( উৎসর্গঃ নদীতে ভেসে বেড়ানো উদবাস্তু লাশগুলোকে )
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার আরাম কেদারায় আয়েস করে বসে আছেন । সন্ধ্যা হয়েছে । সারাদিন খুব গরম ছিল । এখন ঠাণ্ডা বাতাস হচ্ছে । পদ্মার বোটে বসে এই বাতাস খেতে খুব ভালো লাগে । এই সময় কবি গুন গুন করে গান করেন । গানের কথাগুলো বাতাসের সাথে নাচানাচি করে , হাসাহাসি করে , এক অন্যের গায়ে ঢলে পড়ে । আজ কবি গান গাচ্ছেন না ।
রাতে একটা জরুরি সভা আছে । এক সপ্তাহ আগে থেকেই এই সভার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছিলো। কবির একমাত্র সেবক নরেন নদীর ধারের গ্রাম থেকে ভালো রসগোল্লা জোগাড় করে রেখেছে । সভায় বড় মাথার লোকরা আসবেন । খালি মুখে কথা জমে না । তাই রসগোল্লা দিয়ে মুখ ভর্তি করতে হবে । কবি সেই সভা নিয়ে ভাবছেন ।
তার এক ভক্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর পাঠিয়েছে । এই ভক্তের বাড়ি ঢাকার পাশে বিক্রমপুরে । এককালে আর্মিতে কাজ করতো । আর্মির লোক গান পছন্দ করে না । ওরা পছন্দ করে ঢুস ডাঁশ। বন্দুকের শব্দ এদের কাছে মধুর লাগে । তবে এই মানুষটা ভিন্ন । প্রতি রাতে গীতাঞ্জলী না পড়ে ঘুমাতে যেত না । পড়ার পরে বলতো আহা কি লেখা । এই কবি বাঙ্গালী না হলে আমি জাতীয়তা পরিবর্তন করতাম । একশত ভাগ করতাম । তার নাম ফরিদ মিয়া । সে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের শেষের দিকে পাক বাহিনীর হাতে মারা যায় । পালিয়ে যুদ্ধ করতে এসেছিলো । মৃত্যুর পর থেকেই ঢাকার পুরাতন বিমানবন্দরে থাকে । বিমানের শব্দ না শুনলে নাকি তার ভালো লাগে । মন অস্থির লাগে । ভুতেদের মন নাই এমন তো কোন কথা কোন গ্রন্থে লেখা নাই ।
ফরিদ মিয়া চিঠিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ এক মহা আয়োজন করেছে । এই আয়োজনের কথা শুনলে যে কেউ হাত তালি দিবে । হাত না থাকলে পা তালি দিবে । চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করবে । ব্যাপার হল বাংলাদেশের জাতিও সঙ্গীত গেয়ে বিশ্বরেকর্ড করা হবে । যে সে কথা না । এক লাখ মানুষ একসাথে এই গান গাবে। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি , চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রানে বাজায় বাঁশি। ভূত সমাজের উচিৎ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা । এমন দৃশ্য দেখা কি সবার ভাগ্যে জোটে । জোটে না ।
ভুতেদের ডাক বিভাগ খুব ভালো কাজ করে । তিন দিনের মধ্যে চিঠি এসে পৌঁছেছে । কবি নদীতে ছিলেন বলে একদিন দেরি হয়েছে । না হলে আগেই চলে আসতো । চিঠি পাওয়ার পর পরই কবি সভার আয়োজন করেছেন । বড় মাথার ভূতদের আগেই জানানো হয়েছে । সবাই আসবে । তাদের নিয়ে আজ রাতে সভা হবে ।
কবি এই সভা নিয়ে ভাবছেন । আজ তিনি খুবই খুশি । মনে মনে ভাবছেন বাংলাদেশ কতো কিছু করছে । সেদিন পতাকা নিয়ে রেকর্ড করলো । তার খুব যাওয়ার ইচ্ছা ছিল । তবে মাজার বেথ্যার কারনে যেতে পারেন নি । তবে এইবার অবশ্যই যাবেন । নদী নালা সব ভরাট হয়ে গেছে , এর উপরে গরু ছাগল চরে । সমস্যা নেই । কোন রকমে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত যেতে পারলেই হবে । পরের বেবস্তা ফরিদ মিয়া করবে । সে খুবই কাজের ভূত । কাজ করা আর তেজপাতা গোনা তার কাছে একি কাজ । কবি গুন গুন করে গান ধরলেন ।
আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ,
তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ঘটনাঃ ২
বাতাসে কেমন জানি গন্ধ আসছে । মরা পচার গন্ধ । কবি নাক কুচকালেন । নরেনকে ডাকলেন । ব্যাপার কি ? বোট তো নদীতে । এইখানে মরা পচার গন্ধ আসবে কি করে । কবির দুর্গন্ধ খুবই অপছন্দ ।
নরেন খোঁজ করে জানালো একটা লাশ নদীর মাঝখান দিয়ে ভেসে যাচ্ছে । কয়েকদিন আগেকার লাশ । পচে গেছে । নাম অজানা । এই লাশের উপর তার ভূত বসে আছে । মুখ গম্ভীর করে । গন্ধ সেই লাশ থেকে আসছে ।
কবি খুবই বিরক্ত হলেন । মরে গেছিস ভালো কথা । মানুষের শেষ পরিনতি মৃত্যু । কেউ আগে মরে কেউ পরে । এই নিয়ে চিন্তার কি আছে । কবি সেই ভুতকে ডাকতে বললেন । তিনি কথা বলবেন ।
ঘতনাঃ ৩
-তোমার নাম কি ?
