১
আমার বাড়ি বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানায়-রামপাল থানার ঠিক পাশে। আমার বাবা রামপাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। কলেজের বেতর ছিলো বেশি-ঠাকুরদা বললেন, আমি জমি বেঁচে টাকা পাঠাই। আমার বাবা বললো টাকা পাঠানোর দরকার নেই আমি বাড়ি আসতিসি। আজও আমার বাবার খুব গোপনে লালন করা একটা অহংকার, বাপ ঠাকুরদার থুয়ে যাওয়া জমির'তে একটুও বাড়ানো বাদে কমাইনি।
সেই বাপ ঠাকুরদার থুয়ে যাওয়া জমির সাথে আমার খুব বেশি পরিচয় যে আছে তা না। আমি শুধু জানি আমার গ্রামের বাড়িতে একটা টিনশেড একতলা ঘর আছে, কিছু ধানী জমি আছে, একটা আধামরা পুকুর আছে, পূর্বপুরুষদের গড়া কয়েকটা বাগদা চিংড়ির ঘের আছে। আমি যখন আগেরবার বেড়াতে গিয়েছিলাম-তখনো আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনাই। এখানে ওখানে ইতিউতি সোলার প্যানেল বসেছে। দুই তিন বাড়ি পরে গিয়ে ব্যাটারিতে করে মোবাইল চার্জ দিতে হয়। আমরা গ্রামে গেলেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করে, কেউ টিউওবওয়েল থেকে নোনতা মিষ্টি স্বাদের ঠান্ডা পানি এনে দেয়। সমবয়েসী কাকুরা ফুসলিয়ে বিলে নিয়ে যেতে চায়। বিলের মাঝখান দিয়ে একটা খাল চলে গেছে। খানের দুইধার দিয়ে ধানের খেত। এই খেতের মাঝে অনেকগুলো তোমাগে-বুঝলে উফল, এইটা ওইটা-আর ওইযে খালের ওইপারে-ওইটা তোমাগে। আর এইটা আর তার পাশেরটা আর তার সামনেরটা আমাগে। বুইসো?
আমার খালি গুলিয়ে যায়। বিষয় সম্পত্তি মাথায় ঢোকেনা। আমি শূণ্য দৃষ্টিতে মাথা নাড়ি। খুলনার ভাষাও আমি ভালো করে বলতে পারিনা-অর্ধেক চিটাইঙ্গা অর্ধেক বরিশাইল্যা আর অর্ধেক শুদ্ধ মিলায়ে কথা বলি- বুঝতি পারিসি। আমরাতো এখানে থাকি নে, তালি আমাগেডায় খেডা খেত করে?
ও ঠিক নেই। মাঝেমাঝে তোমাগেটায় আমাগে বাবা ধান রোয়-আগের বছর তোমার অজিত কাকু রুইলো, যখন যার হাতে কাজ থায়ে না-তখন সেইতি করে। তোমার বাপির সাথে ফোনে কথা বলে তোমার অজিত কাকু ঠিক করে দেয়।
এরপরে অনেকক্ষণ খুব ঝাপাঝাপি করা হয় খালে।
ও ভাইডি, তুমি সাঁতার জানো?
