.
আবছা অন্ধকার, থমথমে পরিবেশ, বদ্ধ বাতাসে পুরানো দিনের গন্ধ, মাঝেমাঝে ঠান্ডা হাওয়া ছুয়ে যায়। গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। প্রচন্ড গরমে অথবা ভয়ে। মিষ্টি একটা সুবাস বয়ে যায় কখনও ঠিক ছোট মুরগির বাচ্চা জন্মানোর পরের সুবাসটা। 'অভ্র' যে করিডোরটার সামনে দাড়িয়ে আছে, তা অনেকটা তেমনই। হঠাৎ মনে হচ্ছে, একটা মিষ্টি সুবাস তাকে ছুয়ে গেল। সত্যি কি তাই? নাকি ব্যাপারটা নিতান্তই হ্যালুসিনেশন?
.
এমন গায়ে কাঁটা দেয়া জায়গায় সত্যি কি কেউ উপরে আছে? সেদিনের থুরথুরে ফকির বুড়ি তো তিনতলার কথাই বলেছেন। ভুল জায়গায় এসে পড়েনি তো? এই বাড়িটায় যে কতগুলো গলি আর করিডোর আছে তার কোনো হিসেব নেই। আব্বু-আম্মুই মাঝে মধ্যে হিমসিম খায়। আর সেখানে আমি..!!!
.
আব্বু-আম্মু আজ গ্রামে চলে গেছে পুরো বিল্ডিং এমনিতেই ফাঁকা। ভুল হচ্ছে। একা একা আসা উচিৎ হয়নি। এতক্ষনে নিশ্চয় পুরো বিল্ডিং ফাঁকা হয়ে গেছে মানে যে যার ফ্ল্যাটে চলে গেছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, সামনে বিপদ। তৃতীয়তলার ফ্ল্যাটটা কাল সকালে ইচ্ছে করলে যাওয়া যেত। না না, তা কি করে হয়, অভ্র যেটা ভাবে সেটা না করলে সারা রাতে একটুকও ঘুম হয় না? অভ্র ভয়ে ভয়ে করিডোর ধরে হাঁটা শুরু করলো। কেমন যেনো একটা শব্দ কানে আসছে। কেউ প্রচন্ড ব্যাথায় গুঙ্গিয়ে উঠলে যেমন শব্দটা হয়। সে ভয়ার্ত চোখে পেছনে তাকায়। ইদুঁড়ের কিচিরমিচির ডাক ছাড়া কিছুই নেই।অভ্র মনকে বোঝালো, এটা তো নিজেদের বিল্ডিং এর মতনই। এত ভয় পাওয়ার কি আছে?
.
জন্মের পর থেকে কোনদিনই অভ্র তিনতলার চৌকাঠ মাড়ানোর মত দুঃসাহস করে উঠেনি যদিও অভ্ররা দুই তলায় থাকে নিচের ঘরে জমিদার। একবার তৃতীয়তলার সিঁড়িপথ পর্যন্ত গিয়েছিলো কিন্তু মা'র সেকি বকুনি আর পিটুনি আজও ভুলতে পারেনি।
করিডোরের শেষ মাথায় বামদিকে আরেকটা সরু রাস্তা। রাস্তাটা পার হলেই হয়তো শর্টকাটে তিনতলায় কি আছে দেখা যাবে। অভ্র যথাসম্ভব দ্রুত করিডোর টা পার করার দিকে মনযোগ দিল। কিন্তু 'ষষ্ট ঈন্দ্রিয়' বলছে পেছন থেকে কেউ একজন তাকে ফলো করছে। কিন্তু পেছন ফিরে দেখলো আবার কয়েকটা বাতি ইদুঁড়ের ক্যাঁচক্যাচানি ছাড়া আর কিছুই না।
.
গরমের দিন হওয়ায় বাইরের বাতাসও দর্শনীয় ছিলো। বাতাসে করিডোরেরর পাশের পুরোনো ময়লাযুক্ত পর্দাটা বারবার উড়ছে, হঠাৎ পর্দায় চোখ পড়তেই বাইরের আকাশটা দেখা গেলো অন্ধকার, কালো নিকষ অন্ধকারে ঢেকে আছে পুরো পৃথিবী। কোথাও একটুও আলোর দেখা নেই। অমাবস্যা নাকি আজকে? আসলে অন্ধকারটা একটু গাঢ় হলেই মন শিউড়ে উঠে অমাবস্যা নিয়ে। ধীরে ধীরে চলে আসলো তৃতীয়তলার কাঙ্খিত রূমটাতে। দরজার পাশেই 'সুইচ-বোর্ড' ছিলো, অন করে নিলো 'অভ্র' সোডিয়াম লাইটটা নিভু নিভু জ্বলছে। ঘরে আর কিছুই সন্দেহজনক দেখা গেলো না। হতাশ হয়ে ফিরে যাবে হঠাৎই টেবিলের নিচে একটা ছোট্ট সরু করিডোরের মত জায়গা দেখা গেলো। একটা ভায়োলিন বাঁজছে অদ্ভুত এক করুণ সুরে কিন্তু কোন বাদক নেই (অদ্ভুত) আর টেবিলের উপরে সুসজ্বিতভাবে সাজিয়ে রাখা আছে অনেক পুরনো 'সার্জিকাল নাইফ', পুরনো জংধরা 'সিক্সগান','লুগ্যারটা' এবং একটা বক্সে কিছু তারকাটা,হাতুড়িসহ কিছু অজানা যন্ত্রপাতি ।(এটাও অদ্ভুত মনে মনে বলে অভ্র)
.
