( উৎসর্গ ~ আমার এক হতভাগা বন্ধুকে । সে গত কয়েকদিন আগে কিছু নেতার নিষ্ঠুরতার স্বীকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বিছানায় ছটফট করছে । আমরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি । সে বেথার ঔষধ নিচ্ছে । পাশে তার কৃষক পিতা নির্ঘুম রাত পার করছেন । পিতা পুত্রের এই বেথা আমাদের মতন নিষ্ঠুর মানুষদের স্পর্শ করে না । তাই আমরা এমন অন্যায় করি । রাতের বেলা গভীর ঘুমে নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখি । )
সাজ্জাদ সাহেব গভীর উদ্বেগ নিয়ে তার পুত্রের দিকে তাকিয়ে আছেন । পুত্রের নাম মুস্তাফিযুর রহমান । মুস্তাফিয ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ১১৫ নং ওয়ার্ড এর একটি বেডে শুয়ে আছে । বেডের চাদর নোংরা । সাদা চাদর বহুদিন ব্যাবহারে হলদেটে হয়ে গেছে । এক যায়গায় রক্তের দাগ । মুস্তাফিয এর শরীর থেকে রক্ত পড়ছে । তিনি খুবই চিন্তিত । ছেলেটার গত রাত থেকেই রক্ত পড়ছে । এখনো জ্ঞান ফেরে নি । মাঝে মাঝে সারা শরীর কেপে উঠছে । সাজ্জাদ সাহেব গভীর মমতায় পুত্রের হাত ধরে আছেন । শক্ত করে ধরে আছেন । মাঝে মাঝে বলছেন " বাপ গো ভয় নাই আমি আছি । "
তার পুত্র এই কথা শুনতে পাচ্ছে না । তাতে কি । অসুস্ত মানুষের পাশে কথা বলে তাকে ভরসা দিতে হয় । জ্ঞান ফিরলে শুনবে । ডাক্তার সাহেব বলেছেন আজ জ্ঞান ফিরবে । ডাক্তার মানুষটা ভালো । খুব যত্ন নিয়ে তার পুত্রকে দেখছেন । সাজ্জাদ সাহেব তাহাজ্জতের নামাজের সময় মন থেকে ডাক্তারের জন্য দোয়া করেছেন । মুস্তাফিজের জন্য ও দোয়া করেছেন । ছেলেটার যেন তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফেরে । পুত্রের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে তার বড়ই কষ্ট হচ্ছে । তিনি পুত্রের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় আছেন । বার বার কালেমা পড়ছেন । বিপদের সময় এই দোয়া পড়লে মনে জোর পাওয়া যায় । কিন্তু তিনি জোর পাচ্ছেন না । দুর্বল লাগছে । চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ।
~ আব্বা আপনি কান্দেন কেন ?
~ কই রে বাপ কান্দি না তো ।
~ অবশ্যই কান্দেন । আপনার চোখে পানি ।
~ অনেক ক্ষণ টাকাই ছিলাম তাই পানি আসছে । কান্দি না গো বাপ ।
মুস্তাফিয একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে । গত রাতের পর থেকে তার কোন ঘটনাই স্মরণ নেই । চোখ খুলেই দেখে তার বাবা তার দিকে তাকিয়ে আছে । চোখ ভর্তি পানি ।
~ বাপ গো এখন কেমন লাগছে ?
~ সারা শরীরে বেথা আব্বা ।
~ আহারে বাপ আমার । তুমি চিন্তা করো না । এইখানকার ডাক্তার বড়ই ভালো মানুষ । তোমাকে খুবই যত্নের সাথে দেখছেন ।
~ আব্বা আমার কি জ্বর আসছে ?
~ বাপ শরীর একটু গরম । চিন্তা নাই বাপ । সবুর করো । মনে মনে কালেমা পড়ো । বড়ই ওজনদার আমল । আমাদের নবী সাহেব অসুস্ত হলে এইটা পড়তেন ।
~ এখন কিছুই পড়তে ইচ্ছা করে না আব্বা । বুক বেথা করে ।
~ আচ্ছা বাপ তুমি চুপ থাকো আমি পড়ি । বুকের কই বেথা করে গো বাপ ।
মুস্তাফিয হাত নাড়াতে পারে না । সাজ্জাদ সাহেব কে ইশারায় বেথার জায়গা দেখায় । সাজ্জাদ সাহেব চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না । পুত্রের সামনে পিতার চোখের পানি ফেলতে নাই । অমঙ্গল হয় । তিনি পুত্রের অমঙ্গল দূর করতে পারেন নি । তার বুকটা কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । তার সুস্থ সবল পুত্রের এই অবস্থা , তিনি কিছুই করতে পারছেন না । অসহয়ের মতন পুত্রের বিছানার পাশে বসে আছেন । কালেমা পড়ছেন । বেথায় মুস্তাফিজের মুখ নীল হয়ে আছে । পুত্রের নীল মুখের দিকে তাকালে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে ।
গত রাত থেকে তিনি অসহায়ের মতন মুস্তাফিজের বিছানার পাশে বসে আছেন । মুস্তাফিজকে তার হলের রাজনৈতিক নেতারা মেরেছে । সবাই সরকার দলের লোক । হাত পা লম্বা । গভীর রাত পর্যন্ত ছেলেটাকে মেরে হাত পা ভেঙে দিয়েছে । সে চিৎকার করেছে । কেউ তাকে বাঁচাতে আসে নি । মুস্তাফিজের দোষ সে নাকি শিবির করে । কিন্তু তিনি তো তার পুত্র কে চেনেন । ছেলে কোন কালে রাজনীতির ধারে কাছেও যায় নি । সেই ছেলেকে মিথ্যা অভিযোগে এই ভাবে কেউ মারতে পারে তা তিনি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না । হাজার হোক যারা মেরেছে তারাও তো মানুষ । তাদের ও তো পিতা মাতা আছে । একদিন সন্তানের খোঁজ না পেলে অস্থির হয়ে থাকে । সাজ্জাদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । মানুষের নিষ্ঠুরতায় তিনি বড়ই বেথিত ।
~ আব্বা চুপ হয়ে আছেন যে ?
~ এমনি গো বাপ । তোমার এখন কেমন লাগে ।
~ ভালো না আব্বা । বড়ই বেথা । পায়ের মধ্যে টনটনায় ।
~ বাপ আমার আল্লাহ্ আল্লাহ্ করো । আরাম হয়ে যাবে বাপ । তুমি সুস্থ হয়ে যাবে ।
~ কবে সুস্থ হব আব্বা । আমার পা ঠিক হবে তো আব্বা । পায়ে যে কোন বল পাই না ।
এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন তিনি বুঝতে পারছেন না । ডাক্তার বলেছে সুস্থ হতে সময় লাগবে । সময় নির্দিষ্ট না। সাজ্জাদ সাহেব তার পুত্রকে মিথ্যা বললেন , " অবশ্যই তুমি সুস্থ হয়ে যাবে বাপ । নিশ্চিন্ত থাকো । আল্লাহ্ আছেন । "
~ আব্বা আমি কি পরীক্ষা দিতে পারবো ?
সাজ্জাদ সাহেবকে আরেকটা মিথ্যা কথা বলতে হবে । এই মিথ্যা বলতে গিয়ে তার গলা ধরে আসে ।