-আমার নাম পঁচিশ , বাংলার ২৫ নম্বর ।
-এইটা কারো নাম হয় না কি ?
-কবিগুরু আমার কোন নাম নাই । মানুষ যখন ছিলাম তখন ছিল । এখন মনে নাই । মরার আগে আমাকে এই নাম্বার দেয়া হয়েছিলো ।
-হুম , মারা গেলে কি করে ? এক্সিডেন্ট ? এখন অবশ্য এই কারনে অনেক মানুষ মারা যায় ।
-না , এক্সিডেন্ট না । মেরে ফেলেছে ।
-নদীতে ভাসছ কেন ?
-ওরা আমাকে মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছে ।
-ঘটনা কি খুলে বল তো ।
-কবি গুরু ঘটনা খুবই দুঃখের । দুই তিন দিন আগে সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ফিরছিলাম । আমার ছোট মেয়ে দই নিতে বলেছিল , তাই দই নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম । আমার ছোট মেয়ের নাম গিনি । ও বিড়াল পছন্দ করে , ওর বিড়ালের নাম মিনি ।
-বিড়ালের কাহিনী বাদ দাও । তোমার মারা যাওয়ার ঘটনা বল ।
-আমার বাড়ি যেতে হয় বড় রাস্তার উপর দিয়ে । আমি যখন বড় রাস্তার মোড় পার হচ্ছি তখন একটা গাড়ি আসলো । আমার সামনে দাঁড়ালো ।
-তার পর ?
-গাড়ীর কাচ কালো । কাঁচের একপাসে লেখা রেব । আমি তো ভয় পেলাম । বাঘে ধরলে এক ঘা , রেব এ ধরলে একশত ঘা । ইদানিং অবশ্য ভুয়া পরিচয়ে কিছু লোক ঘুরাঘুরি করে । মানুষকে ধরে নিয়ে যায় । এরা আসল না নকল আমি কিছুই বুজলাম না । আমাকে গাড়ীতে তুলে নিলো ।
-তার পর ?
-ওদের একজন বল্ল স্যার এইটার নাম্বার পঁচিশ । অন্যজন হাসলও । পরে আমার হাতের দই নিয়ে খেয়ে ফেললো । আমি ভাবলাম এরা তো মানুষ ভালো না । দই না নিয়ে গেলে মেয়েটা তো মন খারাপ করবে । মেয়ে খুবই জেদি । খাওয়া দাওয়া বন্ধ ।
-পরে তোমার কি হল ?
-পরে আর কি । ওরা আমাকে সহ কয়েকজনকে নদীর ধারে নিয়ে আসলো । তার পর ঢুস । কেল্লা ফতে । তখন থেকে আমি নদীর পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছি । গন্ধ বের হচ্ছে । কিচ্ছু করার নাই । সাতার জানি না । নদী পার হব কি করে ?
কবি কিছুই বললেন না । তিনি নরেন কে ডাকলেন । বললেন পঁচিশ নম্বর ভূতের খাতির যত্ন করতে । দুই পিচ রসগোল্লা খেতে দিতে বললেন । নরেন পঁচিশ নম্বরকে নিয়ে গেলো ।
ঘটনাঃ ৪
কবি এখন একা । ঠাণ্ডা বাতাস হচ্ছে । নদীর পানিতে মৃদু ঢেউ । এই ঢেউয়ে ঝিমুনি লাগে । কিছুক্ষণ পরে সভা শুরু হবে । এখন ঝিম ভাব আসলে চলবে না । এখন একটু খুশি খুশি থাকতে হবে । তবে তিনি খুশি থাকতে পারছেন না । তার মনটা খুব খারাপ লাগছে । কান্না পাচ্ছে । কবিদের কান্না করতে নেই । এইটা অশুভ কাজ । কবিরা সমাজের বিবেক । তারা কাঁদলে সমাজ সংস্কার করবে কে ? কবির কান্না পাচ্ছে পঁচিশ নম্বরের ভূতটার জন্য । বিনা কারনে ওরা মানুষটাকে মেরে ফেললো । মানুষটার মেয়েটার এখন কি অবস্থা । দই না খেয়ে মেয়েটা অবশ্যই তার পিতার উপর অভিমান করে বসে আছে । তার ঠোট ফুলে আছে । এই মেয়ে ফোলা ঠোট নিয়ে আমার সোনার বাংলা গাইবে কি করে । আহারে মেয়েটার কি কষ্ট । কষ্ট নিয়ে কি সঙ্গীত করা যায় ।
কবির মনে এখন কষ্ট হচ্ছে । কষ্ট নিয়ে তিনি সঙ্গীত করছেন ...............
"মা তোর বদন খানি মলিন হলে
আমি নয়ন
ও মা আমি নয়ন জলে ভাসি
সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালবাসি।"