অনেক পুরোনো ঘর বলে মাকড়সার জাল আর ধূলোয় পুরো ঘর ছেয়ে ছিলো। ঠুক ঠুক শব্দ হচ্ছে। নিচের করিডোরে কেউ একজন দেওয়াল ভাঙ্গছে মনে হচ্ছে। অভ্র এক মুহূর্তের জন্য কান পেতে থাকে।
ঠুক ঠুক শব্দের বিরাম নেই। এখনও হচ্ছে সেটা। সেই সাথে আরও একটা জিনিস যোগ হয়েছে। কেমন যেন একটা ঘষা শব্দ। খস খস শব্দ হচ্ছে। যেন কেউ বেলচা দিয়ে দেওয়ালের ঘষছে। সিমেন্ট সুড়কি মেশাচ্ছে কি কেউ? সেটা তো অসম্ভব, এ ঘরটায় কেউ পর্যন্ত আসেনা চারপাশের মাকড়সার জালই তার পরিচয় বহন করে। কিন্তু, সেদিন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থুরথুরে ফকির বুড়ি মহিলা এ ধরনের শব্দ আর এ ঘরটার কথাই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন কিন্তু বাড়ির সবাই সেদিন হাসির ছলে উড়িয়ে দিয়েছিল কথাটা।
.
কিঞ্চিৎ কৌতূহল আর ভয়মিশ্রিত নিয়ে ভায়োলিনের কাছে যেতেই শব্দটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। কাচের দরজাটায় লিখা ছিলো (Please Don't Open It) কিন্তু লেখাটার তোয়াক্কা না করে দরজাটা সরিয়ে ভায়োলিনটা বের করে আনতেই হঠাৎ কালো মতন কিছু একটা অভ্রর দিকে তুমুল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়তেই সাথে সাথে ঙ্গানশূন্য হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো অভ্র।
.
ঠিক কতক্ষণ ওভাবে পড়ে ছিলো তার মনে নেই, অনেক কষ্টে ঐ ভয়ানক ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ দরজার কলিংবেলে কিছুটা ঘাবড়িয়েই উঠলো অভ্র। ঘুমাতুর চোখে আর ব্যাথাভরা শরীরে টলতে টলতে দরজা খুলতেই দেখে লোডশেডিং, দরজায় একটা মানবমূর্তি।
.
-- বাবা তুমি কি তিনতলার রূমটায় গেছিলা (শান্ত কন্ঠে বলে জমিদার চাচা)
-- না..না..', আংকেল (কিছুটা ঘাবড়িয়ে, সত্য বলে দিলে যদি ঝাড়ি খেতে হয় কিনা)
-- বাবাজি,সত্য করে বলো..আজ কখনো কিংবা ভুলবশত গেছিলা নাকি (এবার একটু উত্তেজিত হয়)
-- নাহ, চাচা। আমি কেন যাবো আমার কি দরকার ঐ ঘরটায় আপনিই বলেন
-- না,তা ঠিক কিন্তু ভায়োলিন...কাঁক...কুকুর (তিনি কিছু একটা মিলাতে মিলাতে প্রস্থান করলেন)
.
দরজাটা লাগিয়ে দিয়েই ঘুমোতে চলে গেল অভ্র।
এর কিছুদিন পর কোন এক অজানা আকর্ষণে সবার চোখের অগোচরে প্রায় প্রতিরাতেই নিষিদ্ধ রূমে গিয়ে ঘোরাফরা করতো। কয়েকদিন খুঁজে-ফিরো কালো মোটা কোন জন্তুর চামড়াযুক্ত আর উপরে কিছু ভয়ঙ্ককর সুন্দর পাথরে ঘেরা বাঁধাই করা এক ভয়ংকর সুন্দর বই খুঁজে পেল,সেটাই এখন তার জীবন।
.
------
১৭' জুলাই,২০১৫
রাত তিনটে
-----
.
বইটা নিয়েই এখন সারাটাদিন কাটে অভ্রর। বইটার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ জমে গেছে তার। বইটা নিয়ে দীর্ঘদিনের সাধনার পর বুঝলো বইয়ের সাধন পুরোপুরিভাবে করার জন্য বলি দিয়ে শুদ্ধ হয়ে নিতে হবে।
.