হয়! আমি সাঁতার শিখিসি।
তাই নাকি? তালি দেখি তো একডুবে কতোদূর যাতি পারো।
আমি একডুবে তিন চার ফুট এগোই-আমাকে দেখে আমার কাকুরা আর দাদারা হেসে দেয়। খালপাড় থেকে তারা ঝাপ দিয়ে একডুবে চলে যায় এইপার থেকে ওইপার। আমি চেয়ে থাকি-চিটাগাং ক্লাবে যে বুড়ো ইন্সট্রাক্টার সাহেব আমার পেটে পিঠে হাতিয়ে হাতিয়ে সাতার সেখাতেন-তিনি আমাকে কোনদিন বলেননাই যে ঘোলা খয়েরী জলে নামলে কিছু কিছু মানুষ শুশুকের মতন কলকলিয়ে লাফিয়ে বেড়াতে পারে অনায়াসে। সাঁতার কেটে এসে খিদে পেয়ে যায়। একটা লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আমাদের টিনশেড বাড়ির সিমেন্টের ফ্লোরে বসি আমরা। এই এলাকার মাঝে আর কোন পাকা ঘর দেখা যায় না। কাচা ঘরগুলোর পাকা মনের মানুষগুলো সব আমাদের চারদিকে জড়ো হয়।
পিতলের থালায় বোরোধানের ভাত বেড়ে দেয় একটা খয়েরী হাত, তার হাতে একটা সোনার বালা কেমন আদরে জড়িয়ে ধরে রাখা। তার নাকে একটা নথ। শক্ত করে চুল বাধা-মাথার পেছনে বেণী করা। কালো দুইটা ভুরুর মাঝখানে ছোট্ট একটা লালটিপ।
সাদাভাত। ভাতের উপর হলুদ মসুরের ডাল। ডালের উপর একটা মাছের মাথার টুকরো টুকরো ভাসছে। কালো পিছল চামড়ার কাতলা মাছ-পুকুর থেকে তাজা তুলে আনা। গোল একটা পিতলের চামচে মাথার মাঝখানের টুকরোটা আমার পাতে উঠে আসে।
খাও দাদাভাই, মাছের ঘিলু বেশি করে খালি তোমার মাথার ঘিলু বাড়বে।
মাছের ঘিলু খেয়ে আমার মাথার ঘিলু বাড়ে, কিন্তু পেটের জায়গা কমে যায়। মেজাজ খারাপ হতে থাকে-কেনো আমার পেটে অপরীসীম জায়গা নেই? পেটের মাঝে বেশি বেশি করে খাবার নিয়ে রাখতাম, আর পরে সময় পেলে মুখের মাঝে বের করে এনে জাবর কাটতাম! আহারে কি স্বাদ। এক স্বাদ বারবার পাওয়া যেতো!
মুড়িঘন্ট ডালের পাশে একটা বাটিতে থকথকে লাল পেস্টের মতন। আমি জিজ্ঞাসা করি এ কি জিনিস? কাকীমা উত্তর দেয়-চিংড়ির ঘিলু। খাবা নাকি-অ দা?
আমার গা শিউরে ওঠে! ঘেরের থেকে তুলে আনা চিংড়ির থকথকে লাল মগজ দিয়ে রান্না করা তরকারি! কি পরিমাণ কোলেস্টেরল কে জানে? এই জিনিস খাওয়া আর ধমনীর মাঝে সয়াবিন তেল ইনজেক্ট করার মাঝে খুব পার্থক্য নেই। নিশ্চিত ডায়াবেটিস!
ধূর! হলে হোক ডায়াবেটিস। কিরকম পুরু থকথকে তুলতুলে গদগদে মজা! এই স্বাদের জন্য আমার এক্ষণ মৃত্যু হলেও আমি আবার খাবো। আমি খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। খয়েরী একটা ভালোবাসার হাত আমাকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে ক্লান্ত হয়না। এক সপ্তাহান্তে আমার ওজন বেড়ে যায় পাঁচ কেজি।
২
রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড আর ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব এনটিপিসির যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবন থেকে মাত্র সতের কিলোমিটার দূরে বাগেরহাট জেলার রামপাল থানায় একটি বিদ্যুতকেন্দ্র গড়ে তোলবার জন্য একটি প্রকল্প।এই প্রকল্প নিয়ে এতো আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে কারণ বিদ্যুতকেন্দ্রের অবস্থান সুন্দরবনের আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যঘোষিত স্পট থেকে মাত্র চৌদ্দ-থেকে সতের কিলোমিটার। সাড়ে চারবছর ধরে বনের এতো কাছে একটা এতোবড় স্থাপনা বানানো হলে যে পরিমান শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, বন ধ্বংস, অয়েল স্পিলেজ, বর্জ্য নিষ্কাশন আর নদী ড্রেজিং হবে-তাতে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। এই