পিরোজপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ফেসবুক পেজ থেকে প্রাপ্ত ছবির উপর ভিত্তি করেই আজকের আলোচনা।
জনগণের জন্য প্রদত্ত সরকারি সেবার মানোন্নয়নে আমার নিয়মিত আলোচনার একটা অংশ হিসেবেও আজকের লেখাটাকে বিবেচনায় আনতে পারেন।
ভাল করে ছবিটা দেখার আহবান জানাচ্ছি।
ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা নলকূপ। মূল ফেসবুক পোস্টে বিস্তারিত কিছু লেখা না থাকলেও সহজে অনুমান করা যায় যে সরকারি প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই নলকূপটা বসানো হয়েছে। কিছুদিন আগে আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনেও সরকারি নলকূপ বসানো হয়েছে। প্রথমেই বলে নিচ্ছি, নলকূপ বসানোর এই প্রকল্প জনগণের জীবন পালটে দিচ্ছে। আগে যেখানে পুরো পাড়া বা গ্রামে মিলে একটা গভীর নলকূপ ছিল, এখন স্বল্প দুরত্বে, অনেকটা বাড়িতে-বাড়িতে বলে যায়, নলকূপ স্থাপিত হয়েছে। শহরের বাইরের জনগোষ্ঠীর জন্য এই নলকূপ বিশাল একটা গুরুত্ব বহন করে। যেখানে ওয়াসা কিংবা পৌরসভার পানি সরবরাহ থাকে না, সেখানে এই নলকূপই বিশুদ্ধ পানির একমাত্র ভরসা। জনগণের টাকা জনগণের সেবায় ব্যবহৃত হচ্ছে দেখে ভাল লাগছে।
যেটা বলার জন্য এই লেখার অবতারণা, সেটার সারমর্ম হল, এই সেবার মানকে দীর্ঘস্থায়ী এবং পরিবেশবান্ধব করার জন্য ডিজাইন কর্মকর্তাদের কারিগরী জ্ঞানের পাশাপাশি উন্নত সেবা প্রদান করার মানসিকতা প্রয়োজন। প্রকল্পের ব্যয় না বাড়িয়েই এই টিউবওয়েলকে আরও উন্নতভাবে স্থাপন করা যেত।
এই টিউবওয়েলের চারপাশ আমাদের জন্য খুবই পরিচিত একটা অবকাঠামো। হাতল চাপলে পানি পড়বে, অতিরিক্ত পানি চারপাশের বেষ্টনির মধ্যে আটকে পড়ে ড্রেন পাইপের মধ্যে দিয়ে পাশের পুকুরে গিয়ে পড়বে। এখানে টিউবওয়েলে কার্যকারিতা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। আমি প্রশ্ন তুলছি, ড্রেন পাইপের ডিজাইন এবং স্থাপনশৈলী নিয়ে। এই পাইপের দুইটা ভুলের কারণে এই প্রকল্পের দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং মেরামত ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছি।
ছবিতে খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন পুকুরের পাড় এবং পার্শ্ববর্তী ভবনের সীমানার মধ্যবর্তী সরু রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাফেরা করে। তাদের হাঁটার পথের উপরেই মাটি থেকে ইঞ্ছিখানেক উপরে ড্রেন পাইপটা ঝুলে আছে। গ্রামাঞ্চলের এলাকা দেখেই রাতের বেলা কোন ধরনের আলোকবাতি নেই বা থাকলেও অনিয়মিত বলে ধরে নিচ্ছি। পথের মধ্যে পাইপের কারণে দিনের বেলা এই রাস্তায় হাঁটা অস্বস্তিকর এবং অন্ধকারে এই রাস্তায় হাঁটাচলা অনিরাপদ বলেই প্রতীয়মান। দুইপাশে পাকা আইল, আরেক পাশে পুকুরের রিটেইনিং ওয়াল, এখানে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে ব্যাথা পাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। বিশেষ করে কম বয়সী ছেলেমেয়ে খেলার ছলে এখানে হোঁচট খেয়ে পার্শ্ববর্তী পুকুরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। গ্রামাঞ্চলের সব পিচ্চি-পাচ্ছা সাঁতার পারে। কিন্তু কেউ যদি সাঁতার শেখার আগেই এখানে হোঁচট খায়, তাহলে তার বেঁচে থাকার ঝুঁকি কতটুকু? প্রকল্প ব্যয় কতটা কমানোর জন্য একটা জীবনের ঝুঁকি নিতে আপনি রাজি আছেন?