হঠাৎ এদিক-সেদিক চিন্তা-ভাবনা করতেই দরজায় হালকা ক্যাচক্যাচ আওয়াজ হলো, অভ্র সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলো।
বইটা উল্টে রাখল অভ্র পায়ের কাছে। হালকা করে লক্ষ্য করলো অভ্রদের বিল্ডিং এর সামনের বাসার মেয়েটা দরজায় উঁকি দিচ্ছে।
.
অভ্র ধীরে ধীরে টেবিলের উপর থেকে হাতুড়িটা হাতে নিয়ে দরজার পিছনে লুকিয়ে পড়লো। মেয়েটা কিছুক্ষণ কিছু একটা খোঁজা-খুঁজি করলো তারপর পেছন ফিরে যেতেই 'ঘটাং' শব্দ হলো, সাথে সাথে মেয়েটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো
.
আজ ভাগ্যিস বাসায় বলা ছিল 'তারেকের' বাসায় যাচ্ছি তাই আজকে এ কাজটা ভালোয়-ভালোয় শেষ করা যাবে।
অভ্র চোখ তুলে তাকাল সামনে বসে থাকা মানুষটার দিকে।
সাদা একটা ব্রা ছাড়া আর কিছু নেই মেয়েটির পরনে। দুই হাত চেয়ারের সাথে 'ফ্লেক্সিকাফ' দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। টেবিলের ওপর রাখা আছে একটা হাতুড়ি। ছোট একটা বাক্সে আছে দশ-বারোটা সাত ইঞ্চি পেরেক।
মুচকি হাসল অভ্র, ‘কেনো এসেছিলে এখানটায়, হুম?’
প্রশ্নটার জবাব দিল না সামনের মেয়েটা। ভাঙ্গা গলাতে জানতে চাইল, ‘তু...ম..মি অভ্র না?’
দুই পাশে মাথা নাড়ল অভ্র, ‘প্রতিরাতে জানালা দিয়ে দেখেও চিনতে পারোনি..???’
‘তোমার তো কোন মানসিক রোগ ছিল না, তুমি কি 'সাইকো'?’(ভয়াতুর কন্ঠে নারী ছায়ামূর্তি বলে উঠে)
ঘরের এক কোণে সশব্দে থুতু ফেলল অভ্র, ‘আরে মানসিক সুস্থ কে? মানসিক অসুস্থ লোকের কাছে সুস্থরা পাগল। সুস্থদের চোখে অসুস্থরা পাগল।
মাথা দোলাল নারীছায়ামূর্তি। চোখ মুখ কালো হয়ে আছে।
‘অবশ্যই ছিল না।’ সুন্দর করে হাসল অভ্র, এত বেশি মানুষের নেই এই রোগ 'সাইকো...", বুঝলে 'এহরাইনা'?’
.
‘আমার নাম 'এহরাইনা' না। কিন্তু মাটির দিকে ঝিম করে তাঁকিয়ে থাকা অভ্র হঠাৎ 'এহরাইনের' দিকে রক্তাভ বিস্ফোরিত চোখে তাকালে নিজের দোষ শিকার করতে বাধ্য হয় মেয়েটা।
আসলে আমি ইচ্ছা করে ভায়োলিন বাদক 'রাস্তেহিকোকে' মারতে চাইনি। আসলে ও অনেকটাই আমার গোপন সম্পর্কে জেনে গেছিলো,আমি ওর সাথে 'লিভ টুগেদার' করার ইনভাইটও করেছি। আমিই তো রাস্তেহিকোকে প্রথম আমার ঘরে কাজ দিয়েছিলাম কিন্তু একটা রাতের পরেই ও কেমন যেন সাইকো হয়ে পড়ে। আসলে ওকে সাইকো বানানো হয় যেন আমার ড্রাগস্ এর বিজনেসটা জানতে না পারে, এতে ওকে মেরে ফেললোও কেউ কিছু ভাববেনা, সাইকো বলে কথা। যার কারনে ওকে এই ঘরেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়, বলেই কাঁদতে থাকে ........
'এখন সে বদলা তাহলো আমিই নিই'...দোভাষী মিশ্রিত গলায় বলে উঠে অভ্র।
.
হাতুড়ির দিকে হাত চলে যাচ্ছে অভ্রর। অন্য হাতে একটা পেরেক তুলে নিল ,সার্জিকাল নাইফগুলো ভায়োলিনের তালে তালে নড়ছে যেন এক অপূর্ব জীবনি ফিরে পেয়েছে উষ্ঞ রক্ত পিয়াসের চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকা দীর্ঘদিনের তীষ্ঞার্ত এই অস্ত্রগুলো... ........
.
(বাইরে কাঁকগুলো কা কা করেই যাচ্ছে, এদিকে কুকুরগুলো আকাশের দিকে মাথা তুলে একজনের অন্তিমযাত্রা জানান দিচ্ছে)
.
---------
অন্ধকার আকাশ্
---------
.
#অভ্র