ্প্রাপ্য প্রাণী।সহজে ওদের দেখতে পাওয়া যায় না।একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার চ্যাগ্রোস
উপত্যকায় আছে।এরা থাকে এক পাহাড়ি
গুহাতে।খুব দুর্গম অঞ্চল।সহজে সেখানে যাওয়া যায় না।
জায়গাটা পানামাতে।ঐ উপত্যকার
আশেপাশের এলাকা জনমানবশূন্য। আমরা পরে জানলাম,
লোকটার প্রাচীন বাসস্থানের কথা। সে পানামার অধিবাসী।
লোকটা একসময় ধীরে ধীরে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে
দিলো। কেমন জবুথবু হয়ে বসে থাকতো। দিনের বেলায়
কম বের হতো। রক্ত চেটে খাওয়াটা একসময় তার কাছে
নেশা-পেশা দু'টো হয়েই দাঁড়ায়।
শ্যামেইনের পুরো জনগোষ্ঠী দলবদ্ধ হয়ে একসময়
লোকটাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়। ফল
সুবিধাজনক হয়না।
লোকটা সবার ঘাড়ের কাছে দাঁত ঢুকিয়ে রক্ত পান
করতে থাকে। আমাদের বেশিরভাগ সঙ্গীই মারা যায়। এ
ঘটনার পর, পাদ্রী একদিন অভিযান চালান মাটির
তলার সব মানুষদের খুঁজে বের করার জন্য। অভিযানে
একমাত্র
নেতৃত্ব দেয় পাদ্রীসাহেব নিজেই। আমি সহ দশ-
বারোজনকে নিয়ে পালিয়ে যায় পাদ্রীসাহেব।
পথিমধ্যেই, রোগ-শোকে অর্ধেকের বেশিই মারা যায়।
আমি চুপিসারে লোকালয়ে ঢুকে পড়ি। আমি উলঙ্গ আর
গায়ে প্রচুর দুর্গন্ধ ছিলো।তাই, বাড়ি
বাড়ি গিয়ে একটু গোসলের জন্য অনুরোধ করলাম মানুষ
আমাকে পাগল ভাবলো। দীর্ঘদিন গোসল করিনি।
শরীরের ভেতরগত আকৃতি অনুভব করলাম কেমন যেন
অচেনা লোকটার রক্তচোষা বাদুড়গুলোর মত হয়ে গেল।
বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবার
কাজ চাইলাম।
আধুনিক স্থাপত্যের এক বাড়িতে গিয়ে একইভাবে দাবী
তুললে বাড়ির মালিক
জনসন আমাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। প্রচন্ড
মার দিতেও থাকেন। অবশ্য মার
খাওয়ার প্রধানতম কারন মালিকের স্ত্রী
ক্যাথেরিনে’র সাথে জনসনের সেদিন ভালো কাটেনি।
আমার মধ্যে হঠাৎ অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটতে
থাকলো। মনে পড়লো, এই ক্যাথেরিনের সাথে অতীতে
আমার কোন একটা সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু এর ফলে যা হয়
তা হল
জনসন আর ক্যাথেরিনের মাঝে একধরনের ভুল
বোঝাবোঝি
তৈরি হয়। একসময় ক্যাথেরিন জনসনকে না জানিয়েই
কোন এক
অজ্ঞাত কারনে আমাকে জায়গা দিয়ে দেয় তার
বাড়িতে। সুস্থ হয়ে উঠলে চলে যেতে বলে। কিন্তু যখন
আমি চলে যেতে চাই তখন ক্যাথেরিনই আমাকে আটকায়,
অন্য কোনভাবে আমাকে থেকে যেতে অনুরোধ করে এই
বাড়িতে। একদিকে আমার কোন ঠিকানা ছিলোনা।
তাই, অজানা কারণেই বাড়িটিতে ঠিকানা গেড়ে বসে পড়লাম।
জনসন অবশ্য কিছুই জানতোনা।
বেশকিছুদিন পরে, হঠাৎ বাড়ির পেছনের দিকটায় আমার
সেই মাটির নিচের একজনের সাথে পরিচয় হলো। দিনের
বেলাতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেরোচ্ছে। রাত্রে
তাঁকে আমার বাসায় নিমন্ত্রিত করলাম।
দু'জনে ভাবলাম এ বাড়িতে নিজেদের অস্তিত্ব
টিকিয়ে রাখতে হলে কোন একটা বুদ্ধি নিশ্চয়ই আটঁতে
হবে।
যার ফলশ্রুতিতে আমি অার আমার বন্ধুর সহায়তায়
বাড়ির
বৃদ্ধ গার্ডেনার আর তার স্ত্রীকে মেরে একটা জলায়
ফেলে দিই। একজন গার্ডেনার হিসেবেই আমি ঐ