পশুর নদীর ইরাবতী ডলফিন বা আমাদের শুশুক এতে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় যে সালফার আর নাইট্রোজেন গ্যাস নির্গত হবে তাতে এসিড বৃষ্টি হতে পারে। কঠিন আর তরল বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বের হয়ে সুন্দরবনের নদীর পানিতে মিশে যেতে পারে। সালফার গ্যাসে ক্যাওড়া গাছ যদি আহত হয় তবে সেই গাছের পাতা খেয়ে বেচে থাকা হরিণও আশংকার মাঝে পড়বে। আর এই একই উপায়ে সুন্দরবনের সমগ্র ইকোলজিই কুপ্রভাবের মাঝে পড়তে পারে। (১)
বিদ্যুতকেন্দ্র তৈরীর প্রস্তুতি হিসেবে এর মাঝেই প্রায় ৪০০ একর জমি ভরাট করা হয়েছে যার মাঝে একটা প্রাকৃতিক খাল ছিলো। ভবিষ্যতে আরো বেশি ড্রেজিংএর প্রয়োজন হবে যেটি পশুর আর মৈদারা নদীর জলজ প্রানীদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে ধাংমারি শুশুক অভায়রণ্যে এর একটা বড় শিকার হতে পারে। (২)
বিদ্যুতকেন্দ্রে কয়লা নিতে গেলে সরাসরি পশুর নদীর উপর দিয়ে বছরে চারশ থেকে পাঁচশটা ট্রিপ নিতে হবে। এই কয়লা কোথা থেকে আনা হবে সেটা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি-অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা আর চীনের নাম শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে জোরালো নামটি হলো ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব কোল ইন্ডিয়ার এবং যেহেতু অর্ধেক মালিকানা ভারতের, কাজেই অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন যে এটা আসলে কোল ইন্ডিয়ার বাংলাদেশের কাছে কয়লা বিক্রি করবার একটি উপায়। এই কোল ইন্ডিয়ার কয়লা ভারত থেকে রামপালে আনতে নদীপথের যেকোন দূর্ঘটনায় বা গাফিলতিতে সুন্দরবনের জলাভূমির ক্ষতি হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। যেরকম একটি ঘটনা ইতিমধ্যে ২০১৪ সালের অয়েল স্পিল দুর্ঘটনায় আমরা দেখেছি। সেইসময়ে আমাদের সরকার কতটা তৎপরতা দেখায় সেটাও আমরা দেখেছি। সেইসময়ে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া একমাত্র পদক্ষেপ ছিলো-এলাকার মানুষজনকে মাছ ধরার জাল দিয়ে তেল পরিস্কার করে ফেলতে বলা। (২) একই ঘটনা আবার ঘটলে একই ঘটনা আবার ঘটবে-এটা সহজেই অনুমেয়।
এই প্রজেক্টের যে এনভারনমেন্ট ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্ট করা হয়েছে তার আগেই এর চুক্তির কাজ শুরু করে দেয়া হয় আর পরবর্তীতে যে ইয়াইএ দেয়া হয় সেটা আসে সরকারের একটি দপ্তর সিইজিয়াইএস থেকে যেখানে কোন এক্সিডেন্ট বা রিস্ক ম্যানেজমেন্টের কোন ব্যখ্যা দেয়া হয়না। সাধারণত এধরণের রিপোর্ট কোন ইমপারশিয়াল তৃতীয় পক্ষ থেকে নেয়া হয়-কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকেই একটা আধাখেচড়া রিপোর্ট দেয়া হয়েছে যেটাকে সাউথ এশিয়ান রাইটস আর নরওয়ে সরকার পেনশন ফান্ডের এথিকস কাউন্সিল পক্ষপাতী আর অপূর্ণাঙ্গ হবার দায়ে সমালোচনা করেছে।(১)
এই প্রকল্পের তিরিশ ভাগ অর্থায়ন করবে ভারত ও বাংলাদেশের সরকার এবং বাকি অর্থ আসবে ব্যাংক লোন থেকে। তিরিশ ভাগের যতটুকু বাংলাদেশ অর্থায়ন করবে-সেই টাকা আসবে জনগনের ট্যাক্সের টাকা থেকে। অথচ জনগণের টাকা দিয়ে সরকার এমন একটা প্রকল্প গড়ে তুলতে চাইছে যে সেটাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সেই জনগণই।
