উৎসর্গ ~ ঘরে না ফেরা সেই বুদ্ধিজীবীদের কে ।
মনি বসে আছে । তার হাত পা শক্ত হয়ে আসছে । কাপুনি লাগছে । বুক শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে । তার মনে হচ্ছে পানি খেলেই তা বাস্প হয়ে যাবে । ভয় পেলেই মনির এমন হয় । চোয়াল শক্ত হয়ে যায় । গাল লাল হয়ে যায় । মনিরুল এই অবস্থার নাম দিয়েছে মরুভূমি অবস্থা । মনিরুল খুব সহজেই এইটা ধরতে পারে । এমন হলেই বলে " তোমার কি মরুভূমি অবস্তা । পানি খেলেই বাস্প হয়ে যাবে । কাছে আসো । তোমাকে পানি দেই । পানি খাউ । দেখি পানি কেমন করে বাস্প হয় । " এই বলে সে গ্লাস ভর্তি করে পানি নিয়ে আসে ।
মানুষটা কেমন জানি । কোন কিছুই কঠিন করে নেয় না । বিয়ে হয়েছে একবছর । মনি একদিনও তাকে কঠিন হতে দেখে নি । মাঝে মাঝে মনির খুব ইচ্ছা করে মানুষটা কঠিন হলে কেমন লাগে তা দেখতে । তখন সেও পানি নিয়ে যাবে । গ্লাস ভর্তি করে পানি নিবে । বলবে " পানি খাউ । আমি বাস্প হওয়া দেখি । "
মনির এখন খুব কান্না পাচ্ছে । শব্দ করে কান্না করতে ইচ্ছা করছে । সে কাঁদতে পারছে না । তার শ্বশুরের নিষেধ । সন্ধ্যার পরে এই বাড়ির কেউ শব্দ করে কাঁদতে পারবে না । কেয়ামত আসলেও কাঁদতে পারবে না । দাঁত এঁটে বসে থাকতে হবে । দেশের অবস্তা ভালো না । সন্ধ্যার পর থেকে কারফিউ চলে । পাক বাহিনীর অবস্তা যায় যায় । এরা সবসময় মুক্তির ভয়ে থাকে । শব্দ শুনলেই ঠুস ঠাশ ।
মনি কান্না এঁটে বসে আছে । কি করবে বুঝতে পারছে না । আজ সন্ধ্যায় কয়েকটা ছেলে এসেছিলো । চেহারা অপরিচিত । বাংলা বলে । মনিরুলের ছাত্র বোধয় । মনিরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক । ওর ছাত্ররা মাঝে মঝেই বাসায় আসে । যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আর আসতো না । আজ এসেছে । এসেই মনিরুল কে তাদের সাথে যেতে বলল । বলল " কথা আছে স্যার । আমাদের সাথে আসেন । "
মানুষটা মনির দিকে একবার তাকালো । হেসে ভরসা দিলো । চেনা হাসি । তুমি চিন্তা করো না , ভয় পেয়ে মরুভূমি হয়ো না যেন । আমি আসছি ।
সেই সন্ধ্যায় মানুষটা গিয়েছে । এখন গভীর রাত । মানুষটার বিবেচনা কেমন । এখনো বাসায় ফেরার নাম নেই । এই নিয়ে মনির খুবই চিন্তা হচ্ছে । ইদানিং পাক সেনারা বাড়ি থেকে মানুষ ধরে নিয়ে যায় । আর খোঁজ পাওয়া যায় না । এদের সাথে রাজাকাররও থাকে । রাজাকার পথ দেখায় । আচ্ছা ছেলেগুলো রাজাকার না তো । মনির আর কিচ্ছু চিন্তা করতে ভালো লাগছে না । না না মানুষটার কোন বিপদ হবে না । সে ভালো আছে । কারফিউ তাই হয়তো আসতে পারছে না । সকাল হলেই আসবে । গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে এসে বলবে " মরুভূমি কন্যা পানি পান করো । আমি বাস্প হওয়া দেখি । "
মনি তখন পানি পান করবে না । খানিকক্ষণ মুখ ভার করে বসে থাকবে । ভাব দেখাবে সে খুবই অভিমান করেছে । তার পর লাফ দিয়ে গিয়ে মানুষটাকে জড়ায় ধরবে । গ্লাসের পানিতে তাদের কাপড় ভিজে যাবে । তা যাক না , তাতে কি আসে যায় । সে মানুষটাকে জড়ায় ধরে কান্না করবে । শব্দ করে কান্না ।
************
মনিরুল ইসলাম আর কখনো ফিরে আসে না । মনি কিন্তু অপেক্ষায় থাকে । ভোর হয় , কারফিউ উঠে যায় । মনির বয়স বাড়ে । চুলে রং ধরে , সাদা রং । মনিরুল বড়ই অবিবেচক । সে ঘরে ফেরে না ।