বাড়িতে ঢুকি, সম্পূর্ন অন্য এক লেবাশে। গার্ডেনারকে
অবশ্য আমরা কাঁমড়ে মারিনি। বাড়ির প্রাক্তন
গার্ডেনার ও তার স্ত্রীর মাথায় সিমেন্টের পুর দিয়ে
জলায় ফেলে দেয়া হয়।
এতে করে, তারা পানিতে ডুবেই মারা যায়।
রক্তের নেশা একসময় আমার আর আমার বন্ধুর মাথাচাড়া
দিয়ে উঠে।
লোকালয়ের ক্লাবগুলোতে আমাদের আনাগোণা বাড়তে
থাকে। নারীদের কোমলমতি দেহগুলোতে আমাদের
কামনা উপচে পড়ে। বিভিন্ন রক্তের নেশায় আমরা
ব্যাকুল হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে চারপাশে ঘুরতে থাকি।
আমাদের দলটা ধীরে ধীরে ভারী হতে থাকে।
নতুন লেবাশে
আমাকে চিনতে পারে নি জনসন আর না চেনার ফলেই
পুরো বাগানটা নতুন করে সংস্কারের কাজ দেয়।
নিজ থেকেই জনসন আমাকে থাকার জায়গা দেয় এবার
তার নিজের বাড়ির প্রধান রূমগুলোতে। দলভারী হওয়ার
কারণে একদিন আমি জনসনকে
অনুরোধ জানাই বাগান করতে আরও লোক প্রয়োজন ।
জনসন মত দিলে আমি মাটির তলায় থাকা
বন্ধু ও ক্লাবের কিছু স্ট্রিপ ডান্সারদের নিয়ে আসি
বাগানের কাজ সমাধা করতে। এর মাঝে একটা ঘটনাটা
চলতে থাকে। প্রতিরাতে ক্যাথেরিন
যখন ঘুমের মধ্যে থাকে আমি নীরবে এসে ক্যাথেরিনের
শরীরের উপর বসে থাকি। সারারাত ধরে ক্যাথেরিনের
সাথে যৌনসঙ্গম করতে থাকি কিন্তু ক্যাথেরিন তখন
গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে থাকতো। আমি ভোরসকালে বিছানার
উপর থেকে চলে
গেলে ঘুম ভাঙতো ক্যাথেরিনের। প্রতি রাতেই এমনটা
হতো। আর
প্রায় প্রতি রাতেই ঘুম ভাঙার পর জনসনের সাথে
খারাপ ব্যবহার করতে থাকে ক্যাথেরিন। কারন
ক্যাথেরিন স্বপ্নে
দেখে জনসন তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। অথচ
তেমন কিছুই ঘটতোনা। জনসন একসময় প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে
যায় তার জীবন নিয়ে, যে
জীবন কিছুদিন আগেও ছিল নির্ভেজাল আর আনন্দের।
পাশাপাশি জনসন-ক্যাথেরিনে’র বাচ্চা আর তাদের
দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা নাতাশাও আমার আর
আমাদের বন্ধুদের মায়াজালে আটকা পড়ে। যেন
রুপকথার
ডাইনীদের মত জাদু করা হয় ওদের। এক রাতে জনসনের
পানীয়তে বিষ মিশিয়ে দেয় ক্যাথেরিন। আমাদের
প্ল্যান যেন বাস্তবে রুপ নেয়। ক্যাথেরিনও বাদ যায় না
মৃত্যুর হাত থেকে। আমি আর আমার সাথের বন্ধুরা মিলে
পরদিনই বাড়ির বাচ্চা ও নাতাশাকে নিয়ে বের হয়ে
যাই আবার আমাদের জঙ্গলের পথে। ভেবেছিলাম
লোকালয়ে থাকবো কিন্তু ইচ্ছে করছিলোনা। এত
কোলাহোলে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল।
অচেনা লোকটাকে আর কোথাও পাওয়া গেলোনা।
আমার আর নাতাশার ভালোই সংসার কাটছিলো।
হঠাৎ একদিন জঙ্গলে কিছু মানুষ দেখা গেলো। আমাদের
মাটির ঘরগুলোর ভিতরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলো
সবকিছু। এরপর থেকেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে দেশ-
বিদেশে ঘুরছি।
হাঁফছেড়ে উঠলেন আব্দুল হক সাহেব। চোখে তার আতঙ্ক
।
"আপনি কি ভয় পাচ্ছেন"
'না। আপনি আবার কোন সময় আমার ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে
রক্ত চুষে খাবেন কে জানে...??'