সরকার বলছে যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আরো বেশি বিদ্যুৎ আসবে-জনগণের সুবিধা হবে। অথচ আন্তর্জাতিক এনার্জি ইকোনমিকস আর ফাইনান্সিয়াল এনালাইসিস প্রতিষ্ঠান আইইইএফএ বলছে যে এই প্রজেক্টের কারণে বিদ্যুতের দাম না কমে বরং বাড়বে।(১) সেই বিদ্যুতের দাম বেড়ে যে পর্যায়ে পৌছাবে সেটা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে বাস্তবস্মত নাও হতে পারে।
এই যে বিদ্যুতকেন্দ্র হচ্ছে তার শতকরা পঞ্চাশ ভাগের মালিক হবে ভারতের সরকার আর পঞ্চাশ হবে বাংলাদেশ। অথচ এই বিদ্যুতকেন্দ্রের জমি, কর্মী আর পরিবেশগত ঝুকি পুরোপুরি বাংলাদেশের। মোট খরচের তিরিশ শতাংশ দেবে ভারত বাংলাদেশের সরকার আর বাকি সত্তর শতাংশ আসবে ব্যাংক লোন থেকে-যেটার একটা বড় অংশ দেবে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব এক্সিম ব্যাংক যার অর্থায়নের পিছনে রয়েছে ভারত হেভি ইলেকট্রিক কম্পানি।(১) ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুতখাতে ক্ষতির পরিমান প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। সেখানে একটা অতি ভর্তুকিপ্রাপ্ত, অতিরিক্ত ট্যারিফওয়ালা দামি বিদ্যুৎ বেচে সরকার ঠিক কতটুকু টাকা তুলে এনে সেটা দিয়ে কতটুকু লোন ফেরত দিতে পারবে সেটা সহজেই বোঝা যায়।কাজেই লোনের টাকা ইন্টারেস্টসহ ফেরত দিতে হবে গাঁটের পয়সা থেকে অর্থাৎ কৃষক আর দিনমজুরের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে। অথচ সেই টাকা দিয়ে বানানো বিদ্যুৎ হয়তো তারাই কিনে ব্যবহার করবার সুযোগ পাবেনা-কিন্তু বানানোর সময় তাদেরকে ঘর থেকে খেদিয়ে দিতে আমাদের সরকারের দুইবার ভাবতে হয়নি।
এইরকম সরকারী কোন কাজে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে ১৯৮২ সালের রিকুইজিশন অফ ইম্মুভেবল প্রপার্টি অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী সরকারের একটি তিন ধারার নোটিশ দেবার কথা। এরপর তাতে কারো অবজেকশন থাকলে ছয় ধারা নোটিশ দিয়ে জানানো যাবার কথা। যদি সেই অভিযোগ মেটানো যায়-তবে প্রশাসন আবার সাত ধারা একটা নোটিশ দিয়ে ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি মিটিয়ে জমিটি গ্রহণ করতে পারে।(২)
অথচ এইক্ষেত্রে সাইট ক্লিয়ারেন্স বা এনভারনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্সের আগেই জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়ে যায়। তিনধারা নোটিশ দেয়া হয়েছে-কিন্তু জমির মালিকেরা যখন বিরোধিতা করেছে তখন সরকার গুন্ডা পান্ডা ভাড়া করে তাদেরকে এলাকা থেকে বলপূর্বক তাড়িয়ে দিয়েছে।(২) ছয় ধারা সাত ধারা এই দুঃখী পরিবারগুলোর অশ্রুধারা হয়ে ঝরে পড়েছে।
সরকারের পক্ষ বলা হয়েছিলো যে এই প্রজেক্টের জন্য দেড়শ পরিবারকে পুনসংস্থান করতে হবে কিন্তু আদতে এর মাঝেই চারশ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। অধিকাংশ পরিবার কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি আর যারা পেয়েছে তারাও মার্কেট প্রাইসের চেয়ে অনেক কম পেয়েছে। তাদের প্রতি একরে দুই লাখ টাকা দেয়া হয়েছে যেখানে মার্কেটে এলাকার জমির দাম ছয়লাখ টাকা-সরকারি কমপেনসেশনের তিন গুন।(১)