পাইপ লাগানোর দ্বিতীয় ত্রুটি হল পুকুরের মাঝে পাইপের অংশবিশেষ ঝুলন্ত অবস্থায় রাখা। এইসব পিভিসি পাইপ ১.৫ - ২ ফুটের বেশি ঝুলন্ত রাখার নিয়ম নাই। সে যায়গায় পাঁচ ফুটেরও বেশি পাইপ এভাবে ঝুলিয়ে রাখার মানে হল, "৫ মাস পর এই পাইপ ভেঙ্গে গেলেও কোন সমস্যা নাই" ধরে নিয়েই এই কাজ করা। অথবা, ডিজাইনারের এই পাইপের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে কোন কারিগরি জ্ঞান নাই। ঠিকাদার লাগাইছে, ইঞ্জিনিয়ার বলছে, পাইপ তো আছে, টাকা তো খরচ হইছে, এই নাও বিলে সই করে দিলাম।
এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ৮০ হাজার টাকার টিউবওয়েলে ১০ হাজার টাকা খরচ করে পাকা পাড় বেঁধে দিলাম, সেটা চোখে পড়ল না, ১০ টাকার পাইপ নিয়া ক্যান ঘ্যান ঘ্যান করতাছেন?
পাকা পাড় আর টিউবওয়েলের জন্য ধন্যবাদ। মানুষের জীবন সুস্থ ও নিরাপদ রাখতে এই টিউবওয়েলে প্রতিদিন সেবা দিয়ে যাবে, সেটা নিয়ে কোন প্রশ্নই নেই। কিন্তু জনগণের টাকা খরচ করে যখন পাইপটা লাগানো হয়েছে, এই পাইপের জন্য তৈরী অসুবিধা, আপদ, ও দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই হবে। এই পাইপ সঠিকভাবে ডিজাইনের জন্য এই অধিদপ্তরে প্রকৌশলী নিয়োগ দেয়া আছে, তারা কেন ডিজাইনে ত্রুটি রেখে দিচ্ছে সেটা প্রশ্ন তুলতেই হবে। ডিজাইন ঠিকমত হয়ে থাকলে বাস্তবায়নে কেন গড়মিল, সেটার প্রশ্ন তুলতেই হবে। ঠিকাদার যেভাবে বানিয়েছে, সরকারি পরিদর্শক যদি সেটাই যাচাই বাছাই ছাড়া অনুমোদন দিয়ে দেয়, তাহলে ওই পদে প্রকৌশলী নিয়োগ দেয়ারই বা কি দরকার। কম বেতনে ঠিকাদার নিয়োগ দিলেই তো ভাল।
এবার আসেন, আমরা বিবেচনা করে দেখি এই যায়গায় টিউবওয়েলের সেবার মান অনিরাপদ থেকে নিরাপদ, পাসমার্ক থেকে লেটার মার্ক, কিংবা B+ থেকে A+ নিতে গেলে কি কি করা যেত।
সবকিছু বিবেচনায় আমার মতে, এই পাইপে আলাদা দুটো বেন্ট কানেকশন দিয়ে মাটির নিচ দিয়ে চালালেই ভাল হত। প্রথম বেন্টটা হবে টিউবওয়েলের ডানপাশে পাড়ের ঠিক নিচে, এখন যেখান থেকে পাইপটা শুরু হয়েছে। পানির গতিপথ সোজা নিচের দিকে ফুটখানেক নিয়ে গিয়ে তারপর মাটির ভেতর দিয়ে পুকুরে নিয়ে যাওয়ার পাইপ বসানো দরকার ছিল। মাটির নিচে হওয়াতে পাইপটা চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত না, সরাসরি সূর্যের আলো থেকে আড়ালে চলে যাওয়ার পাইপের দীর্ঘস্থায়িত্ব অনেকটা লাইফটাইম ওয়ারেন্টিতে পরিণত হত, আর উপরি পাওনা হিসেবে এলাকার সৌন্দর্যহানির কারণ হত না। পাইপটা পুকুরের পাড়ে গিয়ে আরেকটা বেন্ট দিয়ে সোজা নিচের দিকে নিয়ে গেলে "ঝুলন্ত পাইপ" সমস্যারও সমাধান হত। পাইপের মুখে ৪-৫ টা ইট বিছিয়ে দিলে মাটিক্ষয়ের সম্ভাবনা নেমে আসত শূণ্যের কোটায়। বর্তমান ডিজাইনের সাথে তুলনা করলে আমার প্রস্তাবিত ডিজানেই হয়ত ২০০ টাকা অতিরিক্ত খরচ হত। এই দুইশ টাকার বদৌলতে টিউবওয়েলের সেবার মান A+ উন্নীত হত কোনরকম উটকো ঝামেলা ছাড়াই। নিরাপদ অবকাঠামো আর লাইফটাইম ওয়ারেন্ট।
এখন আপনি বলেন, লাখটাকার টিউবওয়েলে যদি আর দুইশোটা টাকা খরচ করে সেবার মান বাড়ানো যায়, আপনি কি এই কাজ করবেন না?
লিঙ্কের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহবাতিক হওয়ার কারণে পোস্টের শেষে স্ক্রীনশটটা যুক্ত করে দেয়া ভাল আইডিয়া মনে হল।
১. ২৯ শে মার্চ, ২০২২ সকাল ৯:৩৫ ০