"আমরা আর এখন সেভাবে রক্ত খাইনা। ব্ল্যাড ব্যাংক
থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণের পছন্দের রক্ত কিনে নিয়ে
আসি। চলে যায় মাসখানেক"
'শুনে শান্তি পেলাম'
"আমার এ-পজেটিভ রক্ত খুব ভালো লাগে। হালকা
মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ আছে"
'ওহ'
"আপনার রক্তের গ্রুপ কি"
'জানিনা। কখনো পরীক্ষা করায়নি ..?'
"পরীক্ষা করিয়ে রাখা ভালো। কখন কি হয় বলা
যায়না..!!!"
'তার মানে কি ভ্যাম্পায়ার আলাদা কোন প্রাণী
নয়...!!!'
"জ্বি, সেটাই। একটা ভাইরাসের কারণেই এমনটা হয়েছে
।
বুঝিয়ে বলছি..!! "
'ব্যাপারটা বোঝার কোন আগ্রহ প্রকাশ করছিনা। '
লোকটা তবুও অনর্গল বলে চলেছে,
"ভাইরাসগুলো অদ্ভুত ধরনের। এরা মানুষের জীনকে
বাদুড়ের মত করে দেয়।
সেই তের শতকের অচেনা লোকটাই রক্তচোষা বাদুড়
থেকে প্রথম ভাইরাসটা মানুষের গায়ে নিয়ে
এসেছিলো। আমাদের যে রক্ত খেতে হয় সেটা ঐ
ভাইরাসটার জন্যই খেতে হয়। রক্তটা ওদের জন্যই
প্রয়োজন। ভাইরাসটা এক প্রকার সেনসিটিভ। সবসময়
একজনের গাঁয়ে থেকে অন্যজনের গায়ে সংক্রমিত করে।
'তাহলে এখন কেন ভ্যাম্পায়ারদের সংখ্যা বাড়ছেনা ?'
"মানুষ তুলনায় কম। আমাদের রক্ত প্রয়োজন!
ব্লাডব্যাংক রক্ত দিচ্ছে। তাহলে, কি প্রয়োজন মানুষ হত্যা করার!"
'ও, আচ্ছা'
"রাস্তায় অনেক সহজাতের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা
হয়ে যায়। যেমনঃ আজকে যখন আপনাকে প্রথম
দেখেছিলাম তখন আপনাকে কিছু একটা মনে হয়েছিল।"
আব্দুল হক সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, আমাকে
ভ্যাম্পায়ার ভেবেছিলেন ?
"জ্বি, না। অনেকদিন পর দেখে আপনাকে সেই জনসনের
মত মনে হচ্ছিলো"
'কেন ..??'
"আপনার দাড়ি-মোছ আর মুখের কাটিংটা পুরোপুরি
জনসনের মতই"
'হা হা হা'
অচেনা লোকটা প্যান্টের পকেট থেকে এ-পজেটিভ
রক্তের একটা প্যাকেট বের করে চেটে খেতে লাগলো ।
আব্দুল হক সাহেব হাঁ করে দেখছেন, অচেনা লোকটা রক্ত
নামক প্রোটিন মহানন্দে খেয়ে চলেছে।
"আমার তো খাওয়া শেষ হয়েছে। এখন, আমার কাছ থেকে
একটা সিগারেট নিন !"
'না, সিগারেট এখন খাবোনা'
"পান খাবেন। ঢাকার ঈসা খাঁ হোটেলের পাশ থেকে
নিয়ে এসেছি। চমন বাহার দিয়ে, মিষ্টি পান। শুকনো
মুখে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে কিছু চিবুনো ভালো"
'না, পান খাব না।'
"ও, আচ্ছা"
'আপনার রক্তগুলো জমাট বাঁধা থাকলে খেতে খারাপ
লাগেনা ?'