যেসব পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে-সরকারী হিসাবমতেই তাদের প্রতি পরিবারে গড়ে তিনটা থেকে দুইটা গরু, চারটা করে ছাগল, একটা ভেড়া, পাচটা হাস আর সাতটা করে মুরগী রয়েছে। যে ১৮৩৪ একর জমি দখল করা হচ্ছে তার মাঝে অধিকাংশের মালিক চিংড়ি ঘের করে, আর ধান গলায়। এই জমি থেকে ৬২,৩৫৩ টন চাল আর ১৪০,৪৬১ টন অন্যান্য শস্য উৎপাদিত হয়। সরকারের হিসাবই বলছে যে এই প্রকল্প এই এলাকায় মুক্ত জলজ প্রাণীর আবাসনে সমস্যা সৃষ্টি করবে, নদী-খালবিলের পানি আর মাছ ড্রেজিং, ট্রাফিক চলাচল আর তেল ও রাসায়নিক স্পিলেজে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কিন্তু যে লাভের লাভ হবে তাতে এই সব সমস্যা হারিয়ে উন্নয়নে সয়লাব হয়ে যাবে-যদিও ঠিক বিটিভির মতন করে, এই সরকারী রিপোর্টও সেইটার কোন ব্যখ্যা দেয়া হয়নাই। (২)
অথচ এই বিদ্যুতকেন্দ্রের বিকল্প হিসেবে আরো অনেক কিছু করার উপায় রয়েছে। বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল লাগিয়ে অথবা অফ গ্রীড ইলেক্ট্রিসিটি দিয়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড আর গ্রামীন শক্তি এর মাঝেই অনেক সফলতা পেয়েছে। প্রচুর পরিমাণে বায়ুবিদ্যুত তৈরীর সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশে। পিডিবি বলছে কাপ্তাই জলবিদ্যুত প্রকল্পকে আরো একশো মেগাওয়াট বাড়ানো যায়। সাঙ্গু আর মাতামুহুরী নদীতে আরো দুইটা জলবিদ্যুতকেন্দ্র বানানো যায়।(১)
তাহলে এতোকিছুর পরেও সরকার রামপাল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল কেনো করছেনা? উত্তরটা ভারতীয় ফরেন পলিসিতে। আইইইএফএ বলছে ভারত এতো বেশি অর্থ খরচ করে এই প্রজেক্টটি করাতে চাচ্ছে কেনোনা কম খরচে কয়লা আমদানীর কথা বলে ভারত বাংলাদেশ যৌথ রেল চুক্তি রামপাল পর্যন্ত বর্ধন করে সহজেই কোল ইন্ডিয়ার কয়লার উপর রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে নির্ভরশীল করে ফেলা যায়। আর এই তাপবিদ্যুৎকেন্দ নদী-সমুদ্রের অনেক কাছে হওয়ায় সহজে নদীপথে কয়লা পরিবহন করে আনা যাবে এবং তাতে খরচও কম হবে। ভারতের আইন অনুযায়ী কোন বনাঞ্চলের পচিশ কিলোমিটারের মাঝে বিদ্যুতকেন্দ্র তৈরি নিষিদ্ধ। একারণে এর আগে ভারতের দুইটি স্থানে একই ধরণের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রচেষ্টা সফল হয়নাই।কিন্তু বাংলাদেশের আইনে এই সীমাবদ্ধতা মাত্র দশ কিলোমিটার। (১)
যাতে করে রামপালে দশ যোগ চার চৌদ্দ কিলোমিটার দূরে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে কম খরচে প্রচুর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নিজের দেশে নিয়ে যাওয়া যায়, নিজের দেশের কয়লার একটা নিশ্চিত ক্রেতা পাওয়া যায় আর নিজের রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের লোনের উপর বাংলাদেশের করদাতাদেরকে দায়বদ্ধ করে ফেলা যায়-ভারতের জন্য পুরোপুরি বিচক্ষণ একটা বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত।
আর বাংলাদেশের জন্য প্রলয়ংকারী ধরণের একটা বোকা সিদ্ধান্ত।
অথবা কে জানে হয়তো বাংলাদেশের অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক সরকার, যাদের ক্ষমতার ভিত্তি দেশের জনগণের চেয়ে দেশের বাইরের বিশেষ শক্তির উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল-তাদের জন্য হয়তো খুবই চালাক একটা সিদ্ধান্ত।
৩
আমি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি আজকে থেকে ঠিক এক বছর আগে। এখানে আসার পরে খুব বিপদে পড়ে যাই। যখনই মানুষ বলে, তুমি কোথা থেকে এসেছো, আমি কোনভাবেই তাদের চিনাতে পারি না। বলি বাংলাদেশ-অধিকাংশেই চেনেনা। এরা বাসা থেকে গুগল ম্যাপস ছাড়া বাজারে কেমনে যেতে হয় সেটাই চেনেনা-আর বাংলাদেশ!
কাজেই আমাকে নির্দিষ্ট করে বলতে হয়, ভারত আর মিয়ানমারের মাঝখানে ছোট্ট একটা মিষ্টি দেশ-ভালোবাসা আর বৃষ্টির দেশ থেকে আমি এসেছি। এরপর অনেকে চিনতে পারে। সাথে সাথে তারা বলে-ও আচ্ছা! বুঝেছি। ওই যে, খালি বন্যা হয়, ওই দেশটা না?
আমি মিনমিন করে বলার চেষ্টা করি-আগের থেকে অনেক কম হয় অবশ্য।
সাধারণত মিনমিনানিতে কাজ হয়। আমার ফিলসফির প্রফেসর চার্লস ভারহারেনের সামনে কাজ হলোনা। তিনি আমাকে পালটা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি জানি কি করবা? পলিটিকস করবা-তাইনা? আচ্ছা, যতদিনে তুমি পলিটিকস করে দেশের প্রেসিডেন্ট হবা ততদিনে তো বাংলাদেশ ডুবে যাবে। সেটা নিয়ে তোমার চিন্তাভাবনা কি?
আমি হঠাৎ করে আবিস্কার করলাম যে আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে কোনদিন ভাবিই নাই। বাংলাদেশ যে একটা দূর্যোগপ্রবন, উত্তাল সমুদ্রের আর মাতাল নদীর দেশ-ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের আর মারাত্মক জলোচ্ছাসের দেশ-ঢাকা চিটাগাংয়ে বসে ধর্ম আর সংবিধানের ঠোকাঠুকি নিয়ে বকবক করতে করতে আমি সেটা কখনও বুঝতেই পারিনাই। হঠাৎ করে আমার বুকে কাঁপন ধরে যায়। তাইতো! আমি যে দেশ বাচাবো জাতি বাচাবো ভেবে দেশ ছেড়ে চলে আসলাম-ফিরে যেতে যেতে দেশটা থাকবে তো?
আমার বুকে আরও কাঁপন ধরে যায় যখন আমি দেখি প্রত্যেকদিন আমার মতন ছেলেপেলেরাই-আমাদের নেতারাই আর আমাদের সাংবাদিকেরাই রাজনীতি মানেই শহরের রাজনীতি বোঝে। কামড়াকামড়ি আর রক্তারক্তির রাজনীতি, পার্টি অফিস আর মানবন্ধনের রাজনীতি, হরতাল আর ওয়াকআউটের রাজনীতি! নদী-নৌকার খোল-লাঙ্গল আর কিশোরের খয়েরী মাঠের চিকচিকে ঘামের রাজনীতি আমরা বুঝতে শিখিনাই।
তাই সুন্দরবনে তেলের ট্যাংকার ডুবে যাবার পর যখন দেখি আমেরিকার এক সিনেমা অভিনেতা বাংলাদেশের দশটা তরুণের চেয়ে বেশি আতংকিত-আমি আরো দশগুণ আতংকিত হই। যখন কালো তেলে ঢাকা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছবিটা দেখি তখন সবুজ রঙের পাসপোর্টের ওপর জলছাপ দেয়া বাঘের লাফিয়ে চলার ভঙ্গিমা দেখে আমার নিজেকে হিপোক্রিট মনে হয়। আমার ইচ্ছা করে চমস্কি অন এনার্কিজমের বই ছেড়েছুড়ে আমি মেজর বদলায়ে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স পড়া শুরু করি কারণ আর কোন বাংগালির আর কোনকিছু পড়া এখন আর মানায় না। এখন রাজনীতি মানেই অস্তিত্ব রক্ষার রাজনীতি-অর্থনীতি মানেই পরিবেশ বাচানোর অর্থনীতি-বিজ্ঞান মানেই সভ্যতা বাচানোর বিজ্ঞান।
আর সেখানে আমি দেশের থেকে আট হাজার মাইল দূরে বসে সুন্দরবনের বুকে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর খবর পড়ি। শত আঘাতের বুকে আমাদের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ প্রাচীরের বুকে সগর্বে টাইমবোমা বসিয়ে দেবার সংবাদ শুনি-আর আমার বুকের মাঝে খাঁ খাঁ করে ওঠে।