"রক্ত থেকে আমি ফাইব্রিন আলাদা করে ফেলি"
আব্দুল হক সাহেব এবার মুখ নামিয়ে বললেন,
'ভ্যাম্পায়ারের লক্ষণ কি ?'
"লক্ষণ খুব সহজ। ভ্যাম্পায়ারদের রোদে ছায়া পড়েনা"
'কেন ?'
"কেন সেটা জানিনা। ছায়া পড়েনা এইটুকুই জানি।
আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। "
.
হঠাৎ অচেনা লোকটা চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো ,
"এখান থেকে চলে যাওয়ার সুযোগ খোঁজেন ।"
আব্দুল হক সাহেব মনে মনে হাসোজ্বোলভাবে বললেন,
'তোমাকে ছেড়ে যাওয়া যে সম্ভব না।'
কিন্তু, মুখে কিছু বললেন না। প্রতি রাতেই এর পর থেকে
হক সাহেবের মনে হতে থাকে,
কোনও এক অশুভ শক্তি তাঁকে তাড়া করছে, পরক্ষনেই
কেও আবার তাঁকে রক্ষা করছে। এখন ভাল করে
দোআ পড়ে তারপর ঘুমোতে যান । বাড়িতে একা থাকা
যেন তাঁর জন্য বর্তমানে অভিশাপ।
দিন দিন কোন কিছু খেতে পারছেননা, শুকিয়ে কাঠ হয়ে
যাচ্ছেন। চোখের
নীচে কালি পরে যাচ্ছে । এমন করেই দিন যাচ্ছে ।
রাস্তায় বের হলে সবসময় মানুষের ছায়া খুঁজতে থাকে ।
.
.
একদিন রাতে পড়শী শওকত সাহেব হন্তদন্ত হয়ে হক
সাহেবের রুম এ ঢুকলেন ।
তাঁর হাত ধরে টেনে উঠালেন । বললেন,
"আপনার অতি জরুরী জিনিসগুলো নিয়ে নিন। আপনাকে
এক্ষুনি যেতে হবে।"
হক সাহেব বিসম্য়ভরে তাঁর দিকে তাঁকিয়ে রইলেন। তাঁর
বিস্ময়ের সীমা রইলনা ।
'কোথায় যাব আমি?'
শওকত সাহেব বললেন ,
"প্রশ্ন নয়, তাড়াতাড়ি ।"
এই বলে তড়িঘড়ি করে হক সাহেবের ব্যাগ
গোছাতে লাগলেন। শওকত সাহেব পাগলের মত হক
সাহেবকে টানতে টানতে রীতিমত দৌড়াতে লাগলো ।
মুখ ফঁসকে হক সাহেব বলে উঠলেন,
'ওরে বাবা, আপনার গাঁয়ে যেন ভ্যাম্পায়ারের শক্তি ।
আমাকে প্রায় উড়িয়েই নিয়ে চলছেন ।'
অন্ধকারে চার্চের রাস্তার দিকে দু'জনে ছুটে চলছেন ,
কারও মুখে কোন কথা নেই ।
অনেক্ষন পর শওকত সাহেব বলে উঠলেন , সামনেই
রাস্তার পাশে একটা বড়
চার্চ আছে, রাত টুকু সেখানে পার করে ভোরের ট্রেন
এ বাড়িতে ফিরে যাবেন । আর এখানকার ঘটে যাওয়া
কোন কথা কাওকে কোনদিনও বলবেন না। আব্দুল হক
সাহেব চিৎকার করে বললেন,
'আমার বাড়ি ছেড়ে আমি কোথায় যাব। '
শওকত সাহেব ঠুকরে কেঁদে উঠলেন । কাঁদতে কাঁদতে যা
বললেন তাতে
বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, তিনি ও তার পরিবারের কেও
মানুষ নন। অনেক বছর আগে ওনারা মারা গেছেন।
আজকের এই দিনটিতে । তাই ওনারা এই দিন
এ কোনও না কোনও মানুষ কে টুকরো টুকরো করে কেটে
খেয়ে , নিজেদের জ্বালা কমায়।আমাকে ওরা অনেক
আগেই খেয়ে ফেলতো, শওকত সাহেব বাধা দিয়েছেন ।
বলেছেন, আর
কটা দিন অপেক্ষা করতে । কিন্তু,
আজ আমার কোনও কথাই কেউ শুনবেনা , আজ সেই
অভিশপ্ত দিন। আজ পুরো লাইকেন জনগোষ্ঠী পাগল হয়ে
গেছে । আপনাকে
শেষ রক্ষা করতেই আমি চেষ্টা করছি। এই বলে, আরও
জোরে উড়িয়ে নিয়ে চলল ।
আর তখনি হক সাহেব শুনতে পেলেন পেছনে জোরে
জোরে গাছ পালা ভাঙ্গার
আওয়াজ । শওকত সাহেব বললেন ,
"আর বুঝি পারলাম না। ওরা এসে পরেছে । যা বলছি মন
দিয়ে শুনেন । চার্চটার বাম পাশে
একটা ঘর আছে। সেখানে ফাদার থাকেন। তিনি
আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন।আব্দুল হক সাহেব যেন
মূহুর্তেই পাথর হয়ে গেলেন।
কিছু বলতে পারছিলেন না। পেছনের শব্দ গুলো বাড়তে
লাগলো , কোনমতে রাস্তা পার হয়েই শওকত সাহেব
আব্দুল হক সাহেবকে
এক মুহূর্ত চেপে ধরলেন । তারপর দূরে ছুড়ে ফেললেন।
চিৎকার করে বললেন , পালান ।
আব্দুল হক সাহেব প্রানপনে দৌড়াচ্ছেন । হঠাৎ সেই
রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারটা সামনে দাঁড়িয়ে দাত
কেলিয়ে হাঁসতে হাঁসতে বলতে থাকলো,
"সাহায্য লাগবে...?"
'হুম'
প্রচণ্ড শব্দে আব্দুল হক সাহেব পেছন ফিরে দেখলেন
তিন টা দানব যেন লড়াই করছে । গাছগুলো
ভেঙ্গে পড়ছে ।আব্দুল হক সাহেব সব শক্তি দিয়ে ছুটছেন
। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টায় ।
ওই তো চার্চ দেখা যাচ্ছে ।বাম পাশের ঘরটাও দেখতে
পারছেন । শওকত সাহেব আর অচেনা লোকটা লড়াই করে
চলছে ।এক পর্যায়ে দশ বারোটা লাইকেন মিলে শওকত
সাহেব আর অচেনা লোকটার শরীর থেকে দু'জনের
মাথাটা আলাদা করে
ফেললো। আব্দুল হক সাহেব কোনও রকমে ফাদার এর
দরজায় সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করেই ঙ্গানশূন্য হয়ে
মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
.
হঠাৎ দরজার কলিং বেলের শব্দে আব্দুল হক সাহেব
বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন। তাঁর পুরো শরীর ঘেমে
জবজবে হয়ে গেছে। কাজের বুয়া এসেছে। দুপুরবেলা
বুয়াকে, কালকের আনা রূপচাঁদা মাছগুলো রান্না করতে
বললেন। আব্দুল হক সাহেব সকালের নাস্তা খেয়ে হাত-
মুখ ধুয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর এক
ছেলেবেলার বন্ধু 'জাবেদ' বর্তমানে একজন নামি-দামি
সাইক্রাটিস। 'জাবেদের' কাছে যেতেই জাবেদ সাহেব,
আব্দুল হক সাহেবকে তো রীতিমত জামাই আদর করা শুরু
করে দিলেন। সে তো কত কথা !! ছোটবেলার কত স্মৃতি
আর তাঁর বর্তমান কাজ-পরিবার নিয়ে কথা বলতে বলতে
বিকেলে হয়ে গেল। শেষবিকেলে আব্দুল হক সাহেব,
জাবেদ সাহেবকে তার সমস্যার কথা বললেন। জাবেদ
সাহেব ভ্রুঁ কুচকে আব্দুল হক সাহেবের দিকে তাঁকালেন।
"তুই ছিলি আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে সাহসী, আর তুই..?"
'সময় খারাপ যাচ্ছে। দেখছিস তো কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছি'
"কি হয়েছে খুলে বল তো"
আব্দুল হক সাহেব এরপর সেদিনের ঘটনাসহ সব খুলে
বললেন। এরপর, ধীরে ধীরে সব ঘটনা শুনে জাবেদ সাহেব
উত্তর দিলেন এসবকিছু তোর "হ্যালুসিনেশন"।
'হ্যালুসিনেশন, কি বলিস..?'