আমি দেখতে পাচ্ছি অনেকে আওয়াজ তুলেছে-অনেকে সংগ্রাম করছে সুন্দরবন বাচানোর জন্যে। আমি তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করি। কিন্তু আমি কোথাও না কোথাও জানি-হয়তো আমরা কিছুই থামাতে পারবো না। আমার অজিত কাকুর পেশির চেয়ে বাংলাদেশ সরকারের বাহুর বল বেশি-আমার কাকীমার চোখের জলের চেয়ে ভারতীয় বিনিয়োগকারীর মুচকি হাসির তেজ বেশি আর আমার সুন্দরবনের বাঘের চেয়ে বাংলাদেশ-ভারত 'মৈত্রী'র গুরুত্ব বেশি।
আমি শুধু দেখবো-আর শুনবো আর বুঝবো। আমার আর কিছুই করার নেই। আমি শুধু বিড়বিড় করে বলতে থাকবো-যাদেরকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তাদেরকে আমি চিনি। যেই নদীর বুক চিরে কয়লা বয়ে নেয়া হবে-সেই নদীকে আমি চিনি। যেই খালটিকে প্রকল্পের কাজে ভরাট করে দেয়া হবে-সেই খানে আমি সাতার কেটেছি। যেই জমিতে আর ফসল ফলানো হবেনা-সেই জমিটিকে আমি নিজের বাপদাদার বলে ভুল করেছিলাম। যেই শুশুকটি আর কখনো পানির উপরে ভেসে আসবে না তাকে আমি চিনি। যেই হরিণটিকে দেখবার জন্য যাবো যাবো বলেও আমার শেষপর্যন্ত সুন্দরবণ যাওয়া হলোনা-সালফার গ্যাসে ধুকে ধুকে মরা সেই হরিণকেও আমি চিনি-সত্যি!
তারা সবাই আমার মতন-কেউ বুঝতে পারেনি তাদের সামনে কি আসছে। কেউ বুজতে পারেনি তাদের সাথে কি হতে যাচ্ছে। কেউ বুঝতে পারেনি তাদের সব হিসেবে গোলমাল হয়ে যাবে। কেউ বুঝতে পারেনি তাদের সব পরিচিত প্রেক্ষাপট অপরিচিত হয়ে যাবে।
যখন রামপালে কয়লা নিয়ে যাওয়া পাচশটা ট্রিপের কোন ইন্ডিয়ার কয়লার জাহাজের একটা কয়লার জাহাজ পশুর নদীতে উত্তাল ঘূর্ণিঝড়ে ডুবে গিয়ে আমাদের ঘেরের খয়েরী নীল অদ্ভুত মায়া মেশানো পানিকে কুচকুচে কালো করে দেবে-তখন গ্রামীন শক্তির সোলার প্যানেল লাগানো ব্যাটারি দিয়ে মোবাইল চার্জ দেয়া শেষে একজন মধ্যবয়স্ক নারী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘশ্বাস ফেলা তার অভাগা এক নাতির সাথে কথা বলবে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো, পারুল, ভালো আছো? শরীল ভালো ঠেকতিসে আজকে?
পারুল আমাকে বলবে, হয় ভায়দা, ভালো আছি-তুমি ভালো আছো? বাড়ি আসবা কবে তুমি? এবার বাড়ি আসলি ঘেরের'তে চিংড়ি ধরে খাওয়াবানি। এত্তোবড় চিংড়ি হইসে এইবারে ভায়দা-একেকটা আমার হাতের সমান।
আমি তখন হেসে পারুলকে বলবো-আসবানি পারুল, এবারে ছুটি পালিই চলে আসবানি
তথ্যসূত্র
১) ইন্সটিটিউট অফ এনার্জি ইকোনমিকস এন্ড ফাইনান্সিয়াল এনালিসিস (২০১৬), রিস্কি এন্ড ওভার সাবসিডাইজডঃ আ ফিনান্সিয়াল এনালিসিস অফ দ্য রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। অথরঃ শারদা ও বাকলি।
২) সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (২০১৬), রিপোর্ট অফ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন টু রামপাল, বাংলাদেশ। কলম্বো, শ্রীলংকা
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৪:০৯