সারাদিন একা একা থাকিস তো এজন্যই এ অবস্থা।
সারাক্ষণ একা একা থাকার কারনে তোর মাঝে
একঘেঁয়ে ভাব চলে এসেছে।
জাবেদ সাহেব এরপর জিঙ্গাসা করলেন,
"আচ্ছা তুই "কাউন্ট ড্রাকুলা" বইটা কবে পড়েছিলি..?"
'এইতো এক সপ্তাহ...!'
"ঘটনা শুরুর কয়দিন আগে...?"
'দুই দিন'
তাহেলেতো সব পরিষ্কার। দেখ, তুই যখন কাউন্ট
ড্রাকুলা বইটা পড়েছিলি, তখন থেকেই তোর মাঝে
ভ্যাম্পায়ার নামক একটা কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি
হয়েছিলো। আর, সেদিন যখন লাইব্রেরিতে তোর কাছ
থেকে অচেনা একজন লোক দেয়াশলাই চেয়েছে, তুই
তাকে নিঃশব্দে দেয়াশলাইটা দিয়ে দিয়েছিস। অথচ
তুই তাঁর চেহেরা পর্যন্ত দেখিস নি।
' সমস্যা এখানে কি,বলবি'
"উত্তেজিত হচ্ছিস কেন, বলছি"
বিকেলবেলা যখন তুই মাছ-হাতে একা একা বাসায়
ফিরছিলি তখন তোর সাথে শওকত সাহেবের দেখা হয় ?
'হ্যা, তাতে কি..?'
ধীরে ধীরে শোন, রাত্রিবেলা চার্চের সামনে দিয়ে
ফার্মেসীতে যাওয়ার সময় তুই নীরব জায়গায় দাঁড়িয়ে
সিগারেট খাচ্ছিলি।ঐ সময়টাতেই তোর মাঝে 'অডিটরি
হ্যালুসিনেশন' ঘটছিলো। তুই বুঝতেই পারিস নি। আর
রাতের স্বপ্নটা ছিলো তোর 'আতঙ্কগ্রস্ত মন'-এর
ফলাফল ।
কিছুদিন আগে কাউন্ট ড্রাকুলা বই আর তোর এই আতঙ্ক
থেকেই এই খারাপ স্বপ্নটা দেখেছিস।
আব্দুল হক সাহেব ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে
গেলেন। বাড়ির গ্রাম্য-প্রবাদটা তার মনে পড়ে গেল,
"বনের বাঘে খায়না, মনের বাঘেই খায়। "
"বইয়ের নেশা পারলে একটু কমা!"
'কেন..??'
"প্রেমের বই পড় একটু !"
'আবার আমার পঁচে যাওয়া ফুসফুসটায় গোলাপ জন্মাতে
বলছিস
কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
মদ খা,সিগারেট খা পারলে একটু গাঞ্জা খা
তবুও প্রেম করিস না'
"হা হা হা"
সেদিনের পর থেকে বর্তমানে আব্দুল হক সাহেব সুস্থ
আছেন। তিনি এখন আর একাকী থাকেন না। সবার সাথে
কথা বলতে বলতে রীতিমত মজমা জমিয়ে ফেলতে
পারেন। বইপোকার মতন তাঁকে আর এখন লাইব্রেরীতে
দেখা যায়না। রাস্তার টং এর দোকানগুলোতে চা-পান
আর আড্ডা জমাতেই বেশি দেখা যায়। বই পড়েন তবে
সেটা সময়মত। সবকাজ এখন নিজেই করেন, বাসায়
কাজের বুয়ার প্রয়োজন হয়না ।
একদিন বিকেলে কাজ শেষে বাড়ির উঠোনের সামনের
'সাইনবোর্ডটা' খুলে ফেলতে ছাতিম গাছটায় উঠেছেন।
"দেয়াশলাই হবে"
হঠাৎ এমন শব্দে আব্দুল হক সাহেব পাশ ফিরে তাঁকালেন।
গাছের ডালে ঝুলে থাকা কালো বাঁদুড়টা একজোড়া চোখ নিয়ে জ্বল
জ্বল করে তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে........
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৩